উৎসব

পাহাড়ি জনপদে নববর্ষ ও আমাদের প্রত্যাশা

Looks like you've blocked notifications!

আমরা জানি, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোয় পয়লা বৈশাখ উদযাপনের বর্ণাঢ্য সাজ ও নতুন নতুন আয়োজনের সূচনা হয়েছে। ফলে উৎসবে এসেছে বৈচিত্র্য; যেখানে চিরায়ত বাংলার রূপ খুঁজে পাওয়া যায়। তবে পয়লা বৈশাখ এখন বাণিজ্যিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অবশ্য আমরা আমাদের পাহাড়ি ঐতিহ্য এখনো অক্ষুণ্ণ রাখতে পেরেছি বলে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেক দর্শনার্থী বর্ষবরণের উৎসব উপভোগ করতে রাঙামাটিসহ অন্যান্য পার্বত্য এলাকায় এসে হাজির হন। তবে শহরকেন্দ্রিক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা ও মঞ্চে পরিবেশিত মনোমুগ্ধকর পরিবেশনা দুটোই আলাদা এখানে এবং অবশ্যই তা ঐতিহ্যবাহী। আপনারা সকলেই জানেন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবন রয়েছে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত পার্বত্যাঞ্চলে। এখানে দীর্ঘদিন ধরে এগারো ভাষীর ১২টি জাতিসত্তার সহাবস্থান। এমন বৈচিত্র্য বিশ্বের কোনো দেশে চোখে পড়ে না। তঞ্চঙ্গ্যা এদের মধ্যে অন্যতম। আমাদের রাঙামাটির রাজস্থলী কিংবা বিলাইছড়ি উপজেলায় রয়েছে বিপুলসংখ্যক তঞ্চঙ্গ্যা।

প্রতিবছর আমরা বৈসাবি বা বিষু উৎসবের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকি। পুরোনো বছরের বিদায় এবং নতুন বছরকে বরণ উপলক্ষে পার্বত্য এলাকায় তিন দিনব্যাপী বর্ষবরণ উৎসব হচ্ছে প্রাচীনকাল থেকে। এ সময় জাতিগতভাবে থাকে না আমাদের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব। একে অপরের প্রতি ভালোবাসা, ভ্রাতৃত্বের বন্ধন আরো সুদৃঢ় হয়। কেউ কারো প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণ করি না, সংঘাতে জড়িয়ে পড়ি না। কেবল তঞ্চঙ্গ্যা নয়, সব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী প্রধান ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব হলো বৈসু, সাংগ্রাই ও বিজু বা বিষু। নববর্ষে তিন পার্বত্য জেলায় উৎসবমুখর পবিবেশ বিরাজ করে। এ বর্ষবরণ উৎসবকে ত্রিপুরারা ‘বৈসু’, মারমারা ‘সাংগ্রাই’ এবং চাকমারা ‘বিজু’ ও তঞ্চঙ্গ্যারা ‘বিষু’ বলে অভিহিত করলেও পুরো পার্বত্য জেলায় তা ‘বৈসাবি’ নামেই পরিচিত। বিশিষ্টজনরা বলে থাকেন, ‘বৈসাবি অহিংসার প্রতীক, বন্ধুত্বের প্রতীক এবং মৈত্রীর সুদৃঢ় বন্ধন।’

পুরোনো বছরের বিদায় এবং নতুন বছরের আগমন দুটোই আমাদের কাছে তাৎপর্য নিয়ে হাজির হয়। বিষু বা বিজু অর্থ বিশেষ সুযোগ। বিশেষ সুযোগের এই উৎসব একাধিক পর্ব বা দিনে বিভক্ত। তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রধান ঐতিহ্যবাহী সামাজিক উৎসব হচ্ছে বিষু। এ লোকজ উৎসব চৈত্র মাসের শেষ দুই দিন ও বৈশাখ মাসের প্রথম দিনটি নিয়ে তিনদিনব্যাপী পালিত হয়। আমাদের সমাজে এ তিন দিনকে যথাক্রমে ‘ফুলবিষু’, ‘মূল বিষু’ এবং নয়া বছর বলা হয়। চৈত্রের শেষের আগের দিনকে বলা হয় ফুলবিষু। এই দিন পরিবারের নারী ও শিশুরা জঙ্গল বা অন্য পরিবারের বাগান থেকে ফুল তুলে আনে। সেই ফুল দিয়ে ঘরদোর সাজানো হয়। ফুল দিয়ে কেবল ঘরদোরই নয়, গরু-ছাগল ও অন্যান্য গৃহপালিত প্রাণীকেও সাজিয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া কৃষিকাজে ব্যবহৃত কোদাল, লাঙল এবং অন্য আরো সব উপকরণকেও ফুল দিয়ে রাঙিয়ে তোলা হয়। মূলত এসব নিয়মবিধি পালনের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয় ফুলবিষুর দিনটি। আর মূলবিষু হলো পুরাতন বছরের শেষ দিন, এই দিনটি আমাদের কাছে সর্বাধিক আনন্দের।

সকালবেলা পরিবারের ছোটরা বেতের তৈরি পাত্রে ধান, কুঁড়া ইত্যাদি নিয়ে দল বেঁধে বাড়ি বাড়ি ঘুরে হাঁস, মুরগিকে খাওয়ানোর জন্য ছিটিয়ে দেয়। তারপর বয়োজ্যেষ্ঠদের পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নেওয়ার পর্ব শেষে নিজেদের খাওয়ার পালা। তার আগে সিনিয়র ও সামাজিকভাবে সম্মানিতদের ভক্তি সহকারে খাওয়ানোর পর্ব সেরে নেওয়া হয়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, দুপুরের দিকে ঝর্ণা থেকে তুলে আনা পানিতে বয়োবৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের পরম শ্রদ্ধায় গোসল করানো হয়। এরপর বাড়ি বাড়ি ঘুরে খেয়ে বেড়ানোর পর্ব চলে দিনব্যাপী। ঘরের দরোজা থাকে সকলের জন্য উন্মুক্ত। 

মূলবিষু ও ফুলবিষুর পর ১৪ এপ্রিল নববর্ষকে আমরা বলি নয়া বছর। সকাল থেকে দিনটি আনন্দ মুখরিত হয়ে ওঠে। এদিন ছোটরা বড়দের নমস্কার করে এবং স্নান করিয়ে দিয়ে আশীর্বাদ প্রার্থনা করে। সবাই স্থানীয় বৌদ্ধবিহারে গিয়ে ধর্মকৃত্য করি। ভিক্ষু সংঘ কর্তৃক ধর্মদেশনা শুনে অনাগত দিন সুখে-শান্তিতে কাটানোর জন্য বিশেষ প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করা হয়। এভাবে নয়া বছর দিনের পরিসমাপ্তি ঘটে।

আমরা খুব সরল, স্বাভাবিকভাবে আদিকাল থেকে পালিত হয়ে আসা ঐতিহ্য পালন করি। কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তনের স্বাভাবিক নিয়মে বদল এলেও তা খুব বেশি না। বছরে এই দিন ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করি অনেকেই। উৎসবের সবটুকুই ঐতিহ্যকে ভিত্তি করে ও তার প্রতি সম্মান রেখে আমরা করে থাকি। পাহাড়ি নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পোশাক-পরিচ্ছদ ও অলংকার পরিধান করে তঞ্চঙ্গ্যা নারীরা। নানাবিধ অলংকার পরে আমরা নারীরা ঘিলাখেলায় মেতে উঠি বিষু উৎসবে। এ ছাড়া বিষু উপলক্ষে নারেং খেলা, কুমভাঙা খেলা, শামুক খেলা, চাঁড়া খেলা, গয়াং খেলা, কুমির খেলা, দু দু খেলা, ভূত খেলার আয়োজন করা হয় পাড়ায় পাড়ায়।

বর্ষবরণের সময় যেকোনো বাড়িতে অতিথি এলে আমরা ভীষণ খুশি হই। আবার আমরা একের পর এক বাড়িতে অতিথি হয়ে উপস্থিত হই। হরেক পদের খাবারের আয়োজন থাকে। খাবারের মধ্যে বিভিন্ন সবজি মিশিয়ে রান্না করা ‘পাঁচন’ হচ্ছে অন্যতম। উৎসবের শেষ দিনে আমাদের বাড়িতে ভালো খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করা হয়। পাঁচন, বিরিয়ানি (মটরকলাইয়ের সঙ্গে মুরগি অথবা আলুর ছোট ছোট টুকরো সহযোগে রান্না), মুরগির মাংস, পিঠা, জিলাপি, রসগোল্লা, আচার, তরমুজ ইত্যাদি। সব খাবারই আমাদের ঘরে প্রস্তুত করি আমরা। এসবের মধ্যে পাঁচন হলো সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহ্যবাহী একটা পদ। নানা ধরনের শাকসবজি, যেমন—কচি কাঁঠাল, কাঁচকলা, আলু, শিমুল (স্থানীয় বিশেষ ফুল), তারা (ঘাস বা বাঁশ প্রজাতির উদ্ভিদ), মাশরুম ইত্যাদি দিয়ে তৈরি হয়। কমপক্ষে ৫ থেকে শুরু করে ৪৫ বা আরও অধিক প্রকার সবজি দিয়ে এই খাবার প্রস্তুত করা আমাদের ঐতিহ্য, যা উৎসবে সব খাবারের মধ্যে প্রধান আকর্ষণ বলে গণ্য হয়ে থাকে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের ধারণা, এই দিনে (মূলবিষু) স্বর্গের দুয়ার খোলা থাকে। তাই আমরা বেশি বেশি পুণ্যের আশায় অতিথি দেখলেই বাড়ি নিয়ে আপ্যায়ন করি বা নিমন্ত্রণ জানাই। উৎসবে জুমচাষি, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী কোনো ভেদাভেদ থাকে না। এই দিনের জন্য সবাই সমান।

আগেই বলেছি, তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় বর্ষবরণ ও বর্ষবিদায় অনুষ্ঠানকে বলা হয় ‘বিষু’। বিষু উৎসবে তঞ্চঙ্গ্যাদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় খেলা ‘ঘিলা’। ঘিলা তঞ্চঙ্গ্যাদের শত বছরের ঐতিহ্যবাহী একটি খেলা। নারী-পুরুষ উভয়েই এই খেলায় অংশ নেন। ঘিলা আমাদের পবিত্র ফল। এটি জঙ্গলি লতায় জন্মানো এক প্রকার বীজ বা গোটা। আমাদের বিশ্বাস, ঘিলার লতায় ফুল থেকে বীজ (গোটা) জন্মালেও এর ফুল পবিত্র দেবংশি (স্বর্গীয়) বস্তু হওয়ায় সাধারণ মানুষ ঘিলা ফুলের দেখা পান না। শুধু যাঁরা মহামানব হয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন, তাঁরাই এ ফুলের দেখা পান। ফুলের পরিবর্তে ঘিলা পবিত্র হিসেবে সংগ্রহ করা হয়। আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের ঘরের দরজায় ঘিলা ঝুলিয়ে রাখলে অপদেবতা থেকে মুক্ত থাকা যায়। ঘিলা বাড়িতে রাখলে বজ্রপাত ও বিপদ বাড়িতে প্রবেশ করতে পারে না। সেই হিসেবে বিশ্বাসের প্রতীক হিসেবে আমরা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে ঘিলাখেলার আয়োজন করি মহাআনন্দে। অনেক আনন্দের খেলা এটি। এদিন পরজীবনে সুখ-সমৃদ্ধি লাভের জন্য বড়দের আশীর্বাদ গ্রহণ করি।

‘আস্যা রাইতোয় বিষু রাইত, বহু-র মারাত এক্কোয়া রাইত।’ অর্থাৎ আজকের রাতটি বিষুর রাত, বছর শেষে একটি রাত। এজন্য সমগ্র জাতির শান্তি সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি কামনার লক্ষ্যে বিহারে প্রার্থনার মাধ্যমে শেষ হয় বৈসাবি উৎসব। তবে নববর্ষ উৎসবের ভেতর কৃষি সভ্যতার ইতিহাস লুকিয়ে আছে। কারণ এ সময় পাহাড়ি কৃষি পদ্ধতি জুমে ফসল বোনার সময়। বৈশাখের প্রথম বৃষ্টিতে জুমে ফসল বোনা হয়। আমাদের জুমে ফসল বোনা শুরু হয় চৈত্র এবং বৈশাখ মাসে। এই সময় বৃষ্টির অভাবে প্রকৃতি থাকে শুকনা খটখটে। তাই ধারণা করা হয় চৈত্র মাসের শেষে এবং বৈশাখ মাসের সপ্তাহব্যাপী আচার-কৃত্য বা গীত-নৃত্যের মূল উদ্দেশ্য বৃষ্টি আবাহন, শস্যক্ষেতের সমৃদ্ধি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও রোগব্যাধি থেকে মুক্তি। নতুন বছরে আমরা এই প্রত্যাশাই করি। মানুষের শান্তি, সমৃদ্ধি ও দুযোর্গহীন জীবনের প্রতি আমাদের আস্থাই নববর্ষ উদযাপনের মূল সুর।

লেখক : সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা, সিলেট