অটিজম সচেতনতা দিবস

সমন্বিতভাবে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ

Looks like you've blocked notifications!

আজ বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। দিবসটি এ দেশে গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা হচ্ছে। অটিজমের প্রসঙ্গ এলেই যার কথা এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হচ্ছে, তিনি হলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। তিনি অটিজমবিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটির চেয়ারম্যান। এবার তিনি জাতিসংঘের ‘অটিজম মোকাবিলা : এসডিজির আলোকে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কৌশল’ শীর্ষক সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন। সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের নেতৃত্বে ও প্রচেষ্টায় অটিস্টিকদের সেবা ও পুনর্বাসনে নিরলস কাজ করছে বাংলাদেশ। ২০১৫ সালে এ দিবসটি উপলক্ষে তিনি বলেছিলেন, অটিজম আক্রান্তদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ করে দেওয়ার পাশাপাশি তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে; তাদের সামর্থ্যকে কাজে লাগাতে হবে। মনোবিজ্ঞানী সায়মা ওয়াজেদ শিশুদের অটিজম বিষয়ে একজন আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রবক্তা। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ব্যারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৭ সালে মনোবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি, ২০০২ সালে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির ওপর মাস্টার্স ডিগ্রি এবং ২০০৪ সালে স্কুল সাইকোলজির ওপর বিশেষজ্ঞ ডিগ্রি লাভ করেন। ব্যারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সময় তিনি বাংলাদেশের নারীদের উন্নয়নের ওপর গবেষণা করেন। এ বিষয়ে তার গবেষণাকর্ম ফ্লোরিডার একাডেমি অব সায়েন্স কর্তৃক শ্রেষ্ঠ সায়েন্টিফিক উপস্থাপনা হিসেবে স্বীকৃত হয়।  

সায়মা ওয়াজেদ হোসেন পুতুল ২০০৮ সাল থেকে শিশুদের অটিজম এবং স্নায়বিক জটিলতাসংক্রান্ত বিষয়ের ওপর কাজ শুরু করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর কাজ বিশ্বজুড়ে প্রশংসা পেয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে পুতুলকে ‘হু অ্যাক্সিলেন্স’ অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করে। মনস্তত্ত্ববিদ সায়মা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘অটিজম স্পিকস’-এর পরামর্শক হিসেবেও কাজ করেন। তিনি ২০১৩ সালের জুন থেকে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ‘বিশেষজ্ঞ পরামর্শক প্যানেলে’ অন্তর্ভুক্ত আছেন। পুতুলের উদ্যোগেই ২০১১ সালের জুলাইয়ে ঢাকায় অটিজম নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনের পর গড়ে ওঠে সাউথ এশিয়ান অটিজম নেটওয়ার্ক। সংগঠনটি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে অটিস্টিক শিশুদের স্বাস্থ্য, সামাজিক ও শিক্ষা সহায়তা দেওয়ার জন্য অবকাঠামো গড়তে কাজ করছে। তাঁর  উদ্যোগেই অটিজম সচেতনতায় বাংলাদেশের একটি প্রস্তাব বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্বাহী পরিষদে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। হু অ্যাক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড গ্রহণের সময় সায়মা ওয়াজেদ হোসেন পুতুল বলেছিলেন, ‘মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করাই আমার দায়িত্ব।’ আসলে ২০০৮ সালের পর থেকে সায়মা ওয়াজেদ অটিজম সমস্যার উন্নয়নে কাজ করার জন্য অনেকগুলো অ্যাওয়ার্ড পান। সব অ্যাওয়ার্ড গ্রহণের সময়ই পুতুল বলেন, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করাই তাঁর দায়িত্ব। পুতুল সে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন নিষ্ঠার সঙ্গে। সেই নিষ্ঠারই একটি ক্ষুদ্র অর্জন ব্যারি ইউনিভার্সিটির প্রদত্ত সম্মাননা। অটিজম আন্দোলন ও বিশ্বস্বাস্থ্যে অবদান রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ব্যারি ইউনিভার্সিটি ডিসটিংগুইসড অ্যালামনাই অ্যাওয়ার্ডস প্রদান করে সায়মা ওয়াজেদ হোসেন পুতুলকে।

সাধারণত অটিস্টিক শিশু বা ব্যক্তির কথাবার্তা বা যোগাযোগের ক্ষেত্রে বৈকল্য ও অসংগতি দেখা যায়। দেরিতে কথা বলা, জবান বা বোল বা বাক প্রভৃতিতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। খেলাধুলায় অনীহা কিংবা নিজেকে গুটিয়ে রাখার চেষ্টা থাকে। আচরণিক ক্ষেত্রেও এদের মধ্যে অঙ্গের, যেমন—হাত, আঙুল, মাথা প্রভৃতির অস্বাভাবিকত্ব দেখা যায়। মূলত অটিজম একটি জটিল বিকাশজনিত বৈকল্য। এর ফলে ব্যক্তির সামাজিক মিথস্ক্রিয়া, ভাষা, আবেগীয় পেশি বা স্পর্শ-সংক্রান্ত সমস্যা পরিলক্ষিত হয়। বর্তমান বিশ্বে প্রতি ৮৮ জনে একজন অটিস্টিক। 

১৯৯০ সালে এদের সংখ্যা বিশ্বব্যাপী প্রতি ১০ হাজারে একজন ছিল। ২০০৯ সালে ১৫০ জনে একজন এবং এরপর প্রতি ১০০ জনে একজন অটিস্টিক ছিল। আসলে এদের উপস্থিতি জাতি-ধর্ম-বর্ণ মিলে সব দেশে লক্ষ করা যায়। বলা হচ্ছে, অটিস্টিক জনগোষ্ঠীর বিশাল সামর্থ্য আছে। স্বাভাবিক চাকরির সুযোগ করে দিলে তারাও সমাজে সমান অবদান রাখতে পারে। অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিশ্বের প্রতিটি দেশ ও মানুষের সম্পৃক্ত হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য সরকারি কর্মকর্তা, চাকরিদাতা, বেসরকারি সংস্থাসহ সকলকেই তৈরি হতে হবে। এ জন্য পুতুল বলেছেন, অটিস্টিক জনগোষ্ঠীকে বিশ্বের মূলধারার অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করার লক্ষ্যে তাদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও সেবা দিয়ে কর্মোপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে, তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। বিশ্বের ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো সক্রিয় হতে হবে। 

বিশ্বে অটিজম ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে তাঁর অভিমত হলো, সহযোগিতার মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিতের উদ্যোগ, অটিস্টিকদের জীবনের পুরোটা সময় সেবা নিশ্চিতের উদ্যোগ, দেশভিত্তিক বহু খাত ও স্তরভিত্তিক পরিকল্পনা প্রণয়ন, টেকসই ও সাশ্রয়ী কর্মকৌশল বাস্তবায়ন এবং বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার বিলোপ ঘটাতে হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, সামাজিক সেবাসহ প্রতিটি খাতে অটিস্টিকদের অধিকতর অংশগ্রহণ নিশ্চিতের পাশাপাশি সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের সম্পৃক্তির ওপর গুরুত্বারোপ করে থাকেন সায়মা ওয়াজেদ পুতুল।     

উন্নয়নশীল দেশে অটিস্টিকদের জন্য কাজ করা খুব সহজ নয়। এর জন্য চ্যালেঞ্জ রয়েছে অনেক। এসব দেশে অটিজম মোকাবিলায় গোঁড়ামি, কুসংস্কার ও সীমিত সেবা, সেবাদানকারীদের মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণের অভাব এবং অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন পুতুল। তবে এসব চ্যালেঞ্জ ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্য সায়মা। অটিজম আক্রান্ত শিশুরাও এই সমাজের অংশ এবং তাদেরও সব পর্যায়ে সমান অধিকার থাকার বিষয়টি যত বেশিসংখ্যক মানুষ বুঝতে পারছেন, সমস্যাটি ততই হালকা হয়ে আসছে বলে মনে করেন তিনি। উল্লেখ্য, অটিস্টিক শিশু ও ব্যক্তির মধ্যে যেসব সামাজিক দক্ষতা, সহানুভূতি, যোগাযোগ এবং আচরণের বৈকল্য দেখা যায় সেগুলো একে অন্যের থেকে ভিন্ন হয়। অর্থাৎ দুজন অটিস্টিক শিশু বা ব্যক্তির মধ্যে একই লক্ষণ পাওয়া গেলেও তাদের মধ্যে আচরণিক ও দক্ষতার ক্ষেত্রে ভিন্নতা দেখা যায়। এ জন্য মা-বাবাকে মনে রাখতে হবে- তার সন্তানের মধ্যে অটিজমসংক্রান্ত লক্ষণের যে বৈশিষ্ট্যগুলো বিদ্যমান সে বৈশিষ্ট্যগুলো অন্য শিশুর মধ্যে নাও থাকতে পারে। তবে অন্য শিশুটিও অটিস্টিক। মা-বাবার সঙ্গে পরিবারের অন্যান্য সদস্য এবং প্রতিবেশী অন্যদেরও এই ধরনের কথা মনে রাখতে হবে।   

পূর্বেই উল্লেখ করেছি, ২০১১ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশীয় সম্মেলনের মধ্যদিয়ে অটিজম সচেতনতা ও সেবা নিয়ে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু হয়। বর্তমানে অটিজমবিষয়ক জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটি, জাতীয় পরামর্শক কমিটি এবং কারিগরি নির্দেশক কমিটির মাধ্যমে সমন্বিতভাবে অটিজম সচেতনতা, দ্রুত চিহ্নিতকরণ, সেবা ও পুনর্বাসনে কাজ চলছে। এজন্য ১৩টি মন্ত্রণালয় একযোগে কাজ করছে। বাংলাদেশে অটিজম সচেতনতা, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও গবেষণার জন্য পাঁচ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। অটিস্টিক শিশুর মা-বাবার ক্ষমতায়ন, নীতি ও আইনি কাঠামো চিহ্নিতকরণ, সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ও অভিভাবকের সমন্বয়, দক্ষ পেশাজীবী গড়ে তোলা ও অধিকতর প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে তাদের সামর্থ্য বাড়ানো, প্রচলিত জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কর্মসংস্থান প্রশিক্ষণে অটিজমকে সম্পৃক্ত করা, দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা এবং সার্বক্ষণিক মনিটরিং ও গবেষণা—এই সাতটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে কর্মকৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে। সায়মা ওয়াজেদ মনে করেন, এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ছয় স্তরে কর্মসূচি গ্রহণ করে কাজ চলছে, যেখানে কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্যবসা-শিল্প প্রতিষ্ঠানকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে সেন্টার ফর নিউরোডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড অটিজম ইন চিলড্রেন সেন্টার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ এবং অটিস্টিকদের জন্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট চালু করা হয়েছে। কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী, শিক্ষক, প্রশিক্ষক, চিকিৎসক, সেবাদানকারী ও মা-বাবার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সব ধরনের প্রতিবন্ধীকে বিনামূল্যে ফিজিওথেরাপি ও অন্যান্য চিকিৎসা দিতে দেশের ৬৪ জেলায় ১০৩টি সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র গড়ে উঠেছে, ভবিষ্যতে এ সংখ্যা আরো বাড়ানোর অঙ্গীকার রয়েছে বাংলাদেশ সরকারের। এ ছাড়া অটিস্টিক শিশুকে মূলধারায় আনতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতায় ৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি বিশেষ একাডেমি স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। অটিস্টিকদের জন্য ব্যাপক কর্মযজ্ঞের সবই সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের একাগ্রতার কারণে।
মূলত বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকার হিসেবে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল জাতির জনকের চিন্তা ও আদর্শ ধারণ করে মানবতার কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে সমস্যাগ্রস্ত শিশুদের কল্যাণে তিনি নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। অটিজম শিশুর বেদনা ওই শিশু ও তার পিতামাতা ছাড়া অন্য কারো পক্ষে অনুভব করা সম্ভব নয়। সন্তানের এ ধরনের সমস্যা নিয়ে পিতামাতা দিনরাত চিন্তিত থাকেন। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সমাজের সকল অটিজম শিশুর জীবনযাত্রায় প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠে বিকশিত জীবনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার যে প্রত্যয় ও প্রচেষ্টা নিয়েছেন, সায়মা ওয়াজেদ পুতুল তা প্রশংসার দাবিদার। বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস উপলক্ষে আমাদের প্রার্থনা, তাঁর সকল প্রচেষ্টা সফল হোক। 

লেখক : অধ্যাপক  এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।