তিউনিসিয়া

কৃচ্ছ্রসাধনের বিরুদ্ধে আবারও আন্দোলন

Looks like you've blocked notifications!

আরব বসন্তের স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টিকারী তিউনিসিয়ার জেসমিন বিপ্লবের কথা মনে আছে? কিংবা মনে আছে মহাম্মদ বাজুজির কথা, যে যুবক নিজের বেকারত্বের যন্ত্রণা সহ্য না করতে পেরে নিজের গায়ে আগুন ঢেলে আত্মহত্যা করেছিল আর তাঁর আত্মাহুতির মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা বিক্ষোভে পতন ঘটেছিল দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসক বেন আলির? এ বছরই তার সাত বছর পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু দেশটিতে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আবারও অশান্তির দাবানলে পুড়ছে পুরো তিউনিসিয়া।

২০১১ সালে বেন আলির পতনের পর ক্ষমতায় এসেছিল মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক ইসলামী শক্তি এনহাদা। কিন্তু তারা বেশিদিন এককভাবে ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। ২০১৪ সালের নির্বাচনে যৌথভাবে বিজয়ী হয় এনহাদা আর মধ্যপন্থী ধর্মনিরপেক্ষ দল নিদা টৌনস। নির্বাচনেই জোট গঠন হয় দুই দলের। রাষ্ট্রপতি হন ৯১ বছরের বুড়ো বেজি কাইদ এসেবসি। তিনি অবশ্য বেন আলির পুরোনো জমানার গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ব্যক্তিত্ব। যাই হোক, ইসলামী শক্তির সঙ্গে নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের দলের জোট নিদা টৌনস দলের অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। যার পরিণতিতে দলের তৃণমূলের অনেক কর্মীই দল থেকে পদত্যাগ করে।

গত সাত বছরে একটিই ইতিবাচক ঘটনা ঘটেছে তিউনিসিয়ায়। তা হলো দেশটির জনগণ এনহাদার মতো সাম্প্রদায়িক শক্তিকে এককভাবে ক্ষমতায় থাকতে দেয়নি। কেননা, অনেকেরই আশঙ্কা ছিল তিউনিসিয়া ১৯৭৯-এর ইরানি ইসলামী বিপ্লবের পথ ধরবে। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ সরকার ক্ষমতায় এসে যে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে, তার ফলে উদ্ভূত জনগণের হতাশা এনহাদার মৌলবাদী শক্তিকে লাভবান করবে।

২০১৫ সালে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার একজন পুলিশ কর্মকর্তার মৃত্যুতে যে পুলিশ আইন পাস করে, তা দেশটিতে এক ভয়ানক কর্তৃত্ববাদী শাসন কায়েম করে। পুলিশ এবং সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা এবং সুযোগ-সুবিধা এত বাড়িয়ে দেওয়া হয় যে দেশটি পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত হয়। গত বছরের সেপ্টেম্বরে আরেকটি বিতর্কিত আইন সংসদে পাস হয়। এই আইনের মাধ্যমে স্বৈরশাসক বেন আলির জমানার অনেক দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করা হয়। অবশ্য দেশটির জাতীয় সংসদে এই আইন পাস হওয়া নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়।

বর্তমান তিউনিসিয়ার সরকার দারিদ্র্য এবং বেকারত্বের অতলগহ্বরে জনগণকে নিক্ষিপ্ত করছে। তারা নিরাপদ ভবিষ্যতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না। তারা চলছে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ আর তাদের তল্পিবাহক সংস্থা আইএমএফের অঙ্গুলি হেলনে। দেশটির সরকার গত বছরের ডিসেম্বরের শেষে আইএমএফের নির্দেশনায় ২০১৮ সালের বাজেট পাস করে। এই বাজেট থেকেই বর্তমান বিক্ষোভের সূত্রপাত। আইএমএফ দেশটির ২ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণের মধ্যে বিলম্বিত ৩২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের কিস্তি মওকুফ করতে রাজি হয়। 

তিউনিসিয়ার বর্তমান সরকারের পাসকৃত সর্বশেষ বাজেটকে আইএমএফ সাহসী এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী বলে অভিধা দেয়। কেননা, তাদের নির্দেশনায় বাজেটটি রাজস্ব ঘাটতি দেশটির জাতীয় প্রবৃদ্ধির ৫%-এর নিচে নামিয়ে আনার অভিপ্রায়ে রচিত। এ জন্য তিউনিসিয়ার সরকার কর বাড়িয়ে দিয়েছে, ভর্তুকি বাতিল করেছে এবং পাবলিক সার্ভিসের ব্যাপক সংস্কার করার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করেছে। সরকারি চাকরি থেকে অবসরের বয়সসীমা বাড়িয়ে দিয়েছে। জনগণের জীবনযাত্রার ওপর আরো অনেক ধরনের আঘাত হেনেছে এই বাজেট। বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম ক্রমে বেড়ে চলেছে। গত ১ জানুয়ারি দেশটিতে যে অর্থ আইন কার্যকর হয়েছে, তা যেন স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি করেছে। গণমাধ্যমে এটি আগে আলোচিত হলেও মানুষ তখন ব্যাপারটি খেয়াল করেনি। কিন্তু দ্রব্যের দাম যখন বেড়ে গেল, তখনই মানুষ কেবল বুঝতে পারল।

অতিসম্প্রতি তিউনিসিয়ায় যে বিক্ষোভ সংঘটিত হচ্ছে, তার সিংহভাগে আছে তরুণ এবং দরিদ্ররা। ২০১১ সালে স্বৈরশাসক বেন আলির (যার মদদদাতা ছিল পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ, বিশেষ করে ফরাসি শাসকগোষ্ঠী) পতনের আন্দোলন থেকে যত বিক্ষোভ দেশটিতে হয়েছে তার সবটাতেই এদের উপস্থিতি ছিল সবচেয়ে বেশি। তারা বারবারই জেগে উঠছে এবং বড় বড় জনসমাবেশ ও ধর্মঘট সংঘটিত করছে। তারা এবারও জেগে উঠেছে। কিন্তু তাদের এই রাজপথে নেমে আসা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে সঠিক নেতৃত্বের অভাবে।

সাম্প্রতিক বিক্ষোভের চূড়ামণি বেকার যুবকরা। তিউনিসিয়ায় বর্তমানে তরুণদের বেকারত্বের হার ৪০% ছাড়িয়ে গেছে। এই বিক্ষোভকে ‘ফেক নেস্তানাউ’ নামে ডাকা হচ্ছে যার অর্থ হলো ‘আমরা কিসের জন্য অপেক্ষা করছি’। এ পর্যন্ত বেশ কয়েকশ বিক্ষোভকারী গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং একজন মারা গিয়েছেন। দেশটির দরিদ্র অঞ্চলের ১০টি শহরে বিক্ষোভের মাত্রা সবচেয়ে বেশি। এ পর্যন্ত প্রায় ২০টি শহরে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে। বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশি নির্যাতনের মাত্রা ভয়াবহ। কেসারিন এবং গাফসা নামক শহরে সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। গত সপ্তাহের সোমবার রাজধানী তিউনিসের পশ্চিমে তেবরুবা নামক স্থানে ৫৫ বছর বয়স্ক খোমি এল ইরফানি নামের এক বিক্ষোভকারী মহিলাকে পুলিশভ্যান চাপা দিলে তিনি ঘটনাস্থলে মারা যান।

বিক্ষোভের কারণ বলতে গিয়ে ফাতেমা নামে তিউনিসের এক সাধারণ নারী বলেন, ‘যে বেন আলিকে আমরা পছন্দ করতাম না, তার সময়েও সবজি, ফল এবং অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য ১০ দিনারে পাওয়া যেত। আর এখন তা ৫০ দিনারেও পাওয়া যাচ্ছে না।’ তিনি আরো বলেন, ‘বর্তমান সরকার দরিদ্র এবং মধ্যবিত্তদের ওপর আঘাত হেনেছে। তারা ব্যবসায়ী এবং করদাতাদের বিপক্ষেও অবস্থান নিয়েছে।’

তিউনিসিয়ার সাম্প্রতিক দুর্দশার জন্য দায়ী হলো পুঁজিবাদ আর শাসকশ্রেণির সাম্রাজ্যবাদনির্ভরতা। তাই যতক্ষণ না অধিকাংশ জনগণের স্বার্থে একটি গণতান্ত্রিক কর্মসূচি বাস্তবায়িত না করা যাবে এবং স্থানীয় লুটেরা পুঁজিপতি ও বহুজাতিক কোম্পানির সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত না করা যাবে, ততক্ষণ দেশটির জনগণের মুক্তি নেই। আর সেটা না করতে পারলে তাদের বারবার জেসমিন বিপ্লবের মতো ব্যর্থ আন্দোলনই করে যেতে হবে। 

লেখক : রাজনৈতিক কর্মী