বর্ষবরণ

অশ্বত্থের বটমূলে

Looks like you've blocked notifications!

রাজধানীর রমনা পার্কের ভেতরে যে জায়গাটিতে প্রতিবছর ছায়ানটের আয়োজনে বাংলা বর্ষবরণের অনুষ্ঠান হয়, সেটির নাম রমনা বটমূল। কিন্তু অনেকেই জানেন, যে গাছটিকে ঘিরে এই আয়োজন, সেটি আসলে বটগাছ নয়; বরং অশ্বত্থ। কেন একটি অশ্বত্থ গাছ বছরের পর বছর ধরে বটমূল হিসেবে পরিচিতি পেল এবং বাঙালি সংস্কৃতি, বিশেষ করে পয়লা বৈশাখের আনন্দ-উদযাপনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠল, সেই ইতিহাস খোঁজার চেষ্টা করেছিলাম একযুগ আগে। সেই গল্পটা বলি।

উদ্ভিদবিদ ও আলোকচিত্রী নওয়াজেশ আহমদকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কীভাবে একটি অশ্বত্থ গাছ কালক্রমে বটমূল হিসেবে খ্যাত হলো? তিনি বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের কবিতা নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদে ১৯৬৭ সালে বাংলা বর্ষবরণ উদযাপনের জন্য যখন জায়গা ঠিক করা হচ্ছিল, তখন আমার হঠাৎ মনে পড়ে রমনা পার্কের মহীরুহ এ অশ্বত্থের কথা (তার মানে ১৯৬৭ সালেও গাছটি বিশাল ছিল)। দোয়েল পাখির ছবি তুলতে গিয়ে একদিন গাছটির সন্ধান পাই। এর চারদিকে তখন ছিল জংলি ঘাস। নিভৃত জায়গা। ছায়ানটের কর্তাদের বললাম গাছটির কথা। সেদিন বিকেলেই ওয়াহিদুল হক, সানজীদা খাতুনসহ আরো কয়েকজনকে নিয়ে গেলাম গাছটি দেখাতে। সবার পছন্দ হলো। কিন্তু জায়গাটিকে অনুষ্ঠান উপযোগী করতে বেশ বেগ পেতে হলো।’

নওয়াজেশ আহমদ তাঁর ‘মহাবনস্পতির পদাবলি’ বইয়ে এই অশ্বত্থমূলে বাংলা বর্ষ বরণের প্রথম সেই অনুষ্ঠানের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে : ‘ফুরফুরে হাওয়া বইছে। অশ্বত্থের কচিপাতা ঝিলমিল করছে। নুয়ে পড়া ডালপালা দমকা হাওয়ায় মাঝে মাঝে নড়ে উঠছে। মাইক্রোফোন বাঁধা ডালটাই যেন বেশি দুলছে। জাহেদুর রহিমের অগ্রণী বলিষ্ঠ কণ্ঠে সমবেতর সুর ভেসে এলো––‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো; তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে…।’

দেখা যাচ্ছে নওয়াজেশ আহমদ নিজেও গাছটিকে অশ্বত্থ লিখছেন। অথচ জায়গাটিকে বলা হচ্ছে বটমূল। রহস্যটা কী? ২০০৭ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি (আমি তখন দৈনিক যায়যায়দিনের রিপোর্টার) তিনি আমাকে বলেন,‘বট, অশ্বত্থ, পাকুড়––এগুলো একই পরিবারের। সাধারণ মানুষ বট ও অশ্বত্থের পার্থক্য খুব একটা বোঝে না। তারা অশ্বত্থকেও বট হিসেবে চেনে। ফলে যদি জায়গাটিকে রমনা অশ্বত্থমূল বলা হতো তাহলে এটি সাধারণ মানুষের মনে গাঁথা কঠিন হতো। তা ছাড়া আমরা বট বলছি এর বিশালতা বোঝানোর জন্য। বটমূল বললে যেরকম একটা ছায়াময়, প্রশান্তির  এবং বিস্তৃত ক্যানভাস আমাদের চোখের সামনে ধরা দেয়, অশ্বত্থমূল বললে সেটি ঠিক আসে না।’

ঢাকা শহরে ওই সময়ে নিশ্চয়ই আরো অনেক জায়গা ছিল। কিন্তু আপনারা কেন এই গাছের তলাটিকেই বেছে নিলেন? মি. আহমদ বলেন, ‘বছরের এ সময়টায় প্রচণ্ড গরম পড়ে। যে কারণে বর্ষবরণ উদযাপনের জায়গা নির্ধারণ নিয়ে আমরা যখন কথা বলি, তখন সবার পরামর্শ ছিল, এটি যেন খোলা জায়গা এবং ছায়াময় হয়। আমি তখন ভাবলাম, যদি অনুষ্ঠানটা বড় কোনো গাছের নিচে করা যায়, সেটি বেশি জমবে।’

নওয়াজেশ আহমদ বলেন, ‘১৯৬৭ সালে রমনার বটমূলে প্রথম বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে হাজারখানেক লোক সমাগম হয়েছিল।এরপর প্রতি বছরই এই জায়গাটিকে ঘিরে বাঙালির প্রাণের উচ্ছ্বাস বেড়েছে। মানুষের আনাগোনা বেড়েছে। ২০০১ সালের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে এখানে নারকীয় বোমা হামলার পরও এই জায়গাটিকে ঘিরে বাংলা বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে এতটুকু ছেদ পড়েনি।’

আবারও বট ও অশ্বত্থ প্রসঙ্গে আসা যাক। মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকার ‘বৃক্ষ ও পরিবেশ’ সংখ্যায় (জুলাই-ডিসেম্বর, ১৯৯১) কৃষ্ণচন্দ্র রায়চৌধুরী ‘বট উপখ্যান’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘কয়েকটি ব্যাপারে বটগাছ অন্যান্য উদ্ভিত থেকে স্বতন্ত্র। ইংরেজিতে তাবৎ বটগাছ হলো ফিগ ট্রি। আমরা বাংলায় ফিগ বলতে বুঝি ডুমুর। অর্থাৎ ফলটি। যে ডুমুরের তরকারি আমরা খাই তাও একজাতের বট বলতে হবে––কারণ ডুমুর, বট, অশ্বত্থ, পাকুড় সবাই একই গোষ্ঠীর গাছ। আর গোষ্ঠীর কেতাবি নাম ফাইকাস।’

বটের যে স্বভাবটি একে যেকোনো পরিস্থিতিতে টিকিয়ে রাখে তা হলো, মাটির সংস্পর্শ ছাড়াই বটশিশু বেঁচে থাকতে পারে। প্রকৃতির বরে সে বায়ু থেকেই জল এবং বাঁচার অন্যান্য উপকরণ সংগ্রহ করতে পারে। মি. রায়চৌধুরী লিখছেন, ‘সারা পৃথিবীতে প্রায় তিনশো জাতের বটের সন্ধান পাওয়া গেছে। যার মধ্যে প্রায় আড়াইশো আছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যেখানে আবহাওয়া আর্দ্র আর গরম। বট বড়ই শীতকাতুরে। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় এরা নেই বললেই চলে।’

তবে বট শুধু একটি বৃক্ষ বা মহীরুহই নয়। বরং সে একটি সিম্বল বা প্রতীক। এই প্রতীক ঐক্যের, সম্মিলিত হওয়ার, অন্যান্যের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার, এই প্রতীক দৃঢ়তার। এই প্রতীক প্রশান্তির; আশ্রয়ের। বাঙালির এই ঐক্য তৈরি হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে; এই মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর মানে হলো বাংলা সংস্কৃতি কোনো বুলেটে বা বেয়নেটের খোঁচায় বিক্ষত হওয়ার জিনিস নয়। এই দৃঢ়তা মাতৃভাষার অধিকার আদায় করা জাতির সংস্কৃতির টুটি চেপে ধরার বিরুদ্ধে দৃপ্ত শপথ। বটবৃক্ষ যে মানুষকে একত্র করে বা একটি বড় প্লাটফর্ম তৈরি করে তার শত শত উদাহরণ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে আমাদের সারা বাংলায়। গ্রামের হাটগুলো গড়ে উঠেছে এই বটগাছকে কেন্দ্র করেই। অসংখ্য জায়গার নাম পরিচিত এই বটগাছের কারণে। সম্ভবত দেশের সব জেলা ও উপজেলাতেই ‘বটতলা’ নামক দুয়েকটি জায়গা রয়েছে। অর্থাৎ বট শুধু একটি বৃক্ষই নয়; সে একইসঙ্গে বাঙালির আনন্দ-বেদনাসহ প্রতিদিনকার জীবন চর্চারই অংশ। সেই ‘অশ্বত্থের বটমূলে’ বৈশাখের পয়লা তারিখ যে প্রাণের স্পন্দন সৃষ্টি হয়, সারা বছরের আবর্জনা, ক্লান্তি, বিভেদ, প্রতিহিংসা তার সেই ঝড়ো হাওয়ায় উড়ে যাক, সবার এই প্রত্যাশা।

লেখক : সাংবাদিক