আন্তর্জাতিক নারী দিবস

নারীর ক্ষমতায়ন ভাবনা

Looks like you've blocked notifications!

আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘সময় এখন নারীর : উন্নয়নে তারা বদলে যাচ্ছে গ্রাম-শহরের কর্ম-জীবনধারা’। গত বছরের প্রতিপাদ্য ছিল ‘নারী-পুরুষ সমতায় উন্নয়নের যাত্রা, বদলে যাবে বিশ্ব কর্মে নতুন মাত্রা’। নারীর জীবনের সঙ্গে এই যে উন্নয়নের ধারণা সম্পৃক্ত করা হয়েছে, তা তার ক্ষমতায়নের নির্দেশকও বটে। বিশেষত, নারীর প্রতি যে সহিংসতা এবং অমানবিক আচরণ এখনো বিশ্বব্যাপী বর্তমান, তাতে তার সমান অধিকার, সমান সুযোগ আর অগ্রগতি নিয়ে আমরা চিন্তিত।  

এরই মধ্যে সকলে একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছেন যে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে নারীর সমান অংশগ্রহণ জরুরি। অন্যদিকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের সমাপ্তি ঘটিয়ে গ্রামীণ ও শহুরে নারীদের ক্ষমতায়ন অর্জন অন্যতম ইস্যু। কিছুদিন আগেও সকলে মতামত দিয়েছেন যে, নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার এখনই সময়। অথচ ৬ মার্চ সকল জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে ঢাকার গণপরিবহনে ৯৪ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার হন। যখন নারীর সমান অধিকার সকলের অগ্রগতির নিশ্চয়তা নিয়ে কথা বলছি, তখন এ ধরনের তথ্য আমাদের মানসিক যাতনাকে বাড়িয়ে দিয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত করছে সামাজিক জীবন। আসলে নারীর ক্ষমতায়ন ও মানবতার উন্নয়ন পরস্পর সম্পৃক্ত। অধিকার মর্যাদায় নারী-পুরুষ যেমন সমানে সমান।

২.

আন্তর্জাতিক নারী দিবসটি বিশ্বব্যাপী নারীরা গুরুত্বের সঙ্গে উদযাপন করে থাকেন। দিবসটি উপলক্ষে নারীর প্রতি সাধারণ মানুষের সম্মান ও শ্রদ্ধা উদযাপনের মুখ্য বিষয় হয়ে থাকে, আবার কোথাও নারীদের আর্থিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠা বেশি গুরুত্ব পায়। ইতিহাস গ্রন্থ এবং ইন্টারনেট সূত্রে আমরা জেনেছি দিবসটি উদযাপনের পেছনে রয়েছে নারী শ্রমিকের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাস। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মজুরিবৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিলেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকরা। সেই মিছিলে চলে সরকার লেঠেল বাহিনীর দমন-পীড়ন। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত নারী সমাবেশে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন হয়। ক্লারা ছিলেন জার্মান রাজনীতিবিদ; জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির স্থপতিদের একজন। এরপর ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি এতে যোগ দিয়েছিলেন।

এ সম্মেলনে ক্লারা প্রতিবছর ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন। সিদ্ধান্ত হয় ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে নারীদের সমঅধিকার দিবস হিসেবে দিনটি পালিত হবে। দিবসটি পালনে এগিয়ে আসে বিভিন্ন দেশের সমাজতন্ত্রীরা। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে বেশ কয়েকটি দেশে ৮ মার্চ পালিত হতে লাগল। বাংলাদেশেও ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা লাভের পূর্ব থেকেই এই দিবসটি পালিত হতে শুরু করে। অতঃপর ১৯৭৫ সালে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। দিবসটি পালনের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রকে আহ্বান জানায় জাতিসংঘ। এর পর থেকে পৃথিবীজুড়েই পালিত হচ্ছে দিনটি নারীর সমঅধিকার আদায়ের প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করার অভীপ্সা নিয়ে।

৩.

আমি দিবসটি উপলক্ষে নারী ক্ষমতায়ন নিয়ে কথা বলছি। ক্ষমতায়নের ধারণা পুরুষের জন্য এক রকম, নারীর জন্য অন্য রকম। নারীর ক্ষমতায়ন সমতাভিত্তিক সমাজব্যবস্থার প্রধান দিক। তবে এ কথা সত্য, নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে দেশের সর্বত্র। আমি নিজে যে সরকারি অফিসে কাজ করি, সেখানে নারী কর্মকর্তার সংখ্যা অনেক। তারা সকলেই মেধা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি চাকরিতে এসেছেন। কিন্তু আমরা সকলে কি নিজ জীবন কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করব, তা নিজে ঠিক করতে পারি? পেশাগত দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জন করেছি আমরা। কিন্তু আমাদের ভেতরে আত্মবিশ্বাস দৃঢ় করতে পেরেছি কি? যার দ্বারা আমি আমার সমস্যা সমাধান করতে পারছি। পরমুখাপেক্ষী না হয়ে স্বনির্ভর হয়ে থাকতে পারছি কি?

এভাবে নারী হিসেবে যখন জীবনে মতামত গ্রহণে ক্ষমতার অধিকারী হই, তখন মনে করা হবে আমার ক্ষমতায়ন হয়েছে। সূত্র অনুযায়ী, ক্ষমতায়ন কার্যকর করার জন্য তিনটি পর্যায়কে বিবেচনা করা হয়। যেমন ব্যক্তিগত। এ পর্যায়ে বিবেচিত হয় ব্যক্তির আত্মবিশ্বাস ও সামর্থ্যের ধারণা। অন্যটি সম্পর্ক। এ পর্যায়ে দেখা হয়, ব্যক্তির সম্পর্কযুক্ত ক্ষমতার সামর্থ্য। অর্থাৎ ব্যক্তি কতটা মধ্যস্থতাকারী ও অন্যের ওপর প্রভাব বিস্তারে কতটা সমর্থ। তৃতীয়টি সামষ্টিক। এ পর্যায়ে বিবেচিত হয় একসঙ্গে কাজ করার দক্ষতা। অর্থাৎ বড় আকারে প্রভাব বিস্তার ও তার ফল লাভের জন্য একসঙ্গে সক্রিয় থাকার সামর্থ্য। এ ক্ষেত্রগুলো বিবেচনা করে নির্ধারিত করা যায় ক্ষমতায়নের মাত্রা। এ ক্ষমতা অর্জন পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। এর সঙ্গে বেঁচে থাকার নানা ব্যবস্থা গভীরভাবে জড়িত। বিশেষ করে আমাদের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরো জটিল। নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে কি-না তা বুঝতে হলে দেখতে হয় সম্পদের ওপর আমার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কি-না। সম্পদ নিয়ন্ত্রণে আমি সক্ষম কি-না, অর্থাৎ নারী নিজে সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করছে কি-না। বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফল আমি পাচ্ছি কি-না। অর্থাৎ আমি সরাসরিভাবে উন্নয়নের সুফলভোগী কি-না।

বাংলাদেশে নারীর অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারক মহলের অবদান আছে। ফলে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, সামাজিক ক্ষমতায়ন ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ঘটেছে নারীর জীবনে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ, বাস্তবায়ন, নিয়ন্ত্রণ এবং সমতার ভিত্তিতে সুফল ভোগে নারীর পূর্ণ মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ দেশে রাজনীতি চর্চায় নারীর পূর্ণ অংশগ্রহণ। ভোট প্রদান, নির্বাচনে অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক দলে সমতার জায়গা অর্জন নিশ্চিত রয়েছে। তবে আমাদের জাতীয় সংসদে মোট নারী আসন ৫০টি। কিন্তু ৩০০ আসনের মধ্যে অর্ধেক আসন নারী আসন হওয়া বাঞ্ছনীয়। সামাজিক জীবনে এসেছে চলাচলে স্বাধীনতা। অবশ্য নারীর ক্ষমতায়নের পাশাপাশি বিকাশ ঘটা দরকার নারীর শুভ চেতনা। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি না হলে ক্ষমতায়নের অপব্যবহার ঘটে। সেটি যথেচ্ছাচারেও চলে যায়। এ জন্য নারীর জীবনকে মননশীল করা দরকার, পুরুষের দ্বারা কিংবা পুরুষের পছন্দ দিয়ে সে পরিচালিত হবে না যেমন, তেমনি আবার সর্বাংশে স্বৈরমনোভাবেও জীবন চালাবে না। যদিও কবি লিখেছেন, ‘নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার/ কেন নাহি দিবে অধিকার/হে বিধাতা? নত করি মাথা পথ প্রান্তে কেন রব জাগি/ দৈবাগত দিনে। শূন্যে চেয়ে রব? কেন নিজে নাহি লব চিনে/ সার্থকের পথ।’(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

৪.

আমরা এগিয়ে চলেছি আমাদের দেশের পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় বিধিনিষেধের পাহাড় ডিঙিয়ে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বৈষম্যের চরম শিকার হয়ে একজন নারীকে সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে হয়। কর্মক্ষেত্রে পুরুষের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে নতুনভাবে সংগ্রাম ও বৈষম্যের শিকার হতে হয়। উচ্চশিক্ষিত হয়েও নিজেকে জাতীয় কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত করতে কী পরিমাণ বাধা বিপত্তি পেরিয়ে আসতে হয়, তা একমাত্র আমরাই জানি। অথচ জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) ২০১৬ সালের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের মতে, ভারত ও পাকিস্তানের নারীদের চাইতে বাংলাদেশের নারীদের আয় বেশি। ক্রয়ক্ষমতা অনুসারে (পিপিপি) বাংলাদেশের নারীদের গড় আয় বছরে দুই হাজার ৩৭৯ ডলার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী দেশের পাঁচ কোটি ৪১ লাখ কর্মজীবীর মধ্যে এক কোটি ৬২ লাখ নারী। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের মধ্যে নারীর সংখ্যা ১৬ হাজার ৬৯৭ জন।

নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে, গড় আয়ু, শিশু মৃত্যুর হার নিয়ন্ত্রণ, জন্মনিয়ন্ত্রণ, স্যানিটেশন, শিক্ষা সুবিধা এবং নারীশিক্ষায় বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে এগিয়ে আছে। তার পেছনে রয়েছে নারীর অগ্রগণ্য ভূমিকা। বাংলাদেশের সংবিধানে নারীর যথাযোগ্য অবস্থান নিশ্চিত করা হয়েছে। সংবিধানে নারীর অধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা রক্ষা করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ধারা সন্নিবেশ করা হয়েছে। ১৯ অনুচ্ছেদে বর্ণনা হয়েছে, ‘জাতীয় জীবনে সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবে।’ ২৭ নম্বর ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ এ ছাড়া ২৮(১), ২৮(২), ২৮(৩), ২৮(৪), ২৯(১) ও ২৯(২) ধারায় নারী পুরুষ, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের সমান অধিকারের বিধান রয়েছে। ৬৫(৩) ধারায় নারীর জন্য জাতীয় সংসদে আসন সংরক্ষিত আছে এবং এ ধারার অধীনে নারী স্থানীয় শাসনসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলোয় প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে। সাংবিধানিক এই অধিকারের কারণে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। বর্তমানে স্পিকার হিসেবে নারীর যোগ্যতার প্রমাণ রয়েছে। নারীর ক্ষমতায়নে অবস্থান রাখায় যুক্তরাষ্ট্রের সাময়িকী ‘গ্ল্যামার’-এর বিচারে বর্ষসেরা নারী মনোনীত হয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অর্থাৎ নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সারা বিশ্বের অনুকরণীয় ও ঈর্ষণীয় দৃষ্টান্ত।

৫.

আন্তর্জাতিক নারী দিবসে নারীর ক্ষমতায়ন ভাবনায় আমি এটুকু বলতে চাই যে, নারীদের অগ্রগতি, উন্নয়ন ক্ষমতায়নের সঙ্গে যুক্ত। এ জন্য আমাদের উন্নয়নে সদর্থক অর্থনৈতিক ও সামাজিক নীতি গ্রহণ করতে হবে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নাগরিক সমস্ত ক্ষেত্রে প্রকৃত ও বিধিসম্মতভাবে নারীরা যাতে পুরুষদের সঙ্গে সমান মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা ভোগ করেন, তার ব্যবস্থা করা জরুরি। নারীদের প্রতি সব রকমের সামাজিক বৈষম্য দূর করার জন্য আইনি ব্যবস্থাকে আরো জোরদার করা দরকার। অর্থাৎ উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় জেন্ডার সচেতনতাকে প্রাধান্য দিতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা যেন আমাদের সব উন্নয়নের পথে বাধার কারণ না হয়, সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের দেশে নারী উন্নয়নে সরকারের পাশাপাশি প্রধান ভূমিকা রেখেছে নারী সংগঠন, এনজিওগুলো ও গণমাধ্যম। আশা করি, সকলের তৎপরতায় আমরা নিজের জীবন সুন্দর করে গড়ে তুলতে সক্ষম হবো। একই সঙ্গে দেশের উন্নয়নে নিজের মেধাকে কাজে লাগাতে পারব।

লেখক : সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা, সিলেট।