কাঠমান্ডু ট্র্যাজেডি

খোঁজা হোক দুর্ঘটনার কারণ

Looks like you've blocked notifications!

বাংলাদেশের স্মরণকালের ইতিহাসে ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনায় নেপাল ও আমাদের দেশের অনেক সম্ভাবনাময় তরুণ প্রজন্মকে আমরা হারিয়ে ফেললাম। কারো ভুল বার্তা বা গাফিলতির কারণে এমন বিপর্যয় ঘটল কি না, তা হয়তো একদিন উদঘাটিত হবে। উদঘাটিত সেই তথ্য দিয়ে ভবিষ্যতে এয়ারলাইন্স-সংশ্লিষ্টরা অধিকতর নিরাপত্তাব্যবস্থাও হয়তো শিখতে পারবেন; কিন্তু চিরতরে হারিয়ে ফেলা মেধাবী মানুষদের আমরা আর কোনোদিনই ফিরে পাব না। নিহতের পরিবারও খুঁজে পাবে না কোনো সান্ত্বনা। মৃত্যুকে আষ্টেপৃষ্ঠে বয়ে বেড়ানো জীবনের নিয়তিই এমন যে কখন কোথায় তার গন্তব্য নিশ্চিত হবে, আমরা কেউ তা জানি না।

সোমবার বাংলাদেশের বেসরকারি বিমানসেবা সংস্থা ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের প্লেন দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেন অর্ধশত যাত্রী। গুরুতর জখম হয়েও জীবন নিয়ে ফিরতে পেরেছেন অপর ২২ জন। তাঁদের মধ্যে নয়জন বাংলাদেশি বলে জানিয়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ওই উড়োজাহাজটিতে মোট ৭১ আরোহী ছিলেন। এর মধ্যে ৬৭ জন যাত্রী ও চারজন ক্রু। যাত্রীদের মধ্যে ৩২ জন বাংলাদেশি, ৩৩ নেপালি এবং একজন চীন ও একজন মালদ্বীপের নাগরিক।

চতুর্থ বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষা শেষে ছুটিতে ওই ফ্লাইটে দেশে ফিরছিলেন সিলেটের জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজের ১৩ নেপালি শিক্ষার্থী। কিন্তু নিজের জন্মভূমি স্পর্শ করার পরই মুখোমুখি হলেন এক ভয়াল ট্র্যাজেডির। ওই প্লেনে দুই শিশুসহ আরো ছিলেন বাংলাদেশের সাংবাদিক, সরকারি কর্মকর্তা এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাওয়া ফটোগ্রাফার।

পাহাড়-পর্বত ঘেরা নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পৃথিবীর ব্যস্ততম বিমানবন্দরের একটি। বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু পর্বতমালা হিমালয়ের টানে লাখো পর্যটক বছরব্যাপী নেপাল ভ্রমণ করে থাকেন। নেপালের মায়াময় পাহাড়ি সৌন্দর্য পর্যটকদের কাছে বরাবরই বড় আকর্ষণ। অর্থনৈতিকভাবে অনুন্নত রাষ্ট্র নেপালের আয়ের অন্যতম বড় উৎসই পর্যটন খাত। অথচ সে দেশের বিমানবন্দরগুলো বরাবরই বয়ে বেড়াচ্ছে মানহীনতার অভিশাপ।  

সোমবারের দুর্ঘটনার পর বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, ত্রিভুবন হচ্ছে নেপালের একমাত্র ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। এর ব্যবস্থাপনা অপর্যাপ্ত ও দুর্বল। ২০১৬ সালের প্রথম দিকে ওই এয়ারপোর্টে একটি টুইন অটার টার্বোপ্রোপ উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হলে এর ২৩ যাত্রীর সবাই প্রাণ হারান।

অন্যদিকে বিবিসি বলছে, বিমানবন্দরটিতে আন্তর্জাতিক বিমান অবতরণের পর থেকে এ পর্যন্ত ৭০টির বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে। বলা হচ্ছে, এসব দুর্ঘটনায় ৬৫০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। বিমানের পাশাপাশি সেখানে হেলিকপ্টারও বিধ্বস্ত হয়েছে।

সবচেয়ে ভয়ংকর তথ্য হলো, এই আধুনিক প্রযুক্তির যুগেও ওই এয়ারপোর্টটিতে এখন পর্যন্ত অটোমেটিক ল্যান্ডিং সিস্টেম নেই। যুগোপযোগী রাডার ব্যবস্থাও নেই। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে চার হাজার ৪০০ ফুট উচ্চতায় পর্বতমালা ঘেরা বিমানবন্দরটিকে মাঝেমধ্যেই কুয়াশা ঘিরে ফেলে। বাতাসের গতিবেগও হঠাৎ বিমানের স্বাভাবিক ওঠানামায় বিপত্তি সৃষ্টি করে। উচ্চ পাহাড়-পর্বতের বাধা থাকায় সব সময় পাইলটদের তীক্ষ্ণ মেধা খাটিয়ে জটিল অঙ্ক কষে প্লেন উড্ডয়ন ও অবতরণ করাতে হয়। এরপরও বিমান সংস্থা বা পাইলটরা মারাত্মক ঝুঁকি নিয়েই এই রুটে বিমান পরিচালনা করেন। বিপুলসংখ্যক পর্যটকের বাজার ধরে বিমান সংস্থাকে লাভজনক করতে এ ছাড়া তাদের গত্যন্তরও নেই। তারপরও বাংলাদেশি পাইলটরা এর আগে এতটা বিপাকে আর কোনোদিন পড়েননি।

এই এয়ারপোর্টে আগে বাংলাদেশি পাইলটরা পুরোনো ফকার মডেলের বিমান নিয়েও কোনোদিন দুর্বিপাকে পড়েননি। কিন্তু এবার আধুনিক বোয়িং বিমানও দুর্ঘটনায় নিপতিত হলো। দুর্ঘটনার পরই নেপাল এভিয়েশন বা ত্রিভুবন এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ ও ইউএস-বাংলা ম্যানেজমেন্ট পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশি বিমান সংস্থা বলছে, ত্রিভুবন কর্তৃপক্ষ বিমান অবতরণে পাইলটকে উপযুক্ত নির্দেশনা দিতে পারেনি। তাই পাইলটের ভুলে এমন দুর্ঘটনা ঘটেনি। অন্যদিকে ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মহাব্যবস্থাপক রাজ কুমার ছেত্রি বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছেন ভিন্ন তথ্য।

রাজ কুমার ছেত্রি বলেছেন, বিমানবন্দরে নামার অনুমতি পাওয়ার পর উড়োজাহাজটির পাইলট বলেন, তিনি উত্তর দিকে অবতরণ করতে চান। তখন কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে জানতে চাওয়া হয়, কোনো সমস্যা আছে কি না। এর জবাবে পাইলট জানিয়েছিলেন, কোনো সমস্যা নেই। অবতরণের আগে দুবার আকাশে চক্কর দেয় উড়োজাহাজটি। আবার নিয়ন্ত্রণ টাওয়ার থেকে জানতে চাওয়া হয়, সবকিছু কি ঠিক আছে? জবাবে পাইলট জানান, ঠিক আছে। এরপর অবতরণে অসংগতি দেখে নিয়ন্ত্রণ টাওয়ার থেকে পাইলটকে জানিয়ে দেওয়া হয়, উড়োজাহাজটি ঠিকভাবে অবতরণ করছে না। কিন্তু এ কথার কোনো জবাব পাইলটের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। এরপর নিয়ন্ত্রণ টাওয়ার থেকে পাইলটের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। অবতরণের সময় যথাযথ নির্দেশনায় থাকা উচিত ছিল উড়োজাহাজটির। কিন্তু উড়োজাহাজটি কোনো কারণে ওই নির্দেশনায় ছিল না। একপর্যায়ে উড়োজাহাজটি মাটিতে আছড়ে পড়ে ও সঙ্গে সঙ্গে আগুন ধরে যায়। সোমবার দুর্ঘটনার পরপরই বিমানটির কো-পাইলট পৃথুলা রশিদ ও ক্রু খাজা হোসেন মারা যান। পরদিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় চলে গেলেন প্রধান পাইলট আবিদ সুলতান।

বিমান ওঠানামার মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে ভুল বোঝাবুঝির এতটুকু অবকাশ নেই। এই যুগে এসেও একটি আন্তর্জাতিকমানের ব্যস্ত বিমানবন্দরে অটোমেটিক ল্যান্ডিং সিস্টেম বা সর্বাধুনিক রাডার ব্যবস্থা থাকবে না—এটা অবিশ্বাস্যই ঠেকে। অন্যদিকে অভিজ্ঞ পাইলট কেন ল্যান্ডিং স্টেশনের কমান্ড মানবেন না, তাও বোধগম্য নয়। ভবিষ্যতে তদন্ত সাপেক্ষে প্রশ্নবিদ্ধ এই বিষয়গুলো হয়তো নিষ্পত্তি হবে।

আমরা অতীত অভিজ্ঞতা থেকে জানি, বিশ্বের বড় বড় বিমান সংস্থার বিমানও যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিধ্বস্ত হয়। সম্প্রতি রাশিয়াতেও প্লেন বিধ্বস্তের ঘটনায় ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এমনকি ২০১৪ সালের ৮ মার্চ আকাশ থেকে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের যাত্রীসহ একটি আধুনিক বোয়িং বিমানের হদিস এখনো মেলেনি। কিন্তু ত্রিভুবন এয়ারপোর্টের মতো বিমান ল্যান্ডিং করাকালীন এমন দুর্ঘটনা মেনে নেওয়াটা বড় বেশি বেদনার। 

এমনিতেই বাংলাদেশি বিমান সেবা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ‘বি’ ক্যাটাগরির। যে কারণে আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফ্লাইট পরিচালনায়ও অযোগ্য হয়ে আছি। আমাদের এভিয়েশন অথরিটির বিমান মেইনটেন্যান্স ব্যবস্থার দুর্বলতাও সর্বজনবিদিত। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রীয় যে বিমানে ভ্রমণ করেন, তার নাটবল্টুও ঠিক অবস্থায় পাওয়া যায় না। এমন একটা অবস্থার মধ্যে বাংলাদেশি বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা ‘বোঝার ওপর শাকের আঁটি’ই বটে।

একদিকে বিপুল প্রাণহানির বোঝা বয়ে বেড়াতে হবে। অন্যদিকে এয়ারলাইন্স পরিচালনার বদনাম। আমরা সত্যি জানি না, এতটা বিপর্যয় কীভাবে সামাল দেবো। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করে নেপালের প্রধানমন্ত্রীকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সকল সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন। বিপর্যয়ের প্রতি একাত্ম হয়ে চলমান সিঙ্গাপুর সফর সংক্ষিপ্তও করেছেন। এবার যদি বাংলাদেশের উড়োজাহাজ সেবার মানোন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী মনোযোগী হন, আমরা বেশি খুশি হব।

নেপালে বিমান দুর্ঘটনায় নিহতদের প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা ও শোকস্তব্ধ পরিবার-পরিজনের প্রতি সমবেদনা। সবার সমন্বিত প্রচেষ্টায় অধিকতর সুরক্ষিত হোক আমাদের ভবিষ্যৎ।

 

লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।