বসন্ত এসে গেছে

জাগুক ফাগুন সকল প্রাণে

Looks like you've blocked notifications!

জবুথবু দিনের শেষে ভেঙে গেল আড়ষ্টতার আড়মোড়া। শিশিরের দিন মিলিয়ে গেল রঙমাখা এক নবপ্রকৃতিতে। বায়ুগন্ধে বিভোল আজ মাধবীবিতান। দখিন বাতাসে মর্মর বেণুবন। নেচে নেচে সুখ জাগাচ্ছে প্রজাপতি। পাখায় ভিখারির বীণা বাজিয়ে মধুপিয়াসী মৌমাছিরা খুঁজে ফিরছে ফুলের দখিনা। ঝরাপাতা জাগিয়ে গেল নতুন সবুজ কিশলয়। কনকলতা, কাঞ্চন ও পারিজাতেরা জুড়িয়ে যায় দৃষ্টি আর ভুলায় এই বিবাগী মন। আমের বনের মাতাল করা ঘ্রাণ কি পাওয়া যাচ্ছে? তবে চাদর মুড়ি দিয়ে আর কেন গুটিসুটি গৃহবাস? দ্বার খুলবার এই তো সময়। দয়িত আর দয়িতার মনে আজ বন্য নেশা। তবে তো আবার এসে গেছে ঋতুরাজ বসন্ত। পয়লা ফাল্গুন আজ। জাগুক ফাগুন সকল প্রাণে। রাবীন্দ্রিক সুর বাজুক সবখানে :

রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোক পলাশে

রাঙা নেশা মেঘে মেশা প্রভাত-আকাশে

নবীন পাতায় লাগে রাঙা হিল্লোল।

দ্বার খোল, দ্বার খোল।

কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বসন্তে ফুল না ফুটবার চিরায়ত দ্বিধার ভেদ ভেঙে বসন্ত ঠিকই পা রেখেছে বাংলাভূমে। ফাগুনের বনও সেজেছে ফুলের সম্ভারে। কোথাও কোনো এক আকুল সখীর হৃদয় কুসুমে অনাদরে বিচ্ছেদের বিয়োগান্তক সুর বেজে যাবে। সেই দুঃখিনীদের নয়নের নীড় সুখীজনেরা না দেখুক না বুঝুক তবু আজ প্রাণজাগানিয়া বসন্ত। এত পাখির গান এত বাঁশির আয়োজন সবই সমর্পিত থাক আগুনঝরা এই ফাগুনে।  

হলুদের কাঁচা রঙে সেজে উঠেছে আজ সকল কচি প্রাণ। নারীর খোঁপায় দুলছে পুষ্পের বিনুনি। বয়সীদের বুড়োকালও হার মেনেছে ফিরে পাওয়া ভালোবাসার বাঁধভাঙা আহ্বানে। ঢাকাবাসী আজ মাতিয়ে রাখবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলা। পুরান ঢাকা বাহাদুর শাহ পার্ক, ধানমণ্ডির রবীন্দ্রসরোবর, উত্তরার উন্মুক্ত মঞ্চ কিংবা হাতিরঝিলে আজ দেখা মিলবে নানারূপী বসন্তবরণীয়াদের। বসন্তকথন, ফুলের প্রতিবন্ধনী বিনিময়, নৃত্য, আবৃত্তি এবং সংগীতের মূর্ছনায় মাতবে বাসন্তীমন। কেবল ঢাকাবাসী নয়, বসন্তের এমন ঐক্যতান সারা দেশবাসীকেই স্পর্শ করবে।

বাঙালিয়ানা আজ এক বড় শক্তি। বাঙালি সাংস্কৃতিক উৎসবে নারী-পুরুষ, জাত-পাত, ধর্ম-বর্ণের ভেদ ভুলে এক মাঙ্গলিক মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেয়। গোঁড়াবাদী ধর্মাচারীরা অবশ্য ধর্মের দোহাই দিয়ে যুগে যুগে বাংলা সংস্কৃতির ওপর প্রতিবন্ধকতা আরোপ করে এসেছে। কিন্তু আপামর জনসাধারণ সে পথে না হেঁটে বাঁচিয়ে রাখছে তাদের হাজার বছরে শিকড়।

বাংলা নববর্ষের সূত্রপাতকারী আদিপুরুষ মোগল সম্রাট আকবর ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দে বর্ষবরণকে সামনে রেখে ১৪টি উৎসবের প্রবর্তন করেন। তার মধ্যে একটি ছিল বসন্ত উৎসব। ১৪০১ সাল থেকে ঢাকায় জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদের আয়োজনে আনুষ্ঠানিকভাবে বসন্ত উৎসব আয়োজন করা হচ্ছে। এর আগে অনানুষ্ঠানিকভাবে হলেও সাড়ে চারশ বছর ধরে আমরা সম্রাট আকবরের ঐতিহ্য বহন করে চলেছি। আজকের দিনে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন বিশেষ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে। রেডিও, টেলিভিশন চ্যানেল বা পত্রিকাগুলোতেও থাকছে বিভিন্ন বাসন্তী স্পেশাল।

ঋতু গবেষকদের মতে, পুরাকালে বসন্ত ও গ্রীষ্ম মিলে চার মাসে একটি ঋতু ছিল। তারপর চার মাস বর্ষা, এরপর চার মাস শীত ঋতু। প্রকৃতির স্বভাব অনুযায়ী বসন্ত ও গ্রীষ্মে উদ্ভিদ-বৃক্ষরাজি নবপত্রে বিকশিত হয়ে পুষ্পসম্ভারে নিজেদের সাজিয়ে নেয়। পাশাপাশি মানুষ ও প্রাণবৈচিত্র্যের চিত্তচাঞ্চল্যও শুরু হয়। বসন্তবন্দনায় তাই আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন :  

এল এ বনান্তে পাগল বসন্ত

বনে বনে মনে মনে রঙ সে ছড়ায়রে                                    

চঞ্চল তরুণ দুরন্ত।

ফেব্রুয়ারিকে অন্তর্নিহিত করে বাংলাদেশ বসন্ত আসে। ফেব্রুয়ারি ভাষার মাস। বিশ্বে আমরা একমাত্র জাতি, যারা ভাষার জন্য লড়াই করে প্রাণের বিনিময়ে মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষা করেছি। এখন ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আর ভাষার মাসের পুরোটা সময় জুড়ে বাংলা একাডেমিকে কেন্দ্র করে বসে বইমেলা। বইমেলা এখন বাঙালি সাংস্কৃতিক উৎসবের শীর্ষ অনুষঙ্গ। বাসন্তী রঙে রাঙানো বইমেলার দর্শনার্থী, ক্রেতা, পাঠক ও লেখকের সম্মীলনী এক অন্য মোহময়তা সৃষ্টি করে। ভিন্নমাত্রার দেশাত্মবোধে উদ্দীপ্ত হয় সবাই। উৎসবের এমন রূপলহরী, সৌন্দর্য ও চেতনা সারা বিশ্বেই বিরল। খুব স্বাবাবিকভাবেই আমাদের কবিরা ভাষা দিবসের বন্দনা গাইতে গিয়ে ফাগুনকে অঙ্গীভূত করেছেন নিজেদের স্বাজাত্যবোধের দায় থেকেই। ভাষার গানে গীতিকবি সৈয়দ শামসুল হুদা যেমনটা বলেছেন :

রক্ত শিমুল তপ্ত পলাশ দিলো ডাক সুনীল ভোরে।

শপথের মশাল হাতে

ছুটে চল নতুন প্রাতে,

বাজা রে অগ্নিবীণা প্রাণে প্রাণে প্রান্তরে।।

একুশের অমোঘ বাণী

দিয়াছে সূর্য আনি...

নিশ্চিতার্থেই বসন্ত আমাদের জাগিয়ে দিয়ে যায় রাঙিয়ে দিয়ে যায় তরুণ হাসির অরুণ রাগে, অশ্রুজলের করুণ রাগে। আমাদের কর্মে ও মর্মে রঙ লাগার নামই তো চাঞ্চল্যময় সুশান্তির বসন্ত। শুধু আমাদের পাষাণগুহার কক্ষে যদি সত্যি নিঝর-ধারা জাগত, আশার নিশার বক্ষে যদি তারারা জাগত পৃথিবী হতো আরও সুন্দর। তবু সকল দীনতা, হীনতা ও জীর্ণতা একপাশে রেখে একে অপরের সাথে যেটুকু ভালোবাসার জালবুনি সেটুকুই আমাদেরকে এগিয়ে রাখছে আগামীর পথে। আমরা গলা খুলেই গাইতে পারছি, সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে/ সার্থক জনম, মা গো, তোমায় ভালোবেসে।

অনাগত দিনে নতুন যারা বাংলাদেশের হাল ধরবে বিশ্বাস করি তারা সকল কুসংস্কার, কূপমুণ্ডকতা ও অন্ধকার দূরীভূত করে আপন ঐতিহ্যের পরশে নিজেদের বোধ ও বিশ্বাসকে জাগিয়ে রাখবে। আমরা আগামীর সেই প্রগতিশীল ও প্রাজ্ঞ পথিকদের জন্যই বসন্তবন্দনা হিসেবে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুর সাজিয়ে রাখলাম :  

রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও  যাও গো এবার যাবার আগে—

দখিন-হাওয়া, জাগো জাগো,  জাগাও আমার সুপ্ত এ প্রাণ।

আমি বেণু, আমার শাখায় নীরব-যে হায় কত-না গান।  জাগো জাগো।

পথের ধারে আমার কারা ওগো পথিক বাঁধনহারা,

নৃত্য তোমার চিত্তে আমার মুক্তিদোলা করে যে দান।  জাগো জাগো।

লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।

০১ ফাল্গুন ১৪২৪