সমসাময়িক

তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা এবং প্রাসঙ্গিক আলোচনা

Looks like you've blocked notifications!

২০১৩ সালে ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬’-এ উল্লেখযোগ্য কিছু সংশোধনী আনার পরিপ্রেক্ষিতে সমাজের বিভিন্ন মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ধারাটির প্রায়োগিক দিক নিয়ে বহুদিন ধরে আলোচনা চললেও অতি সম্প্রতি সাংবাদিক প্রবীর সিকদারকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় এবং বাকস্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে ধারাটি বাতিলের দাবি তীব্র হয়ে উঠেছে। গত ১০ আগস্ট ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস প্রদানের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে ১৯ আগস্ট প্রবীর সিকদার জামিনে মুক্তিও পান। 

বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সর্বশেষ সংসদ অধিবেশনে ২০০৬ সালের ৮ অক্টোবর ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন-২০০৬’ পাস হয়। আইনটি পাসের পরে আইনটির ব্যবহারিক দিক নিয়ে তেমন নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত না হলেও ২০১৩ সালের সংশোধনীর পরে বিষয়টি আলোচনা ও সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। ১/১১-পরবর্তী দুই বছর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আইনটির প্রয়োগ চোখে পড়েনি। ফলে আইনটির কিছু কিছু ধারা যে বাকস্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকারের জন্য হুমকি হতে উঠতে পারে তা বিবেচনায় আসার বাস্তবিক প্রেক্ষিত আসেনি। পরবর্তী সময়ে আইনের ৫৭ ধারা মহান সংসদে সংশোধনী আকারে পাস হওয়ায় আইনের ৫৪, ৫৫, ৫৭ ও ৬১ ধারায় উল্লিখিত অপরাধগুলো দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনো আদালতের দ্বারস্থ ব্যতিরেকেই কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবেন বলে আইনি ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়, অর্থাৎ আদালত কর্তৃক কোনো প্রকার সমন জারি ছাড়া তারা চাইলেই যে কারো বিরুদ্ধে এফআইআর রেজিস্ট্রেশন ও তদন্ত করা এবং তাঁকে আটক করতে পারার আইনি ক্ষমতা লাভ করেন।

বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি যদি ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করা হয়, তাহা হইলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ’।

এই ধারায় অপরাধের শাস্তি সর্বোচ্চ ১৪ বছর ও সর্বনিম্ন সাত বছর কারাদণ্ড এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড।

ধারাটির সহজ সরল পাঠ থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, অভিযুক্ত ব্যক্তি কমপক্ষে সাত বছর কারাদণ্ড ভোগ করবেন এবং ধারায় উল্লেখিত অপরাধগুলোর ব্যাপ্তিও বিশাল এবং অসম্পূর্ণ। এ জন্যই আইনের এ ধারাটিতে রাজনৈতিক ও অন্যান্য উদ্দেশ্যে অপব্যবহারের সুযোগ অত্যধিক উল্লেখ করে বিভিন্ন সংগঠন, রাজনৈতিক দল এবং মানবাধিকার সংস্থা বিবৃতিতে উল্লেখ করে আসছে বহুদিন। ৫৭ ধারায় উল্লেখ করা মিথ্যা, অশ্লীল, মানহানিকর, উসকানিমূলক, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ, ধর্মীয় অনুভূতি কিংবা দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ —এ শব্দগুলো কোন কোন ধরনের কর্মকাণ্ডকে বোঝাবে এই ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা পাওয়া যায় না। ২০১৩ সালে আইনটি হলেও এতদিন এর বিধি তৈরি করা হয়নি, যাতে হয়তো শব্দগুলোর ব্যাখ্যা কিংবা স্পষ্ট সীমারেখা বোঝা যেত। তা ছাড়া আইনের এই ধারাটি এতটাই অস্পষ্ট যে এই আইনে যখন-তখন যাকে-তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আটক করতে পারে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারার ব্যবহার নিয়ে যে সমালোচনা এতদিন চলে আসছিল, তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারাও তেমনিভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যখন তখন, যাকে তাকে, গ্রেপ্তারের ক্ষমতা সচেতন মহলকে ভাবিয়ে তুলেছে।  
সর্বশেষ দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরা যায় প্রবীর সিকদারকে গ্রেপ্তারের ঘটনা। 

৫৭ ধারা ছাড়াও এ আইনের অধীন কিছু অপরাধের অভিযোগকে জামিন অযোগ্য এবং আইনে ৫৪, ৫৫, ৫৭ ও ৬১ ধারায় উল্লিখিত অপরাধগুলোকে আমলযোগ্য ঘোষণা করায় তা নাগরিক অধিকার অনেকাংশে ক্ষুণ্ণ করেছে বলেই আইন বিশেষজ্ঞদের মত। ইন্টারনেট ব্যবহারকারী এবং বিশেষ করে তরুণ সমাজ স্বাভাবিকভাবেই ভীতিকর হুমকির ভেতর পড়েছে। ৫৭ ধারার কিছু কিছু শব্দ কোন কোন ধরনের কর্মকাণ্ডকে অন্তর্ভুক্ত করবে সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা না থাকায় ইন্টারনেট এর স্বাভাবিক বিভিন্ন কাজকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। মিথ্যা কিংবা ষড়যন্ত্রমূলক হয়রানির সুযোগও  রয়েছে অনেক। জামিন অযোগ্য হওয়ায় মিথ্যা অভিযোগে মামলা নিষ্পত্তি অবধি জামিন না পাওয়ার সম্ভাবনা ৫৭ ধারাকে আরো ভীতিকর করে তুলেছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর জোট হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ তাই ধারাটিকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য হুমকিস্বরূপ, এবং নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার-সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চুক্তির লঙ্ঘন বলেও মতামত দিয়েছে। 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন আলোচনা, সমালোচনা, বিদ্রূপ বিশ্বব্যাপী এখন প্রচলিত। সমাজের সমস্ত শ্রেণি-পেশার মানুষ, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী সবাই জবাবদিহির আওতাধীন এবং আইন মেনে চলতে থাকতে বাধ্য কিন্তু এ জবাবদিহি যেন ঠুনকো অজুহাতে নিপীড়ন, নিষ্পেষণের হাতিয়ার না হয় সেটিই দেখার বিষয়। নাগরিক যেমন ইচ্ছামতো অনেক কিছু করতে আইন দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হন, তেমনিভাবে তাঁর বাকস্বাধীনতা ও মতামত প্রকাশের অধিকারও রয়েছে। এই অধিকার তাঁর সাংবিধানিক। তথ্যপ্রযুক্তি আইনটিকে, বিশেষত ৫৭ ধারাকে সংবিধানের সঙ্গে তাই সাংঘর্ষিক হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞ মহল।

বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক-স্বাধীনতার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করে বলা হয়েছে – 

“৩৯ (১) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হইল।  

 (২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে; 

(ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং 

(খ) সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।   

সংবিধানের ৩৯(২) অনুচ্ছেদে যেসব যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধের কথা বলা হয়েছে, সেগুলো সমাধানে বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে বিধি ব্যবস্থা রয়েছে। তদুপরি তথ্যপ্রযুক্তি আইনটি পাস করানো হয়েছে। এটাও সত্য যে, আধুনিক সময়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নীতিনির্ধারণের প্রশ্নে ইন্টারনেট কিংবা ইলেকট্রনিক সার্ভিস ব্যবহারের ক্ষেত্রে যুগোপযোগী আইনি কাঠামো থাকা জরুনি। কিন্তু সেই আইনি কাঠামো হওয়া উচিত সুস্পষ্ট, কার্যকর এবং হুমকিমুক্ত। তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে অপরাধ দমনে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে আইন কিংবা নীতিমালা থাকলেও, তা নাগরিকের অধিকারগুলোকে প্রাধান্য দিয়েই তৈরি করা এবং সত্যিকারের অপরাধী দমনে কার্যকরী। উল্লেখ্য, ভারতীয় ইনফরমেশন টেকনোলোজি আইনে ৫৭ ধারার অনুরূপ ৬৬ক যুক্ত ছিল যেখানে শাস্তি ছিল মাত্র তিন বছর। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি ৬৬ক ধারা সংবিধান পরিপন্থী বলে বাতিল করেন। অর্থাৎ ভারতেও এ রকম ধারা মৌলিক অধিকার পরিপন্থী হওয়ায় বেশি দিন ব্যবহৃত হয়নি।
 
বিভিন্ন অপরাধ দমনে এবং বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য হলেও এর ব্যবহার ও প্রয়োগ মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার সমাজ বিনির্মাণে বড় বাধা হয়ে দেখা দিয়েছে। পুলিশকে যে অসীম ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তাতে পুলিশ আরো বেপোরোয়া হয়ে উঠতে পারে। যাতে করে পুলিশ চাইলে যে কাউকে এই আইনে মামলা দিয়ে দীর্ঘকাল কারাগারে রাখতে পারবে। এ ছাড়া রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও ব্যক্তিগত শত্রুতা ও ফায়দা হাসিলেও ৫৭ ধারাটি ব্যবহার হওয়ার সম্ভাবনা বিভিন্ন মহলের আলোচনায় উঠে এসেছে। আইনজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞরা ৫৭ ধারাকে বিতর্কিত ও অপব্যবহার-অপপ্রয়োগে দুষ্ট হিসেবে অভিহিত করে তা সংশোধনের দাবি তুলেছেন।

বিভিন্ন বিবেচনায় তথ্যপ্রযুক্তি-সংক্রান্ত বিষয়, সাইবার নিরাপত্তা, ডিজিটাল নিরাপত্তা এবং এ-সংক্রান্ত অপরাধের শাস্তির বিষয়ে একটি নতুন আইন প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার বিষয়টিও ওই আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। যতদিন না এরূপ কোনো পরিবর্তিত আইন মহান সংসদে পাস হয়ে আসছে, ততদিন এই আইনে সমালোচনার জায়গা রয়েই যাচ্ছে। 

যাঁরা সাংবাদিকতা, লেখালিখি বা শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা করেন কিংবা অনলাইন যোগাযোগ ও কর্মকাণ্ডে জড়িত আছেন, তাঁরা এই আইনটি ২০১৩ সালে সংশোধনের পর থেকেই এর বিতর্কিত ৫৭ ধারার বিরোধিতা করে আসছে। আইনের বেশ কিছু ধারা বাতিলের দাবি অনেকটাই সর্বজনীন। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইন প্রণয়ন হয় নাগরিকের স্বার্থে। তারপরও, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা কিংবা রাষ্ট্র পরিচালনার সুবিধার্থে, কৌশলগত কারণে বিভিন্ন আপাত বিতর্কিত আইন প্রণয়ন অনিবার্য হয়ে পড়ে।

তবে, তথ্যপ্রযুক্তি আইন এবং তার ৫৭ ধারার বিষয়টি খুব দ্রুত মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার ক্ষেত্রে এবং বাকস্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে হুমকি হিসেবে পরিলক্ষিত হয়েছে। আইন প্রণয়ন কিংবা তার উল্লেখযোগ্য ধারার অন্তর্ভুক্তির বাস্তবতা  এবং নাগরিকের আশা-আকাঙ্ক্ষার ভেতর একটা সমন্বয় থাকা খুব জরুরি। তা নাহলে সুশাসন ও সংবিধানিক অধিকারের মর্যাদা বজায় থাকে না। 

 লেখক : ব্যারিস্টার অ্যাট ল’, অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট