আন্তর্জাতিক

কাতালান পরিস্থিতির সমাধান কি আইনি লড়াইয়ে?

Looks like you've blocked notifications!

আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে কাতালানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। সম্প্রতি ফিনল্যান্ড থেকে পালিয়ে বেলজিয়াম ফেরার পথে ডেনমার্ক সীমান্তের কাছাকাছি জার্মান পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন কাতালান নেতা কার্লেস পুজদেমন। স্পেনের আদালতে বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলে ৩০ বছর কারাদণ্ড হতে পারে তার।

২০১৭ সালের অক্টোবরে স্পেনের স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ কাতালোনিয়ার পার্লামেন্ট স্পেন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেদের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকেই কেন্দ্রীয় সরকারের গ্রেপ্তারের হুমকির মুখে বেলজিয়ামে স্বেচ্ছা নির্বাসনে ছিলেন পুজদেমন।

এদিকে, সবশেষ প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী জর্দি তুরুল সম্প্রতি পুলিশের হাতে আটকের পর থেকে নতুন কোনো প্রার্থীর নাম ঘোষণায় অস্বীকৃতি জানিয়েছে বিক্ষুব্ধ স্বাধীনতাপন্থী নেতারা। এর আগে স্পেনের আদালত কাতালোনিয়ার বিদ্রোহী ২৫ নেতাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর আদেশের পর পরই পুলিশের সাথে সংঘর্ষে জড়ায় বিদ্রোহীরা।

এর আগে তুরুলসহ স্বাধীনতাপন্থী পাঁচ নেতাকে আটকের আদেশ দেন মাদ্রিদের সুপ্রিম কোর্ট। অন্যরা হলেন কাতালোনিয়ার সাবেক উন্নয়নমন্ত্রী জোসেফ রাল, আঞ্চলিক পার্লামেন্টের সাবেক স্পিকার কারমে ফোরকাদেল, কাতালোনিয়ার সাবেক পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রধান রাউল রোমেভা ও সাবেক শ্রমমন্ত্রী ডলরস বাসা।

আদালতের ওই আদেশকে বিবেচনা করা হচ্ছে কাতালানের স্বাধীনতা আন্দোলনের ওপর এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের সবচেয়ে বড় আঘাত। আদালতের এসব নির্দেশনার পর বিদ্রোহীপন্থী নেতৃত্বের পুরোটাকেই এখন আইনি লড়াইয়ে নামতে হবে মাদ্রিদ সরকারের বিরুদ্ধে।

উল্লেখ করা প্রয়োজন, গণভোটে স্বাধীনতার পক্ষে রায় আসার পর পরই কাতালান সরকারকে বরখাস্ত করে মাদ্রিদের কেন্দ্রীয় সরকার। এরপর সরাসরি কেন্দ্রীয় শাসন জারি করা হয় সেখানে, নতুন নির্বাচনের আহ্বান জানান স্পেনের প্রেসিডেন্ট। তবে স্বল্প ব্যবধানে সে নির্বাচনে বিজয়ী হিসেবে আবির্ভূত হয় কাতালোনিয়ার স্বাধীনতাপন্থীরা।

দৃষ্টি ফেরাতে চাই ১৯৩১-এর দিকে। যখন কাতালান পায় স্বায়ত্তশাসন। তখন সেই আঞ্চলিক সরকারের নাম ছিল জেনেলালিট্যাট। ১৯৩৯ থেকে ১৯৭৫। স্বৈরশাসক জেনারেল ফ্রাঙ্কোর শাসনে স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা হারায় কাতালান। ওই সময় কারাদণ্ঢ ও নির্বাসিত করা হয় কয়েক হাজার কাতালান সমর্থককে। ফ্রাঙ্কোর মৃত্যুর পর ১৯৭৭ সালে জেনেলালিট্যাট নামে কাতালোনিয়ার আঞ্চলিক সরকারের পুনরুত্থান ঘটে।

বর্তমান পরিস্থিতিতেও স্বাধীনতাপন্থীদের বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। গ্রেপ্তার আতঙ্ক সাথে নিয়ে আন্দোলনের নতুন কৌশল কী হবে সেটি নিয়ে নিশ্চয়ই আলোচনা অব্যাহত রেখেছেন স্বাধীনতাপন্থীরা।

গণভোট, আদালতের মুখোমুখি হওয়া আর বরখাস্তের মতো ঘটনাগুলো যেন কাতালান নেতাদের পিছ্ ছাড়ছেই না। তবে স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদন করতে পিছপা হবেন না কাতালান নেতারা, এমনটি ধারণা করাই যায়।

২০১০ সালে মাদ্রিদের সাংবিধানিক আদালত ঘোষনা করে, স্পেনের ভেতর কাতালোনিয়া স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত হতে পারবে না। দুই বছর পর স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোটের আয়োজন করতে আগাম নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়া হয়। আঞ্চলিক নেতা আর্তুর মাস পুনরায় কাতালানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ২০১৩ সালের গোড়ার দিকে স্পেন থেকে আলাদা হওয়ার প্রশ্নে ২০১৪ সালে গণভোটের আয়োজন করতে কাতালানের আঞ্চলিক পার্লামেন্ট ‘সার্বভৌমত্ব ঘোষণা’ অনুমোদন করে।

২০১৪ সালের মার্চে স্বাধীনতার জন্য গণভোটের আয়োজনকে অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করে স্পেনের সাংবিধানিক আদালত। একই বছর নভেম্বরে অনানুষ্ঠানিক এক গণভোটে প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দেন। ২০১৫ সালে ডিসেম্বরে গণভোট আয়োজনকারীদের আদালতের মুখোমুখি করে স্পেন সরকার। দুই বছর পর ২০১৭ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত গণভোটে ৯৮.১০ শতাংশ ভোট পড়ে স্বাধীনতার পক্ষে।

স্পেনের অর্থনীতিতে পাওয়ার হাউস হিসেবে পরিচিত, কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণার পর ক্রমবর্ধমান সংকটে দেশটির অন্যতম সম্পদশালী অঞ্চলের অর্থনীতিতে দেখা দিয়েছে শঙ্কা। যদিও কাতলানকে দেখা হয় অন্যতম ধনী অঞ্চল হিসেবে। রপ্তানিতেও অঞ্চলটির অবস্থান ছিল ওপরের দিকেই। সেখানে রয়েছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির হাসপাতাল ও গবেষণা কেন্দ্র। বলা হয়, মাথাপিছু হিসেবে ইউরোপের ওষুধ কোম্পানির শীর্ষে রয়েছে কাতালান। স্পেনের সেরা পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটিই সেখানে। স্পেনের যেকোনো অঞ্চলের চেয়ে পর্যটকদের কাছে বেশি জনপ্রিয় কাতালান। পর্যটকদের পছন্দের তালিকায় আছে প্রাদেশিক রাজধানী বার্সোলো ও কোস্টা ব্রাভা সৈকত। তবে চলমান সংকটে পর্যটকদের সংখ্যা কমে গেছে অনেকটাই।

বর্তমানে অর্থনীতির গতি স্তিমিত হওয়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক অস্থিরতা কাতালানকে কোন দিকে নিয়ে যাবে সেটি জানতে হলে আমাদের অপেক্ষায় থাকতে হবে। সংকট সমাধানে স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকারের নেওয়া ভূমিকাই প্রাধান্য পাবে। সবশেষ আইনি প্রক্রিয়ায় অতীতের জেনেলালিট্যাট বা কাতালানের সমাধান হতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা।

লেখক : সংবাদকর্মী, আরটিভি