অভিমত
বিএনপির টার্গেট আগামী নির্বাচন
গত ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে দলের চেয়ারপারসনকে কারাগারে পাঠানোতে কী প্রভাব পড়বে সেটি নিয়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনা চলছে। বিএনপির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দুর্নীতি মামলায় সাজা হলেও খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান কারোরই নেতৃত্বে থাকতে অসুবিধা নেই। ইতিমধ্যেই খালেদা জিয়া কারাগারে থাকায় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয়েছে। গঠনতন্ত্রের ৭(গ)(২)-এ ‘সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের কর্তব্য, ক্ষমতা ও দায়িত্ব’ উপধারায় বলা হয়েছে, ‘চেয়ারম্যানের সাময়িক অনুপস্থিতিতে তিনিই দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে চেয়ারম্যানের সমুদয় দায়িত্ব পালন করবেন।’ অবশ্য বর্তমানে তিনি লন্ডনে অবস্থান করলেও তথ্য-প্রযুক্তির যুগে যেকোনো ধরনের সিদ্ধান্ত দলকে দেওয়া তার জন্য খুব বেশি অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। বর্তমানে দেশের রাজনীতির মূল দিক হলো আগামী নির্বাচন। আর এই নির্বাচনকে ঘিরেই দল পরিচালনা ও যাবতীয় কার্যক্রম নির্ধারিত হবে। এ ক্ষেত্রে দলের করণীয় এবং তা বাস্তবায়নের জন্য তারেক রহমানের বার্তা কিংবা নির্দেশ খুব সহজেই নেতা-কর্মীদের কাছে পৌঁছাবে।
সংবিধান অনুযায়ী এ বছরের শেষ দিকে কিংবা আগামী বছরের শুরুতে নির্বাচন হওয়ার কথা। এই মুহূর্তে বেগম জিয়ার কারাগারে যাওয়ায় নির্বাচনে কেমন প্রভাব পড়তে পারে এবং বিএনপি কীভাবে পরিচালিত হবে সেটিও আলোচিত হচ্ছে। সাধারণদের অনেকেই মনে করেন, খালেদা জিয়াকে অযোগ্য ঘোষণা বা বাদ দিয়ে আগামী নির্বাচন হলে বিশ্ব সম্প্রদায় সেটি ভালোভাবে দেখবে না। আর এ ক্ষেত্রে বিএনপিও বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণের সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক মহলের। এই ইস্যুতে আন্তর্জাতিক মহলে বিএনপি তাদের যোগাযোগ বাড়াতে পারে বলে ধারণা করা যায়। আমরা জানি, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সহানুভূতি কিংবা সমর্থন পাওয়া বিএনপির অনেক দিনের লক্ষ্য। আর সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নের সময় এসেছে বিএনপির। আমরা লক্ষ করেছি, বিএনপি গত নির্বাচনে অংশ না নিয়ে এবং ২০১৫ সালের হরতাল, অবরোধ ও সহিংসতার দায় কাটিয়ে উঠতে বেশ কিছুদিন থেকেই কৌশলে এবং ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে। এমনকি খালেদা জিয়ার কারাদণ্ডের রায় হওয়া সত্ত্বেও কোনো ধরনের সহিংসতা কিংবা সংঘাতে তারা যায়নি। এটি দলের ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হিসেবেই বিবেচনা করা যায়। এই সময়ে দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করাই বিএনপির লক্ষ্য।
এসব অবস্থা বিশ্লেষণে মোটামুটি নিশ্চিত করেই বলা যায়, যেকোনো মূল্যে বিএনপি নির্বাচনে যেতে চায়। তা ছাড়া খালেদা জিয়া নিজে নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে তাঁর রায়ের পরে কোনো ধরনের সহিংসতা কিংবা সংঘাত থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ বিষয়টি থেকেও বুঝতে পারা যায় বিএনপির মূল উদ্দেশ্য নির্বাচনে যাওয়া। আর এ কারণে সব ধরনের সহিংসতা এড়িয়ে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠার যথেষ্ট চেষ্টায় আছে।
খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড হলেও প্রকৃতপক্ষে নির্বাচনের আগে বিএনপির সামনে যথেষ্ট সময় আছে। নিজেদের গুছিয়ে সাধারণ জনগণের সহানুভূতিসহ আগামী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের পর্যাপ্ত সুযোগ পাবে তারা। এ ছাড়া নির্বাচনপূর্ব যদি তেমন কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তাহলে সরকারের মেয়াদের একবারে শেষ ভাগে সর্বাত্মক আন্দোলনে যাওয়ারও সুযোগ রয়েছে। এ প্রেক্ষাপট থেকে বিএনপি দীর্ঘস্থায়ী নেতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। ইতিমধ্যেই সে বিষয়ে সুস্পষ্ট ও ইতিবাচক মনোভাবের ইঙ্গিত দিয়েছে তারা।
খালেদা জিয়া কিংবা বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন কি না কিংবা নির্বাচনে অংশ নিবে কি না, তা নিয়ে নানা আলোচনা ও বিশ্লেষণ রাজনৈতিক অঙ্গনে ঘুরপাক খাচ্ছে। যদিও দুর্নীতি মামলায় জামিন নিয়ে খালেদা জিয়া নির্বাচন করতে পারবেন- এমন খবরটিও প্রকাশিত হয়েছে। আবার আইনমন্ত্রী বলেছেন, আপিল বিভাগে এই রায় চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তার (খালেদা জিয়া) নির্বাচনে অংশ নিতে কোনো বাধা নেই। দলীয় প্রধান কারাগারে যাওয়ায় বিএনপি সাময়িকভাবে বেশ কিছু সংকট ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। অবশ্য বিএনপির জন্য বর্তমান অবস্থা খুবই বড় সংকট মনে হলেও এটি কাটিয়ে উঠতে পারা উচিত বলে মনে করি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে ও পরে রাজনৈতিক নেতাদের কারাগারে নেওয়া হয়েছে। কারাগার থেকে নেতার নির্দেশে দল পরিচালিত হয়। আগে কারাগার থেকে ছোট কাগজে বার্তা লিখে পাঠানোর রীতি ছিল। আর বর্তমানে নানারকম প্রযুক্তি রয়েছে যার মাধ্যমে দলের সিদ্ধান্ত নেতাকর্মীদের জানানোর সুযোগ আছে।
বর্তমান সংকটাবস্থায় অনেকেই মনে করেন, দলে ভাঙন সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু আমি মনে করি, বিএনপির এই সংকটের মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঐক্যের সুযোগও হবে। নিজেদের মধ্যে আলোচনা-মাফিক ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার সুযোগ হবে। দলের অন্যতম লক্ষ্য হবে, ঐক্য বজায় রেখে সঠিকভাবে দল পরিচালনা করে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো অর্থাৎ নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া। পাশাপাশি আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে খালেদা জিয়ার নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং ফল অনুকূলে নেওয়া।
খবরে প্রকাশ পেয়েছে, রায়ের দিন বাংলাদেশে বিদেশি কূটনীতিকদের পাশাপাশি বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর পক্ষ থেকে শান্তিপূর্ণ পথে প্রতিবাদ করার অনুরোধ করা হয়েছিল বিএনপিকে। বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় সহিংসতা কেউ সমর্থন করে না। আর বিএনপির লক্ষ্য যেহেতু সুষ্ঠুভাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়া। ফলে তাদের কোনো সহিংসতার পথ বেছে নেওয়া উচিত হবে না। খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ না নিতে পারলে চ্যালেঞ্জ হতেও পারে, নাও পারে। কারণ এরশাদ কারাবন্দি থাকাকালীন পাঁচটি আসনে জয়লাভ করেন। উল্টো তিনি জনগণের সহানুভূতি পেয়েছেন। তবে দল পরিচালনা, নীতি ও সিদ্ধান্তে ভুল করলে সেটি হবে বিএনপির বড় চ্যালেঞ্জ।
খালেদা জিয়ার রায়-পরবর্তী সহিংসতা না করে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছে। জনগণ এটি পছন্দ করেছে। ২০১৪ ও ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে দুই দফা আন্দোলন ‘সহিংস’ হওয়ায় দেশের ভেতরে ও বাইরে বিএনপি দুর্নাম কুড়িয়েছিল। এবার খালেদা জিয়ার মামলার রায় ঘোষণার দিন দলটি শান্তিপূর্ণ অবস্থানে থেকে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। বিএনপি নেতাদের মতে, রায়কে কেন্দ্র করে সহিংস ঘটনা ঘটুক এবং এর দায় বিএনপির ওপর যাক এমনটিই সরকার ওই দিন চেয়েছে। কিন্তু খালেদা জিয়া এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির কঠোর নির্দেশনায় দলের নেতাকর্মীরা সে পথে পা বাড়ায়নি। বিএনপির রাজনীতি যে নির্বাচনমুখী সেটি যেমন স্পষ্ট, তেমনি তারা নিজেরা সহিংসতার পথ এড়িয়ে জনগণের মনের মণিকোঠায় স্থান করতে চায়, সেটিও স্পষ্ট হতে চলেছে। কাজেই বিএনপি যেমন কৌশল নিয়ে এগিয়ে চলেছে, সরকারকেও এই কৌশল বুঝতে হবে। বিএনপি পরবর্তী ধাপে কী উদ্যোগ গ্রহণ করে সেদিকটা লক্ষ রেখে সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
অন্যদিকে খালেদা জিয়া কারাগারে থাকলেও বিএনপির উচিত হবে ইতিবাচক রাজনীতি ধরে রাখা। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়কেই ভাবতে হবে যে, জনগণকে নিয়ে এবং জনগণের জন্যই রাজনীতি। কাজেই জনগণকে কতটা পক্ষে রেখে রাজনীতির মাঠ জয় করা যায়- সেদিকে লক্ষ রেখে রাজনৈতিক দলগুলোকে এগিয়ে যেতে হবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্রফেশনাল স্টাডিজ