প্রতিক্রিয়া
বাঙালি জাতির মাথায় হামলা কি চলতেই থাকবে?
হঠাৎ কোনো ঘটনা ঘটলে আমরা অবাক হই। পরক্ষণেই প্রতিবাদ জানাই, নিন্দা জানাই; কিন্তু ঘুরেফিরে আবার ঘটে একই ঘটনা। প্রতিনিয়তই বাংলাদেশে শিক্ষক হত্যা, লাঞ্ছনা, নির্যাতন-নিপীড়ন প্রভৃতি ঘটেই চলেছে। এমন সব পাশবিক কার্যক্রম বন্ধ হচ্ছে না, কারণ আমাদের বিবেক জাগ্রত হচ্ছে না। বিশিষ্ট লেখক শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল হামলার শিকার হয়েছেন।
এই হামলার আঘাতটি তাঁর মাথায় লাগলেও প্রকৃতপক্ষে লেগেছে গোটা বাঙালি জাতির মাথায়। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, জাতির বিবেক—এ প্রশ্নটিই আমাদের সামনে কেন নেই? মুক্তচিন্তার অধিকারী একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং জাতির বিবেক হিসেবে তাঁর ওপর এই নির্মম হামলার দায় কি আমাদের গোটা জাতির নয়?
এখন আমরা নিজেদের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি না যে আমরা মানুষ কি না। প্রায়ই আমরা যেসব বর্বর হামলা কিংবা হত্যাকাণ্ডের খবর শুনি, সেগুলো কোনোভাবেই কি মানুষের দ্বারা করা সম্ভব? কিন্তু সেগুলো মানুষরূপী হায়েনারাই করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমরা কাদের আঘাত করছি, কেন করছি সেটি কখনো ভেবে দেখছি না। মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষক এবং মুক্তচিন্তার মানুষগুলোকে হামলা করার আগে একটুও কি আমাদের বিবেক দংশিত হয় না? হয়তো বা বিবেকই নেই। তাই জাতির বিবেককে হত্যার লক্ষ্য নির্ধারণ করা খুব সহজ একটি বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
এর আগে বাংলাদেশে বহু লোমহর্ষক পৈশাচিক হামলার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু কয়টি হামলার বিচার হয়েছে? আমরা কি একবারও কোনো বর্বর অপরাধের কঠিন শাস্তির নমুনা দেখেছি? হয়তো বা শাস্তি হয়েছে। কিন্তু এমন একসময়ে শাস্তি হয়েছে, যখন জনসাধারণ ওই অপরাধ এবং অপরাধের বর্বরতার মাত্রা ভুলে যায়। ফলে সচেতনতার উপলব্ধি আর যথাযথভাবে কাজ করে না।
আমাদের দেশে মুক্তবুদ্ধির চর্চার পরিবেশ-পরিস্থিতি নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে যথেষ্ট বিতর্ক তৈরি হয়েছে। কিন্তু এর প্রতিকারের যথাযথ কোনো উদ্যোগ নেই। গত কয়েক দশকে মুক্তচিন্তার মানুষগুলোকে হত্যা কিংবা হামলার ঘটনা এতটাই হয়েছে যে সেটি স্বাধীন জাতির জন্য লজ্জাজনক। রাজনৈতিক আধিপত্যের লড়াইয়ে এবং পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়িতে যখন গোটা জাতি মেতে উঠেছে, ঠিক সেই সময়ে প্রায়ই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা হামলা এবং হত্যার শিকার হচ্ছেন মুক্তবুদ্ধি চর্চার অজুহাতে। কঠোরভাবে এমন প্রবণতা বন্ধ করতে না পারলে তা ক্রমাগত বাড়তেই থাকবে।
কোনো শিক্ষককে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করার মতো জঘন্য কাজ আর দ্বিতীয়টি হতে পারে না। আজ কোনো শিক্ষক তাঁর মুক্তচিন্তার ক্ষেত্রে যদি নিরাপত্তা না পান, তাহলে আগামী দিনের যাত্রায় জাতিকে চরম মাশুল দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে যত দ্রুত সম্ভব স্থায়ী সমাধানের পথ খোঁজা আমাদেরই দায়িত্ব।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্রফেশনাল স্টাডিজ।