রাজীবের হাত

রাজীবের ছিন্ন হাতের চপেটাঘাত আমাদের গালে

Looks like you've blocked notifications!

কলেজ ছাত্র রাজীব হোসেন। সৌম্য সুদর্শন যুবক। আবাল্যে পিতামাতাকে হারিয়ে এ ঘাট ও ঘাট ঘুরা যুবকটির চোখে ছিল ভাগ্য জয়ের সাত-সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দেওয়ার প্রত্যয়ী স্বপ্ন। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র আর এখানকার বহুবাজে সিস্টেম স্বপ্নবাজ মানুষের আশাভঙ্গের রূপকার হওয়াকে যেন নিজেদের দুর্ভাগা নিয়তি করে নিয়েছে। আমরা অবিবেচকতা আর নির্বিকারতাকে সারথি করেছি, দেশমাতাও নানা ঝুটঝামেলায় পতিত করে আমাদেরকে তাই ধুয়ে দিচ্ছে। পরিবহন নৈরাজ্যের নির্মম বলি রাজীবের ছিন্ন হাতের চপেটাঘাত আমাদের সবার গালে। রাজীব চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেলেন প্রাণ হাতে নিয়ে কী বিভীষিকার মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের রোজকার দিন পার করি।  

গত ৩ এপ্রিল বিআরটিসির একটি দোতলা বাসের পেছনের দরজায় দাঁড়িয়ে গন্তব্যে যাচ্ছিলেন রাজধানীর মহাখালীর সরকারি তিতুমীর কলেজের স্নাতকের (বাণিজ্য) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রাজীব হোসেন (২১ )। তাঁর ডান হাতটি বেরিয়ে ছিল সামান্য বাইরে। হঠাৎ করেই পেছন থেকে একটি বাস বিআরটিসির বাসটিকে ওভারটেক করার জন্য বাঁ দিকে গা ঘেঁষে পড়ে। দুই বাসের প্রবল চাপে রাজীবের হাতটি শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সেই ছবি গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় বহুল প্রচারে জনমনে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। কিন্তু এতটুকু টনক নড়েনি কোনো কর্তৃপক্ষের। প্রায় পনের দিন চিকিৎসাধীন থাকবার পর জীবনের কাছে হেরে যান রাজীব। প্রায় সবখানেই আমাদের মহান ঈশ্বরের অলৌকিকতার ওপর ভরসা করে থাকতে হয়। তেমন ভরসা অবশ্য রাজীবকে জীবন ফিরিয়ে দেয়নি। চিরদুঃখী এই ছেলেটার ব্যথার পূজা আজীবনের জন্য সমাপন ঘটে গেছে। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ জাগতিক জীবন থেকে নির্বাণ লাভ করেছে রাজীব। সাধারণ বঙ্গমানুষের এটাই হয়তো যৌক্তিক পরিণতি।  

আমাদের অর্থনীতি ফুলেফেঁপে উঠছে। নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ বা উন্নয়নশীল টাইপ বহুবিধ অভিধায় বিভূষিতও হয়ে চলেছি। তাহলে সেই অর্থ কি স্রেফ দুঃখবিলাসের জন্য? এখনো কেন সুখ হাতড়ে মরতে হয়তো সবাইকে? এই বিষয়ে যাদের জবাব দেওয়ার কথা তারা কখনোই কথা বলবেন না। কারণ উপরতলার মানুষরা একদম অসুখী নয়। এসি গাড়ি ও এসি রুমে বসত করা সেসব সুখী মানুষ কোনোদিন অনুভব করবে না ভাঙা রাস্তার দুর্ভোগ বা বিপর্যস্ত গণপরিবহনের নরকসমান সংকট কাকে বলে। 

আমাদের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীকে প্রায়ই রাস্তায় দেখা যায়। গণমাধ্যমে বক্তব্য দেন দেশের রাস্তাঘাট সব ঠিক আছে। তিনি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িতে করে এসে সড়কে নামেন। তাঁর জন্য রাস্তার যানজট পরিষ্কার করে রাখা হয়। মাননীয় মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্লিজ একদিন রাজধানীর মতিঝিল থেকে উত্তরায় আপনাদের রেখে দেওয়া গণ পরিবহনে বাঁদুরঝোলা হয়ে এসে দেখুন। গ্রীষ্মের তাপদাহে অসহনীয় যানজট, ধুলার অন্ধকার ও রগচটা পরিবহনকর্মীদের দুর্ব্যবহার মাথায় নিয়ে ব্যাটারি রিকশা, নসিমন, করিমন বা লেগুনাসহ বহুবিচিত্র মুড়িরটিন পরিবহনে করে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের চন্দ্রা থেকে ঢাকায় গিয়ে দেখুন। কী অবস্থা হয় আপনার? আমরা মনে করি দেশের উন্নয়নের রূপকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও এই অভিজ্ঞতার উপলব্ধিটা হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হবে। তবেই কেবল বুঝবেন ইতিমধ্যে আপনারা আমজনতা সবাইকে মহাসড়কের মহাদুর্ভোগে ফেলে রাজীব বানিয়ে ছেড়েছেন। রাস্তার বিড়ম্বনায় পড়ে আমাদের কারো হাত নেই, পা নেই, দৃষ্টিশক্তি বা মেজাজ-মর্জি কিছুই ঠিক নেই। যেন রাজীবেরই পথ ধরে আমরা সবাই সার বেঁধে হেঁটে যাচ্ছি এক অচিন অতল গহ্বরে।   

বিশ্বের খ্যাতিমান জরিপ সংস্থাগুলোর পরিসংখ্যানই জানান দিচ্ছে, সারাবিশ্বে বাংলাদেশের রাস্তাঘাট সবচে’ নিম্নস্থানীয়, ভয়ংকর দুর্ঘটনাপ্রবণ, অচল ও ব্যবহার অনুপযোগী। অথচ রাস্তা উন্নয়নে সাসেক্স, বিআরটি, মেট্রোরেল ইত্যাকার বহুনামে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। আর শোনানো হচ্ছে সান্ত্বনা বাণী। জন্ম যন্ত্রণার কষ্ট হাসিমুখে সইবার জন্য নসিহত করছেন সড়কমন্ত্রী। কিন্তু বিপুলব্যয়ে নির্মিত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে আমরা কী শিক্ষা পাচ্ছি? রাস্তা নির্মাণের আগে সাড়ে ৩০০ কিলোমিটার পথ যেতে যেখানে লাগত সাত-আট ঘণ্টা এখন লাগে ২৩ ঘণ্টা এমন মহাসড়কীয় উন্নয়নের গতি দিয়ে আমরা কী উদ্ধার করতে পারব? 

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম ও সওজের তথ্যমতে, গেল আট বছরে ৪০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সড়ক-সেতু নির্মাণ ও মেরামতে। এরপরও সড়কের বেহাল অবস্থা বদলায়নি। গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় মহাসড়কের স্থানে স্থানে খানাখন্দ ও ধুলায় ধুসরিত সড়কপথে যাতায়াত কঠিন হয়ে পড়েছে। জেলা ও আঞ্চলিক মহাসড়কগুলোর অবস্থা আরো খারাপ। জোড়াতালির সংস্কার আবার পরক্ষণেই গর্ত-এই ঘুর্ণাবর্তেই চলছে গত আট বছর। সড়ক উন্নয়নে ব্যয় করা হয়েছে ৩১ হাজার কোটি টাকা আর রক্ষণাবেক্ষণে নয় হাজার কোটি টাকা। অভিযোগ আছে রাজনৈতিক ঠিকাদার কর্তৃক ভাগবাটোয়ারায় অর্থ লোপাট, নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার, দুর্বল ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে চার মহাসড়কের ১০৬০ কিলোমিটারের বেশির ভাগই এখন বেহাল। আঞ্চলিক সড়কগুলোরও যানচলাচলের সামান্য সক্ষমতা নেই। এমন বাস্তবতায় ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) প্রতিযোগিতা-সক্ষমতা প্রতিবেদন ২০১৭ অনুযায়ী, এশিয়ার মধ্যে অন্যতম নিকৃষ্ট সড়কের দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। কেবল নেপাল বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ।

বাংলাদেশের এমন খারাপ সড়ক দিয়ে পৃথিবীর নিকৃষ্টতম যানবাহনগুলোই হরহামেশা চলাচল করে। ব্যাটারিচালিত অবৈধ রিকশাই আছে শতপ্রকার। আর বহুরূপী ওই যানবাহনগুলো চালান অদক্ষ, অপ্রাপ্তবয়স্ক ও নিবন্ধনবিহীন নামধারী চালকরা। চালকের সহায়কের দায়িত্ব পালন করে ইঁচড়েপাকা শিশুরা। সেই চালক ও তাদের সহায়কদের স্বেচ্ছাচারিতার বলি আপামর জনসাধারণ। হররোজ সবচে’ বেশি দুর্বিপাকে পড়ে নারী, শিশু ও বয়োবৃদ্ধরা। পরিবহন সংশ্লিষ্টদের অরাজকতার বিরুদ্ধে কারো মুখ খুলবার জো নেই। রাষ্ট্র তাদের আইনি সুরক্ষা দিয়ে বেপরোয়া পেশাজীবী বানিয়ে দিয়েছে। উপরন্তু মাসোহারার ভিত্তিতে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়া, আইনশৃঙ্খলাবাহিনী ও বিআরটিএর বেমালুম ছাড় এখন পরিবহন সংশ্লিষ্টদের রাস্তার রাজায় পরিণত করেছে। ভাবখানা এমন যে, রাস্তা সংশ্লিষ্টরা সেকেলে শোষক ও জুলুমবাজ জমিদার আর আমরা যাত্রী সাধারণ শোষিত সামান্য প্রজা।

রাজীব হোসেনের দুর্ঘটনার বিষয়টি একজন সংবেদনশীল আইনজীবী আদালতের নজরে আনলে, দুই বাসের রেষারেষিতে হাত হারানো এই শিক্ষার্থীর চিকিৎসা ব্যয় সংশ্লিষ্ট বাস কোম্পানি দু’টিকে বহন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত। এখন অবশ্য রাজীব এসব নির্দেশনার ঊর্ধ্বে। রাষ্ট্রে যদি আইনের শাসন থাকত তবে সব ন্যায্য সিদ্ধান্তের জন্য আদালতের নির্দেশনার দিকে মুখিয়ে থাকত হতো না। যেকোনো কল্যাণমূলক রাষ্ট্রযন্ত্রই নিজেরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রাজীবের ট্র্যাজেডিতে সমান বেদনা বোধ করত এবং ন্যায়সঙ্গত বিহিতব্যবস্থা করত। কিন্তু আমাদের সমাজ-রাষ্ট্র কেউই এখন মানবিকতা ও বোধের চর্চা করে না। ক্ষমতাবান ও ধনিকশ্রেণিরা টাকার ধান্ধায় অন্ধ। তাদের চোখে ভালোবাসা, মায়া, মমতা, সহমর্মিতা খানিকটাও ধরা দেয় না। 

অতএব এই বিকারহীন রাষ্ট্রব্যবস্থায় আমরা আর প্রশ্ন করতেও পারব না যে, সম্ভাবনাময় প্রজন্ম রাজীবদের এমন পরিণতি ভোগ করতে হবে কেন? আমরা বলতে পারব না, উন্নয়নের নামে এত টাকা কোথায় যায়, কীসে ব্যয় হয়? উন্নয়নের সাথে অসততা, অভব্যতা ও বর্বরতাও সমানুপাতিক কি না এমন প্রশ্নও আমরা করতে যাব না!

অভিভাবকহীন রাজীবের ছোট দুই ভাইকে এখন কারা দেখাশোনা করবে সেই প্রশ্ন তোলাও অবান্তর। 

তবু হে প্রাণের রাষ্ট্র শেষ প্রশ্নটা তোমার কাছে করি, ঢাকঢোল পিটিয়ে এত যে দুর্বার গতির উন্নয়নের কথা সকালসন্ধ্যা বলে যাও সেই উন্নয়নের বাতির নিচে এত অশান্তির কুৎসিত অন্ধকার কেন? 

লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন