তুমি কেমন করে আন্দোলন কর হে জাহাঙ্গীরনগর

Looks like you've blocked notifications!

জাহাঙ্গীরনগর হাসলে আমরাও প্রাণখোলে হাসি। আর জাহাঙ্গীরনগরে ঝড় উঠলে আমাদের মননের ডালপালা ভাঙে, সবুজ পাতারাও খসে পড়ে। এমন নিখাদ ও নিরঙ্কুশ বিশ্ববিদ্যালয় প্রেম আমাদের। নরম কাদামাটির শিক্ষার্থীকে মৃত্তিকা শিল্প করে গড়ে তুলবার আঁতুড়ঘর হলো বিশ্ববিদ্যালয়। সেই মাতৃসমা বিদ্যাপীঠের সকল সুখ-দুঃখ আজীবন স্পর্শ করে যায় তার আপনার থেকেও আপন এই সন্তানদের। কিন্তু আত্মস্বার্থ রক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনপন্থী ও প্রশাসনবিরোধী শিক্ষকরা ধস্তাধস্তি করলে, হাতাহাতি করলে এবং গালাগালের বিষবাষ্প ছড়ালে গর্বে আমাদের বুকটা ফুলে ওঠা উচিত কি না, আমারা সত্যি তা বুঝতে পারি না। 

তাবৎ পৃথিবীর নিয়ম এটা যে প্রতিবাদ না করলে ন্যায্য দাবি প্রতিষ্ঠিত হয় না। সাম্যবাদ, ন্যায্যতা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় সেই আন্দোলনেরও আছে টেক্সটবুক নিয়মনীতি।

সবকিছুর ঊর্ধ্বে চলে যাওয়া আমরা কি আসলে কোনো নিয়মনীতিরই তোয়াক্কা করি? যেখানে নিয়মের অনুবর্তী না থেকেও দিব্যি আরাম আয়েশের দিন গুজরান করা যায় সেখানে দুস্তর পারাবার নিয়মের ধার আর কে ধারতে যায়? বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুবিচিত্র আন্দোলনের ধারাপতন দেখে বিস্ময়াভিভূত আমরা তাই বলতে চাই, তুমি কেমন করে আন্দোলন কর হে জাহাঙ্গীরনগর।  

সাম্প্রতিক উত্তরাধুনিক আন্দোলনের রকমসকম দেখে আমরা এত অবাক হয়ে গেছি যে, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুরের ইন্দ্রজালেও কখনো এতটা অবাক হননি। আমাদের অবস্থা এমন– ‘কইতে কী চাই কইতে কথা বাঁধে।’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনমুখী বিবদমান দুই দল সেই শিক্ষকদের উদ্দেশে রাবীন্দ্রিক এই সুরের নৈবেদ্যই তোলা থাক : 

তুমি  কেমন করে গান কর হে গুণী,
অবাক হয়ে শুনি, কেবল শুনি।
গেল ১৫ ফেব্রুয়ারি উপাচার্য হিসেবে অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম পুনঃনিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থী শিক্ষকরা বিভাজিত হয়ে পড়েন। একদলের নেতৃত্বে আছেন সাবেক উপাচার্য অধায়পক শরীফ এনামুল কবীর এবং অপর দলের কাণ্ডারি বর্তমান উপাচার্য ফারজানা ইসলাম। সম্প্রতি শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে ফারজানা ইসলামের দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে তিনি নিজের পাওয়ার হাউজে অধিকতর জ্বালানি সঞ্চয় করতে বিভিন্ন অনুষদের ডিন, প্রক্ট্ররিয়াল বডি ও হলগুলোর প্রভোস্ট পদে রদবদল করেন। এক অফিস আদেশে নয়জন প্রভোস্টকে অব্যাহতি দেন উপাচার্য। এসব ঘটনাকে নজিরবিহীন, বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্টবিরোধী ও শিষ্টাচার বহির্ভূত আখ্যা দিয়ে গেল মঙ্গলবার ধর্মঘটের ডাক দেন শরীফ এনামুল কবিরপন্থী শিক্ষকরা।  বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট-১৯৭৩, স্ট্যাটিউট ও সিন্ডিকেট পরিচালনা বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে আহূত ধর্মঘটের অংশ হিসেবে ওই দিন ভোর ৪টার দিকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের নেতা শরীফ এনামুল কবিরের অনুসারী পাঁচজন শিক্ষক পরিবহন ডিপোর সামনে অবস্থান নিয়ে তালা ঝুলিয়ে দেন। খবর পেয়ে সাড়ে ৪টার দিকে ফারজানা ইসলামের অনুসারী শিক্ষকরা সেখানে উপস্থিত হয়ে তালা খুলে দেওয়ার অনুরোধ জানালে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে ধস্তাধস্তিতে জড়িয়ে পড়েন দুই পক্ষের শিক্ষকরা। বাকিটা বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষক ও ধস্তাধস্তির ইতিহাস। সার্চ জায়ান্ট  গুগলে সার্চ দিলে শিক্ষকদের ওই কমিক ড্রামাই এখন সবার আগে আসে।

অতীত ইতিহাস ঘাটলেই দেখা যায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আর ভিসি খেদাও আন্দোলন প্রায় সমার্থক। বেশিরভাগ ভিসি মহোদয়ই এখানে নির্বিঘ্নে দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। ড. ফারজানা ইসলাম অবশ্য ব্যতিক্রম। তাঁর প্রথম চার বছর নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে পার করতে পেরেছিলেন। কিন্তু পুনঃনিয়োগ নিষ্কন্টক হবে না বলেই অনুমান করা যায়। বিশ্ববিদ্যালয় তার শিক্ষা ও গবেষণার চরিত্র হারিয়ে এমন একটা লোভনীয় জায়গায় এসে উপনীত হয়েছে যেখানে নিজেদের শানশৌকত ও অর্থনৈতিক ঠাটবাট বজায় রাখতে সব শিক্ষক কর্মকর্তারাই প্রশাসনের কাছাকাছি থাকতে চান। বিশেষকরে শিক্ষার্থীদের পিতৃ-মাতৃতুল্য শিক্ষকদের ধ্যান খেয়াল এখন আর বিদ্যাদানে নিবেদিত নয়। তাঁরা ব্যস্ত থাকছেন বিভিন্ন দলে উপদলে বিভক্ত হয়ে রাজনৈতিক গুটিবাজিতে। সেই গুটিবাজির সর্বোচ্চ টার্গেট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ অলংকরণ। বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেট আছে, সিন্ডিকেট আছে, হাজার কোটি টাকার বাজেট আছে। ভিসি হওয়া মানে ছোটখাটো রাজ্য চালানোর চেয়ে কম কিছু না। আর ৭৩-এর বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ভিসি মহোদয়দের এত ক্ষমতা দিয়ে রেখেছে যে, এমন পাওয়ার প্র্যাকটিস স্বেচ্ছাচারিতার আইকন জেনারেল এরশাদও করতে পেরেছেন কি না সন্দেহ।

ফারজানা ইসলাম দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রথম নারী ভিসি। সবাই আশা করেছিলেন, তিনি অন্তত পুরুষ শাসকদের মতো স্বার্থান্ধ না হয়ে সব মত ও পথের মানুষকে সাথে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার অগ্রযাত্রাকে সর্বাগ্রে প্রাধান্য দেবেন। কিন্তু লাভের জলে সুবিধার আলতা না ভিজিয়ে তিনিও বুঝি থাকতে পারেননি। আগের পালায়  তাঁর বিরুদ্ধে নিজের পরিবার, স্বজন ও স্বামী সহযোগে অবাধ ক্ষমতার অপব্যহার ও বিপুল অর্থ নয়ছয়ের অভিযোগ রয়েছে। নিজের দল ভারি করতে ডজন ডজন এমন শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন যাঁদের নৈতিক মানদণ্ড কেবল ক্ষমতা ও অর্থনীতির সাথে সম্পৃক্ত। ভালোমানের ওয়ার্ল্ড স্ট্যান্ডার্ড কোনো শিক্ষককে জাহাঙ্গীরনগরের স্বর্গাশ্রমে পাকাপোক্ত আসন করে দিয়েছেন এমন নজির বিরল। কর্মকর্তা/কর্মচারি নিয়োগের গল্পের গোঁড়াও ওই একই। 
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারি নিয়োগে জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে পাওয়া আবেদিত প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক শুদ্ধ পরীক্ষার মাধ্যমে সর্বোচ্চ যোগ্যতাসম্পন্নদের বাছাই করবার কথা আমরা শুনিনি। সেখানে কর্মরত প্রশাসনের আস্থাভাজন কারো স্ত্রী, শ্যালিকা কিংবা ভাগ্নেরা ইচ্ছে করলেই চাকরি বাগাতে পারেন। জনবল নিয়োগে আত্মীয়করণের শ্রেষ্ঠতম শিথিল জায়গা জাহাঙ্গীরনগর প্রশাসন। সেটা ফারজানা ইসলামই হোক কিংবা শরীফ এনামুল কবিরই হোক।

আন্দোলনের বেগ এবং সরকারের ইচ্ছে বুঝে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে বদল ঘটে বটে, তাদের আচারনিষ্ঠার রদবদল হয় সামান্যই। আজকে যে কাজগুলো করে ফারজানা ইসলাম বিরোধীপক্ষের বিরাগভাজন হচ্ছেন, অতীতে একই কাজ করে শরীফ এনামুল কবিরও ভিসি পদ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। আজকের শিক্ষকদের যে মারামারি হানাহানি তার মূল সূত্র এমন বাস্তবতাতেই নিহিত। বিদ্যাবুদ্ধির জোর নয় স্রেফ রাজনৈতিক দলভারি করবার মানসে যেখানে বেশিরভাগ শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয় সেই শিক্ষকরা ভোর রাতে বের হয়ে ধর্মঘট সফল করা কিংবা বানচালের নামে ক্যাম্পাস প্রেমিজে মারামারিতে লিপ্ত হবেন এটা আর তেমন কি? ভবিষ্যতে এহেন পলিটিশান শিক্ষক সমাজ নিজেদের স্বার্থদ্বন্দ্বে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হবেন না সে গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবে না। 

দেশের অপরাপর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই কার্যত লোভাতুর শিক্ষকসমাজের ঘূর্ণাবর্তে পড়ে গেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও। বিদ্যাদেবীর আরাধনা নয়, কুটচালে যারা জিতবেন তারা টিকে থাকবেন বাকিরা না পাওয়ার বেদনায় পুড়ে আন্দোলন করে সময় পার করবেন। শিক্ষার্থীদের ভরসা ওই গুটিকয়েক নির্লোভী সাধারণ শিক্ষক। যারা শুধু পড়াশোনা ও গবেষণা বুঝেন, রাজনীতির ধার ধারেন না।    

আমাদের এই সমাজে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সম্পর্কে যে উচ্চ ধারণা আছে তা ভুলুণ্ঠিত করছেন কিছু দলবাজ শিক্ষক। একটু খবর নিলেই জানা যাবে যারা মারামারিতে লিপ্ত তাদের কাছ থেকে শিক্ষার্থীদের পাওয়ার তেমন কিছু নেই। কোমলমতি শিক্ষার্থী যারা মেধার পরীক্ষায় জয়ী হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে পা রাখে তাদের বিদ্যা শেখাবার নৈতিক ভিত্তিও এসব পলিটিশান শিক্ষকদের থাকা উচিত নয়। 

সামগ্রিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আজকের এই অবনমনের দায়ভার ক্ষমতালোভী উপাচার্য, তাদের বশংবদ শিক্ষক এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় ভুল ব্যবস্থাপনার। ফারজানা ইসলামকে দ্বিতীয় মেয়াদে নিয়োগ দিয়ে বঞ্চিতপক্ষের হাতে আন্দোলনের লাটাই তুলে দিতে হবে কেন? যথার্থ উপায়ে ভিসি প্যানেল নির্বাচন করে সেখান থেকে মেধাবী একজনকে নিয়োগ দিলে কার ক্ষতি ক্ষতিবৃদ্ধি হতো? শিক্ষকদের প্রধানতম কাজ পড়ানো এবং ছাত্র পড়িয়েই তাদের আয় রোজগার করবার কথা। প্রশাসন চালানোটা অতিরিক্ত দায়িত্ব। সেই অতিরিক্ত দায়িত্ব কেন শিক্ষকতার মতো মহত্তম কাজের চেয়ে লাভজনক ও ক্ষমতাশালী করে রাখা হবে? রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে এর কি কোনো জবাব আছে? 

বস্তুত মোটের ওপর এই হলো দলাদলিতে ব্যস্ত আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রকৃত অবস্থান। তারা স্বপক্ষ ও বিপক্ষে গলাধরাধরি করে প্রতিহিংসা, বিদ্বেষ বা ঘৃণা ছড়াবেন। তাদের প্রমোশন হবে মর্যাদাও বাড়বে। তারা ক্লাসে গিয়ে ছেলেমেয়েদের নীতিশাস্ত্রের জ্ঞানও দেবে। বিষয়টা কী লজ্জাজনক!

সাধারণ শিক্ষকরা অবশ্য এই কাতারের নন। দলাদলি ও গলাবাজি বিমুখ আজন্মের অবহেলিত প্রাজ্ঞ সাধারণ শিক্ষকরা যেমন আছেন চিরটাকাল তেমনই থাকবেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো যেটুকু আদর্শবাদিতা, জ্ঞানচর্চা ও শ্রেয়বোধ আছে সেই কৃতিত্বের দাবিদার ওই নিরীহ শিক্ষকরাই। তাদের প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা অটুট ছিল, থাকবে। 
যেসব শিক্ষক আন্দোলন জমানো ও দমনের নামে বিশ্ববিদ্যালয় পরিস্থিতি অচল করে চলেছে তারা এই উপমহাদেশের আন্দোলনের আইকন ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর জীবন থেকে আরেকবার পাঠ নিতে পারে। মানুষের তো শেখার শেষ নেই। মহাত্মা গান্ধী সব পরিস্থিতিতেই অহিংস মতবাদ এবং সত্যের ব্যাপারে অটল থেকেছেন। তিনি সাধারণ জীবনযাপন করতেন। তাঁর নিজের পরিধেয় কাপড় ছিল ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় ধুতি এবং শাল যা তিনি নিজেই চরকায় বুনতেন। তিনি সাধারণ নিরামিষ খাবার খেতেন। আত্মশুদ্ধি এবং প্রতিবাদের কারণে দীর্ঘ সময়ের জন্য উপবাসও থাকতেন। আমরাও গান্ধীর আদর্শে আস্থাবান এমন শিক্ষককেরই তালাশ করি যিনি হবেন চরমতম নির্লোভী, নিবেদিত ও ত্যাগী। তবেই বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারে শিক্ষার সুন্দর ও পবিত্রতম আশ্রম।

লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন