আন্তর্জাতিক

কোথায় মনুষ্যত্ব, কোথায় আমাদের বিবেক

Looks like you've blocked notifications!

সম্প্রতি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ সিরিয়ার হাজার হাজার শরণার্থী নিয়ে বিপাকে পড়েছে মেসিডোনিয়া সরকার। জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) কারণে দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে ওই অঞ্চলের মানুষ, যারা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের যেকোনো দেশে অভিবাসী হতে চায়। কয়েক দিন ধরে গ্রিসের উত্তরাঞ্চলীয় এলাকায় শরণার্থীরা সীমান্ত পেরিয়ে মেসিডোনিয়ায় যেতে চাইলে তাদের বাধা দেয় সে দেশের পুলিশ। ওই সীমান্তে হাজারো শরণার্থী ও অভিবাসী খোলা আকাশের নিচে রাত কাটিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা এই শরণার্থীদের নিজ দেশের ভূখণ্ডে প্রবেশ ঠেকাতে বিভিন্ন ধরনের গ্রেনেডসহ কাঁদানে গ্যাসের ব্যবহার ও লাঠিপেটা করে মেসিডোনীয় পুলিশ বাহিনী। আশ্রয়প্রত্যাশীদের রাতে ঠেকাতে গত বৃহস্পতিবার সীমান্তে জারি করা হয় জরুরি অবস্থা। কিন্তু একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকায় আশায় মরিয়া এসব মানুষকে রুখতে ব্যর্থ হয় মেসিডোনীয় বাহিনীর সদস্যরা।

ইউরোপীয় ২৮ দেশের জোট ইইউর সীমান্ত রক্ষা সংস্থা ফ্রনটেঙ্কের গত সপ্তাহের হিসাব অনুযায়ী, এ বছরের প্রথম সাত মাসে প্রায় তিন লাখ ৪০ হাজার আশ্রয় আগ্রহী মানুষ ইউরোপের সীমান্তে পৌঁছেছে। এর মধ্যে জুলাইয়ে এক মাসের রেকর্ড এক লাখ সাত হাজার। ওই মাসে এক গ্রিসেই ভিড়েছে ২০ হাজার ৮০০ মানুষ। আর গত দুদিনে সার্বিয়ায় নথিভুক্ত হয়েছে কমপক্ষে সাত হাজার আশ্রয়প্রার্থী। তারা সবাই ইইউতে প্রবেশের প্রধান দ্বার হাঙ্গেরিতে পা রাখতে মরিয়া। হতভাগ্য এসব মানুষের বেশির ভাগই যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার নাগরিক।

ইউরোপমুখী আশ্রয়প্রত্যাশী মানুষের রাতকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকট হিসেবে দেখা হচ্ছে। এ সংকট সমাধানে নতুন করে সমন্বিতভাবে উদ্যোগ নেওয়ার কথা খুবই গুরুত্বের সঙ্গে ভাবছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। এরই অংশ হিসেবে জরুরি বৈঠকে বসেন জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল ও ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ। যেখানে সিরীয় শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার বিষয়ে সুপারিশ করা হয়। তবে তেমন কোনো ফলপ্রসূ উদ্যোগ লক্ষ করা যায়নি।

অন্যদিকে এমন পরিস্থিতিতে ব্যাপক হাঙ্গা-দাঙ্গামা চালিয়ে বিভিন্ন স্থাপনা ধ্বংস করছে জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) সদস্যরা।

সর্বশেষ সিরিয়ার ঐতিহ্যবাহী শহর পালমিরার প্রাচীন মন্দির বালশামিন গুঁড়িয়ে দিয়ে শহর দখল করে নিয়েছে তারা। জঙ্গিরা রোমান সভ্যতার নিদর্শন বহনকারী পালমিরা মন্দিরটি ধ্বংস করে উল্লাস করেছে। একের পর এক বিস্ফোরণ ও স্থাপনা দখলের মধ্য দিয়ে তারা বিশ্বের মানুষের কাছে কী বার্তা দিতে চাইছে, তা এখন চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের যেখানেই জঙ্গি সংগঠনগুলো আস্তানা গেড়েছে, সে অঞ্চলের ঐতিহাসিক স্থাপনা তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত বছর ইরাক ও সিরিয়ার খিলাফত ঘোষণার পর আইএস একের পর এক প্রত্নতাত্ত্বিক অমূল্য সব সাংস্কৃতিক নিদর্শন সম্পদ ধ্বংস করেছে। লিবিয়া, মালি ও আফগানিস্তানের মতো বিভিন্ন জায়গায় সাংস্কৃতিক শুদ্ধি অভিযানের নামে প্রাচীন সভ্যতার অনেক নিদর্শন তারা লুট করেছে। মহামূল্যবান এসব নিদর্শন তারা চোরাবাজারে বিক্রিও করে দিয়েছে। প্রাণের ভয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে নাগরিকরা। হাজার হাজার শরণার্থী নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে।

বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি ও ভিডিওতে দেখা গেছে, বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে নারী-শিশুরা সীমান্ত পার হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মায়ের কোলে ক্ষুধার্ত শিশু। বাবার কাঁধে ক্রন্দনরত সন্তান। কাঁটাতারের সীমান্ত ছিন্ন করে তারা পার হতে চায়। সামনে তাদের অজানা ভবিষ্যৎ। কিন্তু তাদের দায়িত্ব নিতে চায় না কেউ। 

শরণার্থীদের ভাষ্যমতে, অনন্যোপায় হয়েই তারা দেশ ছেড়েছে। তাদের ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করছে, তা-ও তারা জানে না। তবে দেশে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তাতে দেশে থাকা সম্ভব নয়।

এমন যুদ্ধবিধ্বস্ত শরণার্থীদের জন্য বিশ্বের মোড়লদের সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে ইউরোপের অন্য দেশগুলোকে তাদের নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী অবৈধ এসব অভিবাসীকে তাদের দেশে আশ্রয় দিয়ে মানবিকতার দিকটি বিবেচনায় নিয়ে আসবেন এবং সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবেন।

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, মেসিডোনিয়া পেরিয়ে সার্বিয়া হয়ে ইইউভুক্ত দেশ হাঙ্গেরি সীমান্তের দিকে ধাবমান আশ্রয়প্রার্থী মানুষের সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে। অবশ্য ঝুঁকিপূর্ণ ও কষ্টকর পথের যাত্রা শেষে ভাগ্যান্বেষী এসব মানুষের ভাগ্যে কী অপেক্ষা করছে, তা বলা এখনই কঠিন। হাঙ্গেরি এরই মধ্যে আশ্রয়প্রার্থীদের প্রবেশ ঠেকাতে ১৭৫ কিলোমিটার সীমান্তে ১৩ ফুট উঁচু কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে রেখেছে। আর এসব নাগরিকের করুণ অবস্থা দেখে সত্যি আমাদের বলতে ইচ্ছা করে, কোথায় আমাদের মনুষ্যত্ব, কোথায় আমাদের বিবেক।

লেখক : সভাপতি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি।