ন্যায়বিচার

‘সাগর-রুনিকে ডাকাতরা খুন করেছে’

Looks like you've blocked notifications!

সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করা যায়নি অথবা করা হয়নি কিংবা হলেও তা প্রকাশ করা হয়নি ছয় বছরেও। কেন? আইনশৃঙ্খলা বাহিনী না পারলেও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাও কি এখানে হার মেনেছে? বছর তিনেক আগে এই প্রশ্নটি করেছিলাম একজন সিনিয়র সাংবাদিককে। তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ধরুন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তদন্তে পেল যে, সাগর-রুনিকে ডাকাতরা খুন করেছে, তাহলে সেটি কি আপনি মানবেন বা তদন্তকারী কর্মকর্তা যদি সেই রিপোর্ট প্রকাশ করেন, দেশের মানুষ কি সেটি মেনে নেবে?

গত ১১ ফেব্রুয়ারি যখন এই সাংবাদিক দম্পতি হত্যার ছয় বছর পূর্ণ হলো এবং সাংবাদিকদের সংগঠন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দেওয়া হলো, তখন ওই সিনিয়র সাংবাদিকের ‘ডাকাত তত্ত্ব’টি আমার মনে পড়ে এবং দিন কয়েক চিন্তা-ভাবনা করার পর এই লেখাটির সিদ্ধান্ত নিই।

সম্প্রতি মেহেরুন রুনির ভাই এবং ওই হত্যা মামলার বাদী নওশের আলম রোমানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ন্যায়বিচারের ব্যাপারে তাঁরা কতটা আশাবাদী? জবাবে তিনি বলেছেন, তাঁরা এখন আর আশাবাদী নন। কারণ ছয় বছর ধরে তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে গাফিলতি এবং রহস্যজনক আচরণ দেখছেন তাতে তাঁদের মনে এই বিশ্বাস জন্মেছে যে, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে এমন প্রভাবশালী কেউ জড়িত । অন্য অনেক বড় ঘটনার রহস্য উদঘাটনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ইতিবাচত তৎপরতা এবং সাফল্য থাকার পরও সাগর-রুনি হত্যা মামলা নিয়ে গড়িমসিতে রুনির পরিবারের ওই বিশ্বাস আরো তীব্র হয়েছে।

প্রথমে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন পুলিশের একজন এসআই। চারদিন পর চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার তদন্তভার হস্তান্তর করা হয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে। দুই মাসেরও বেশি সময় তদন্ত করে ডিবি রহস্য উদ্ঘাটনে ব্যর্থ হলে হাইকোর্টের নির্দেশে ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল হত্যা মামলাটির তদন্তভার দেওয়া হয় র‌্যাবের কাছে। বর্তমানে র‌্যাব সদর দপ্তরের তদন্ত বিভাগের উপরিচালক ও সহকারী পুলিশ সুপার মহিউদ্দিন আহমেদ মামলার তদন্ত করছেন। এখন পর্যন্ত ৫৪ বার সময় নেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ পয়লা ফেব্রুয়ারি আবার সময় চাওয়া হলে আগামী ১৩ মার্চ প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সময় দিয়েছেন আদালত।

প্রশ্ন হলো, কেন এই হত্যার রহস্য জানা যাচ্ছে না? নাকি এমন কিছু জানা গেছে যা প্রকাশ করা বিব্রতকর অথবা যা প্রকাশিত হলে অনেক কথিত ভালো মানুষের মুখোশ খুলে যাবে? নাকি ওই সিনিয়র সাংবাদিকের ডাকাত তত্ত্বই সঠিক?

বাস্তবতা হলো, সাংবাদিক দম্পতি খুনের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর ঘটনার তদন্ত করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জের। কিন্তু এ পর্যন্ত যে আটজনকে (মিন্টু, কামরুল হাসান, বকুল মিয়া, রফিকুল ইসলাম আবু সাঈদ,এনাম আহম্মেদ,পলাশ রুদ্র পাল ও তানভীর রহমান) গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তাঁদের মধ্যে দুজন (পলাশ রুদ্র পাল ও তানভীর রহমান) জামিনে আছেন। বাকি ছয়জন এখনো কারাগারে। যদি ওই ছয়জন আসলেই এই ঘটনার সাথে জড়িত থাকেন, তাহলে তাঁদের কাছ থেকে কিছুই কি জানা যায়নি?  যদি জানা যায় তাহলে সেটি প্রকাশ করা হচ্ছে না কেন? আর যদি কারাগারে থাকা ওই ব্যক্তিরা নিরপরাধ হন, তাহলে তাঁদের জীবন থেকে এই সময়গুলো কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, তাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবন যে ধ্বংস করা হচ্ছে, তার ক্ষতিপূরণ কে দেবে? সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, সাগর-রুনি হত্যার ঘটনায় ছয় বছরেও তদন্ত শেষ করতে না পারার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো ব্যর্থতা নয়। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, ব্যর্থতা কার?

২০১২ সালে যখন রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে ওই নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটে, তখন সাগর-রুনির একমাত্র ছেলে মেঘের বয়স ছিল সাড়ে পাঁচ বছর। এখন সে সাড়ে ১১ বছরের। স্কুলে যাচ্ছে। আর দশজন শিশুর মতো মাঠে গিয়ে বন্ধুদের সাথে খেলছে। ঘটনার সময় কিছু বুঝতে না পারলেও এখন সে বোঝে এবং জেনে গেছে যে, তার মা-বাবাকে নির্মমভাবে খুন করা হয়েছে। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে হত্যাকারীদের শনাক্ত করতে না পারা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত না হওয়ায় এই ছোট্ট শিশুটিও হতাশ। তার মামা রোমান আমাকে বলেছেন, আগে প্রতি বছর সাগর-রুনির মৃত্যুবার্ষিকীতে সাংবাদিকরা বাসায় আসতেন। তাদের সাথে আমরা কথা বলতাম। মেঘও বলত। কিন্তু এখন সে আর এ বিষয়ে কথা বলতে আগ্রহী না। সে বলে, এসব বললে কি বাবাকে ফিরে পাব?

গাজীপুরে মেয়ে আয়েশা আক্তারের শ্লীলতাহানির বিচার না পেয়ে মেয়েকে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন হযরত আলী। যে ক্ষোভ ও হতাশা থেকে তিনি মৃত্যুর মতো পথ বেছে নিয়ে এই পৃথিবীকে, এই রাষ্ট্রকে, এই সমাজকে বলে গিয়েছিলেন, তোমরা ন্যায়বিচারে ব্যর্থ, তোমাদের কাছে বিচার চাই না; মেঘের মতো ছোট্ট যে শিশু বলে, এসব বলে কী লাভ কিংবা নাটোরে যখন ধর্ষিতা মেয়েকে নিয়ে বিচার দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেন বাবা; জাগৃতি প্রকাশনীর সত্ত্বাধিকারী ফয়সল আরেফীন দীপনের বাবা অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক যখন নিজের সন্তানের লাশের পাশে দাঁড়িয়ে বলেন, বিচার চাই না––সেই ক্ষোভ, সেই অভিমান, সেই ঘৃণা যদি আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র না বোঝে––সেটি অত্যন্ত বেদনার।

লেখক : সাংবাদিক