বিশ্লেষণ

৮ ফেব্রুয়ারি কি রাজনীতির গতিপথ বদলাবে?

Looks like you've blocked notifications!

৮ ফেব্রুয়ারি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ‘জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট’ দুর্নীতি মামলার রায় ঘোষণা হবে। আর একে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনা বিরাজ করছে। এ রায়ের মাধ্যমেই বিএনপির রাজনীতিরও গতি ও গন্তব্য নির্ধারিত হবে। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আদালতের রায় কী হবে কিংবা কী হতে পারে, তার সম্ভাব্যতা বিবেচনায় বড় দুই দলের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য রাজনীতির মাঠকে উত্তেজিত করে তুলেছে। তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে অভিযুক্ত খালেদা জিয়ার রায় আদালত নির্ধারণ করবেন। এতে পূর্বপ্রতিক্রিয়া রাজনীতি ও বিচার বিভাগের জন্য খুব বেশি মঙ্গলজনক নয়। রায়ে কী হতে যাচ্ছে, তা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও এ রায়ের সঙ্গে আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনের যে বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে, সেটি নিশ্চিত করেই বলা যায়। 

খালেদা জিয়া নির্বাচনের অযোগ্য হওয়ার প্রশ্নে বিএনপির এবং তার শরিক দল খালেদা জিয়াকে ছাড়া আগামী নির্বাচনে যাওয়া-না যাওয়ার প্রশ্নে এবং দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডলকে ঘিরে সারা দেশের মানুষের বিশেষ দৃষ্টি রয়েছে এই রায়ের দিকে। এরই মধ্যে বিএনপি ঘোষণা দিয়েছে, এই রায়ে খালেদা জিয়ার সাজা এবং তিনি যদি নির্বাচনে অযোগ্য হন, তাহলে (বিএনপিও) তারা নির্বাচনে আসবে না। সেইসঙ্গে রাজপথে থেকে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন তাঁরা। আনুষ্ঠানিকভাবে শিগগিরই কর্মসূচি ঘোষণা করার কথাও তাঁরা জানিয়েছেন। বিএনপির জন্য, ২০ দলের জন্য এবং জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী রাজনীতির জন্য এটি একটি বিশেষ ক্ষণ অতিবাহিত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের জন্যও এ সময়টি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সারা দেশে ধরপাকড়ের গতি দেখে রায়ের ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাচ্ছে, তা পরিষ্কার ধারণা করা গেছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা তথা জনগণের জানমালের স্বার্থে এই ধরপাকড় চলতেই থাকবে। 

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অংশ নেয়নি। ১৫৩টি আসনে কোনো ভোট হয়নি। সংগত কারণেই এ নির্বাচনকে একতরফা নির্বাচন দাবি করা হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আগামী নির্বাচনের হালও কি সেদিকে যাচ্ছে? নাকি একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে। আগামী নির্বাচনে সরকার সত্যিই বিএনপির অংশগ্রহণ চায় কি না, তা বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলাগুলোর রায়-পরবর্তী পরিস্থিতিতে বোঝা যাবে। রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ মামলা দুটিতে তাঁর সাজা হলেও হাইকোর্ট তা স্থগিত করলে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পথ খোলা থাকতে পারে। তবে বিচারিক আদালতে শাস্তি হলে নির্বাচনে অংশ নেওয়া যাবে না—সরকার এ ধরনের কোনো নতুন আইন করে খালেদা জিয়াকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার পরিকল্পনা করলে বিএনপির অংশগ্রহণ নিয়ে বাড়তি জটিলতা তৈরি হবে, সেটি সহজেই অনুমান করা যায়। 

এ ধরনের পরিস্থিতিতে সরকার গত নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলোর অনেককে বিভিন্নভাবে নির্বাচনে নিয়ে আসতে পারে। ৩০০ আসনেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতারও পরিবেশ সৃষ্টির চিন্তা করতে পারে সরকার। কিন্তু তারপরও দেশের অন্যতম জনপ্রিয় দল বিএনপিকে ছাড়া সেই নির্বাচন কখনো দেশে সত্যিকারের নির্বাচনী স্বাদ সৃষ্টি করতে পারবে না—এটি নির্দ্বিধায় বলা যায়। এমন নির্বাচন দেশের বিরাট একটি জনগোষ্ঠীর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। সরকারের এটি না জানার কথা নয়। 

কিন্তু এ মুহূর্তে যে পরিবেশ দাঁড়িয়েছে, তাতে যেভাবেই হোক, সরকার চায় ক্ষমতায় থাকতে। অন্যদিকে বিএনপিরও দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে তাদের অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। আবার যেকোনোভাবেই বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখতে পারলে সরকার এক ঢিলে দুই পাখি মারতে পারবে। সেটি হলো, বিএনপিও আস্তিত্বহীন তথা নাজুক অবস্থায় চলে যাবে, অন্যদিকে আওয়ামী লীগের আবারও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ক্ষমতায় আসার পথ পরিষ্কার হবে। আর এই পরিস্থিতিতে বিএনপির পক্ষেও নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়ানো দুষ্কর হয়ে উঠবে।

খালেদা জিয়া সিলেটে হজরত শাহজালালের (রহ.) মাজার জিয়ারতের মধ্য দিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছেন। এমনকি এই প্রচারণা চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। এ থেকেই পরিষ্কার বুঝতে পারা যায়, শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে হলেও তারা নির্বাচনে যেতে চায়। তাদের সহায়ক সরকারের দাবি নিতান্তই রাজনৈতিক। আর যদি খালেদা জিয়াকে (৮ ফেব্রুয়ারি) মামলার রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়, সে ক্ষেত্রে রাজনীতিতে নতুন নাটকীয়তা পাবে। 

দেশের মানুষ যেমন উন্নয়ন চায়, তেমনি নির্বাচনও চায়। সাধারণ জনগণের কাছে ২০১৮ হবে নির্বাচনের ক্ষেত্রে আশাবাদের বছর। বাংলাদেশের মানুষ শুধু নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় শাসক দলের কর্মকাণ্ড মূল্যায়ন করার সুযোগ পায়। সেটিও পাঁচ বছরে মাত্র একবারের জন্য। এ প্রক্রিয়াটিও বন্ধ হয়ে গেলে নির্বাচনী উৎসব বলতে বাংলাদেশে আর কিছু থাকবে না। বাংলাদেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমে দুর্বল হয়ে উঠবে। 

এ বছরটি পুরোটাই নির্বাচনী প্রস্তুতির। এ সময়টি সব দলকেই রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে হবে। সরকার চাইবে, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে সংকট রাখতে। বিরোধীদলগুলোকেও ভেবেচিন্তে পদক্ষেপ নিতে হবে। বিভিন্ন প্রেক্ষাপটেই রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরের প্রতি আগ্রাসী রূপ ধারণ করবে। তবে ধারণা করা হচ্ছে, গেল নির্বাচনের মতো এমন নির্বাচন বর্জনের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত থেকে বিএনপি এবার সরে আসতে চায়। আর বিএনপিকে নির্বাচনমুখী করতে কল্যাণকর কৌশল অবলম্বন করবে সরকার—এমনটিই প্রত্যাশা। আবার ভুল রাজনীতির শিকার বিএনপিকে ‘বিচার মানি তালগাছ আমার’ মনোভাব পরিবর্তন করে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপি নির্বাচনে গেলেও দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন? 
৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার দুর্নীতি মামলার রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে অনেকটা অনিশ্চিত ভাগ্য বিড়ম্বনায় আটকে যেতে পারে বিএনপির নির্বাচনী যাত্রা। আমরা আশা করব, আগামী দিনের রাজনীতিতে যাই ঘটুক না কেন—রাজনৈতিক উত্তেজনা প্রশমিত করতে রাজনৈতিক বিচক্ষণতা প্রদর্শনের মাধ্যমে নির্বাচনের প্রাক্কালে বড় দুই দল ইতিবাচক আচরণ বজায় রাখবে। 

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্রফেশনাল স্টাডিজ।