অভিমত
বোধের দুয়ারের তালা ভাঙতে হবে
সম্প্রতি এক বিকেলে মতিঝিলের বেশ প্রাচীন সেলুন ‘মতিঝিল হেয়ার সেলুনে’ গেলাম চুল কাটাতে। এখানে যাঁরা আছেন তাঁরা অনেক বছর ধরে এই একই সেলুনে নরসুন্দরের কাজ করছেন। পাঁচ-ছয় বছর ধরে আমার সঙ্গে এদের অল্পসল্প সখ্য গড়ে উঠেছে। সেই সূত্রে গেলেই মোটামুটি আলাপ-সালাপ হয়। অন্য যাঁরা চুল কাটাতে আসেন তাঁদের অনেকেও আলাপে যোগ দেন। সেদিন বিকেলে যাওয়ার পর থেকেই দেখলাম এক ভদ্রলোক চুল কাটাতে বসে বেশ রসিয়ে রসিয়ে গল্প করছেন। কথা বেশি হচ্ছে আমার চুল যিনি কাটছেন তাঁর সঙ্গেই। বোঝা গেল, গ্রাহক আর সেবাদাতার মধ্যে আগে থেকেই ভালো রকমের সখ্য আছে। আমি চুপ মেরে তাদের কথোপকথন শুনতে লাগলাম। যিনি গল্প বলছেন তাঁর নাম জামাল। সেলুনের লোক তাঁকে ‘জামাল ভাই’ বলেই সম্বোধন করছিলেন।
জামাল ভাইয়ের বলা গল্প (গল্প না ঠিক, বাস্তব ঘটনা) ঢাকা নগরীর বাসিন্দাদের জন্য বা বৃহত্তর দৃষ্টিতে যেকোনো সমাজের জন্যই বেশ প্রাসঙ্গিক মনে হলো আমার কাছে। গল্পটা বলি।
জামাল ও তাঁর এক বন্ধু রাজধানীর কোনো এক রাস্তার ফুটপাত দিয়ে হাঁটছিলেন। হঠাৎ দেখতে পেলেন রাস্তায় এক রিকশাচালক এবং প্রাইভেট কারের চালকের সঙ্গে কী একটা বিষয়ে একটু লেগে গেল। মুহূর্তের মধ্যে প্রাইভেটের চালক গাড়ি থেকে নেমে রিকশাওয়ালাকে এত জোরে জোরে ঘুষি মারতে লাগল যে রিকাশাওয়ালা একেবারে চিৎপটাং, অর্থাৎ মাটিতে পড়ে গেল। প্রাইভেট কারের ভেতর থেকে এ দৃশ্য বেশ উপভোগ করছেন মালিক। জামালের ভাষায়, এ ঘটনায় ‘টং’ করে উঠল তাঁর মাথা। ছুটে গিয়ে প্রাইভেটের চালককে দিলেন ইয়া বড় এক ঘুষি। তার মাথা ঘুরতে লাগল। দিশা করে উঠতে না উঠতেই দিলেন আরো বেশ কয়েকটা। ব্যস, ওই ব্যাটাও রাস্তায় গড়িয়ে পড়ল! এবার গাড়ি থেকে নেমে এলেন মাননীয় মালিক সাহেব। বেশ একটু প্রতিবাদী ঢংয়ের আওয়াজ তুলতেই জামাল কষে দুটি থাপ্পড় দিলেন তাঁর গালেও! আর বললেন, ‘ব্যাটা হারামজাদা, বসে বসে মজা নেস, না?’ অবস্থা বেগতিক দেখে প্রাইভেট কারের চালক-মালিক দুজনই কেটে পড়লেন।
গল্প শুনে সেলুনের ভেতর নানামুনির নানামত কিছুক্ষণ আদান প্রদান চলল। কেউ বলল, ‘একদম ঠিক কাজ হইছে, ব্যাটারা মানুষকে মানুষ মনে করে না।’ কেউ বলল, ‘আরে আমরা পাবলিকও কম খারাপ না, এখানে কি লোকের অভাব ছিল? কই, জামাল ভাই ছাড়া কেউ তো কিছুই কইল না, খালি চাইয়া চাইয়া তামাশা দেখল।’ আমি এই বাক্য বিনিমিয়ে যোগ দিলাম না। সম্ভবত কিছুটা অন্য মনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। সেলুন থেকে ফিরতে ফিরতে ভাবতে লাগলাম, আচ্ছা, জামালের জায়গায় যদি আমি থাকতাম, তাহলে কী করতাম? তাঁর মতো প্রতিবাদী কি হতাম? এগিয়ে কি যেতাম অন্যায় প্রতিরোধ করতে? একটা কথাও কি বলতাম? না, নিজের ওপর এ আত্মবিশ্বাস আমার নেই। আমিও হয়তো এমন পরিস্থিতিতে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকা বাকি ১০ জনের কাতারেই থাকতাম। আমিও আসলে এই নগরের এক ভীরু নাগরিক। প্রশ্ন হলো, তাহলে এই গল্প কেন ফেদে বসলাম?
এই গল্প বলছি কারণ, আমি এত ভীরু কেন এটাই ভেবে পাচ্ছি না। আমার তো কোনো শত্রু নেই, কারো সঙ্গে কোনো কারণে রেষারেষিও নেই কিংবা বাংলাদেশে বিশেষ কোনো ভীতিকর পরিস্থিতিও নেই এখন; দাঙ্গা-হাঙ্গামাও নেই। এরপরও কিসের এত ভয়? আমার ধারণা, এই নগরের কিংবা এই দেশের বেশিরভাগ মানুষেরই আসলে একই অবস্থা, আমার মতো। বেশিরভাগ মানুষেরই কোনো শত্রু নেই, তাদের বেশিরভাগের জন্যই ভয় পাওয়ার বিশেষ কোনো কারণ নেই। এরপরও সবাই ভয় পায়। কারণে অকারণে ভয় পায়।
নাকি আমরা খুব বেশি করে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেলাম, কে জানে! অন্যের কিছুতে আমাদের কিছু যায় আসে না। কেউ বিপদে পড়ুক, আহাজারি করুক, যা ইচ্ছে তাই করুক- সেদিকে তাকানোর আমাদের সময় নেই। চোখের সামনে অন্যায় ঘটতে দেখলেও আমাদের কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না। আমাদের কোনো বোধ কাজ করে না। আমরা সবাই মিলেই একত্রে অমানুষের পরিচয় দিচ্ছি। এই শহরে, এই সমাজে আমরা যারা বাস করছি, সবাই এমন বোধহীন রক্ত-মাংস আর হাড্ডির যোগ, আর কিছু না!
পুরান ঢাকার গোপীবাগে শব্দ দূষণের প্রতিবাদ করায় সম্প্রতি প্রকাশ্যে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয় এক অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীকে। আশপাশের সবার সামনে এই ঘটনা ঘটলেও কেউ এগিয়ে আসেনি তাঁকে বাঁচাতে। একটা লোকও প্রতিবাদ করেনি। সবাই যেন সিনেমার শুটিং দেখতে ছিল! একইভাবে এর কিছুদিন আগে চট্টগ্রামে প্রকাশ্যে দিন-দুপুরে রাস্তার ওপর দৌড়াতে দৌড়াতে একটা কিশোরকে ছুরি মেরে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। অথচ, শত শত মানুষ এই দৃশ্য দেখেছে। একটা লোক বলল না, কেন মারছ? আমাদের আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতা এবং ভয়ের জগতে কতখানি ঢুকে পড়লে এমন ঘটনা ঘটতে পারে?
এই নগরের আমি-আমরা, সে-তাহারা যত দিন ‘মানুষ’ না হয়ে উঠব, যত দিন আমাদের বোধ জাগ্রত না হবে, যত দিন আমরা বিনা কারণে ভয় পেতে থাকব, যত দিন আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলব না, তত দিন এই নগরকে কি কেউ ঠিক করতে পারবে? এই সমাজকে কেউ ঠিক করতে পারবে? নির্লিপ্ত সমাজ কখনোই অন্যায় থেকে মুক্ত হবে না।
অন্যায়-অপরাধের মাত্রা কমাতে হলে, সমাজ ও নগরকে নিরাপদ করতে হলে আমাদের চিন্তার জগতে পরিবর্তন আনতে হবে। সমাজ পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে আগে দরকার আমাদের নাগরিকদের এই মনোজাগতিক পরিবর্তন। মনোজগতে আমাদের ভাবতে হবে- এই সমাজে, এই নগরে আমি একা না, আরো অনেকে আছে। আমাদের ‘আমি’ থেকে ‘আমরা’ হতে হবে। তা যদি হতে পারি, তবে ব্যক্তি ‘আমি’র ঝুঁকিটা কমে যায়। অন্যায় যখন ঘটে তখন আমরা প্রত্যেকে ‘আমি’ হিসেবে নিজেদের ভাবি; আমি প্রতিবাদ করব কি করব না- এটা নিয়ে থাকি। অথচ সবাই যদি মনে মনে এটা ভাবি যে, ‘আমরা’ প্রতিবাদ করব, তখন কিন্তু কাজটা হয়ে যায়।
আমি বিশ্বাস করি, অল্পকিছু মানুষ ছাড়া এই নগরের আর এই দেশের বেশিরভাগ মানুষেরই সেই বোধ এবং সেই মন আছে, যা উপরে বর্ণিত গল্পের জামাল ভাইয়ের আছে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার মানসিকতা সবারই আছে। কেমন জানি মনে হয়, এই বোধের দরজায় আর মনের কোঠায় কেবল অদৃশ্য তালা ঝুলিয়ে রেখেছি আমরা। এই তালা ভাঙতে হবে। যা বলার তা বলতে হবে, যা করার তা করতে হবে।
বেশি কিছু না, প্রত্যেকে একবার করে উপরে বর্ণিত গল্পের ‘জামাল ভাইয়ে’র মতো একটা ঘটনার প্রতিবাদ করুন। এক কোটি মানুষ যদি তা করি, এক কোটি ঘটনার প্রতিবাদ করা হয়ে যাবে! চিন্তা করা যায়? সারাজীবন বালিতে মুখ গুঁজে থাকলে আমাদের কোনো সমস্যারই সমাধান হবে না, পরিবর্তন আসবে না। আজ একজন মার খাচ্ছে, কাল আরেকজন খাবে। নির্লিপ্ত থাকলে কেউ রেহাই পাবে না। এই শহরে, এই সমাজে অন্যায়কারী কিন্তু খুবই মুষ্টিমেয়; সিংহভাগ মানুষই অন্যায়ের বিপক্ষে। সাহস করে কেউ অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে, প্রতিরোধ করলে, অপরাধীরা পালানোর জায়গা পাবে না। পথ চলতে আমরা যদি অন্তত উপরে উল্লেখিত গল্পের ‘জামাল ভাই’য়ের মতো নাগরিক বোধও নিজেদের মধ্যে ধারণ করতে পারি, এক-আধটা ঘটনারও প্রতিবাদ করতে শিখি, তাহলে দেখবেন, আমরা নিজেরাই পাল্টে গেছি। আর আমরা পাল্টালে এই সমাজ ও নগরীও পাল্টাবে; পাল্টাবে এই দেশ।
লেখক : সাংবাদিক, আরটিভি