বং এক্সপ্রেস

সেইসব ছাদ ও বারান্দারা

Looks like you've blocked notifications!

ভাবছেন এইটা আবার কেমন বিষয়! এইটাই বিষয় এবং ব্যাপক রোমান্টিক বিষয়। শুকনো লঙ্কা, কালিজিরে, আচার, ডালের বড়ি, লেপ, তোশক, জামাকাপড়, দোলনা, লাফদড়ি, ঘুড়ির লাটাই, পাখির পালক, খাওয়া সিগারেট, অযথা দাঁত বের করে থাকা কিছু শিক কিংবা ইয়া বড় জলের ট্যাঙ্ক, পিঁড়ি, গাছ, মাটির টব, লোহার তার, আরো কত কী বলা যায় এক  জীবন নিয়ে ছাদ। আর এই ছাদের আক্ষরিক না হলেও কিছুটা কাছাকাছি মুক্ত, ছোট সংস্করণ হল বারান্দা।

তো, এখন বহুতল বাড়ির ফ্ল্যাটের  বারান্দা নিরুপায় হয়ে ছাদের ভূমিকা পালন করে রীতিমতো। আমি এখনো ছাদে যাই (ফ্ল্যাটের ছাদে) এবং যখন তখন যাই যেমন রাত দুটো কিংবা তিনটে।  ছাদে গেলে সেই খোলা দরাজ আকাশ, কালপুরুষকে তারা দেখে দেখে আবার ঠিকঠাক বানানো। মাঝে প্লেনের উড়ে যাওয়া আর একেবারে ধারে সারি দিয়ে গাছের রেখা আর প্রগলভ হাওয়া এক কথায় অসাধারণ। এর তুলনা কোনো ভালো লাগার সঙ্গে পেরে উঠবে না। সাহিত্যিক ও ভ্রমণ পত্রিকার সম্পাদক অমরেন্দ্র চক্রবর্তীদার ফ্ল্যাটের ছাদে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার । সৌভাগ্য এই কারণে, বলা বাহুল্য সে এক অপূর্ব ছাদ; কী গাছ নেই সেখানে! ফল, ফুল, বাঁশ গাছ থেকে শুরু করে আর কলকাতার একদিকের অংশ বিস্তৃতভাবে দেখা যেত। গাছ আর ছাদের প্রাবল্যে বাঙালির বাঙলা যে কী মায়াবী হয়ে উঠত পারে, সে বোঝানো যায় না। জানি না অমরেন্দ্রদাদের সেই গাছপূর্ণ ছাদ এখন কেমন আছে সেই ছাদ থেকে অনেকদূর আর দেখা যায় কি না! যাদের ছাদের আশপাশে লম্বা উঁচু উঁচু ফ্ল্যাট উঠে যায়নি, তারা সত্যিই ভাগ্যবান ও বতী। আর বারান্দা সে তো ঘরের মুক্তি তাকে ছাড়া কোনো বাড়ির চেহারা কী পূর্ণ হয়!

ছাদ আসলে বাউণ্ডুলে আর বারান্দার কল্পবোধ আর বাস্তববোধ দুটোই আছে ফলে স্থিতধী। বারান্দারও রকমফের আছে যেমন গোল বারান্দা, চৌকো বারান্দা, সরু, মোটা বারান্দা, গ্রিল ছাড়া বারান্দা, গ্রিল দেওয়া বারান্দা। আর এখানে বাড়ির মেয়ে রোজ দোল খায়। লুকিয়ে থাকে। আর রেলিং ভর দিয়ে এদিক-ওদিক উঁকি মারে। বাবা-মা বিবাহপরবর্তী বাঁচা-কুচা প্রেমের রোমাঞ্চের মেজাজ এখানেই বানাবে বলে বেতের চেয়ার টেবিল পড়ে থাকে, কখনো বা কুরুশে বোনা ঢাকনা দিয়ে টেবিল ঢাকা থাকে। দু-একটা পপি, অর্কিড, পিস লিলি আরো কিছু বনসাই করা গাছ, লতানো বেলি কিংবা বাগানবিলাস বারান্দাতেই আজকাল ক্ষুদ্ররূপ নিয়ে থাকে। এরা সমঝোতা করে বারান্দার সঙ্গেই সংসার করে। বারান্দার স্ট্যান্ডে কিংবা তারে কখনোসখনো ঝোলে জামাকাপড়, যেটুকু রোদ আসে তার মধ্যে বাড়ির বাচ্চার, বাবার জুতো-মোজা, আচার শুকোতে থাকে । শান্তিনিকেতন থেকে আনা পোড়া মাটির পুতুল, শালপাতার পাখি বারান্দার গা ঘেঁষে ঝুলতে থাকে।

ঝড় এলে কচি-কাঁচা ছুটে আসে বারান্দায়, হাওয়ায় চোখ বন্ধ হয়ে আসে তবু প্রাণপণ তারা বাতাস নেয়, ফ্ল্যাটের ছাদ যে অনেক উঁচুতে! বাড়ির বড় হতে থাকা মেয়েটির লুকানো প্রেমের আশ্রয়স্থল ওই বারান্দা, রাতে তারা দেখতে দেখতে তারা প্রেম করে। বারান্দার ক্ষুদ্র বুকে অহংকার বেড়ে যায়। এই বারান্দার সঙ্গে প্রেমের যে কী গভীর সম্পর্ক তা  সিনেমায়, গল্পের বইতে দেখে কিংবা পড়ে সাহিত্যের রসুপিপাসুর নিশ্চয় জানেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভালোবাসার জীবনেও বারান্দার ভূমিকা আছে। আগেকার দিনে বড় বড় জমিদারবাড়ির বারান্দারা যে কী অপরূপ ছিল, তা কিছু হলেও দেখেছি ক্ষয়িষ্ণু অবস্থায়। ঝাড় জ্বলত সেখানে সন্ধ্যেবেলায়, সেই বারান্দা থেকে হাঁক পাড়লে সবাই শুনতে পেত আর পুরো উঠোন চোখের নাগালে আসত এই বারান্দারই সৌজন্যে। সেখানে সকালবেলা কাজের মাসি, গিন্নিরা সবজি, মাছ, ডাঁই করা বাজারদের বঁটিতে সৎকার করতেন। আর দুপুরে সেখানেই লম্বা করে আসন কিংবা মাদুর পেতে পাত পড়ত। আর বেলা যত বাড়ত, রোদ পড়ে এলে সেখানেই জমত নারীদের আড্ডা, পানের কীর্তি আর উল বোনা, সেলাই করা। আর নিশুতি রাতে এই বারান্দা রহস্যে ভরে যেত কোনো কোনো বাড়িতে। কেউ নাকি মল পড়ে হেঁটে যায়, নিশি ডাকলে কোনো বাড়ির মেয়ে বারান্দায় হেঁটে বেড়ায় এমন কত গল্প।

সত্যিই বারান্দা কিন্তু সেকালে বেরোতে না পারা মেয়েদের কাছে ভীষণ স্বস্তির স্থান ছিল। বাড়ির বৃদ্ধ কর্তা এই বারান্দার আরামকেদারায় বসে হুঁকো টানতেন আর নাতি-নাতনিদের গল্প শোনাতেন, এসোজন-বসোজনদের উপদেশ দিতেন। ঘর আসলে নিরাপত্তা আর গোপনীয়তার যৌথতায় তৈরি, কিন্তু মানুষ তো আবেগের লালনে গড়া প্রাণী। তার নিজের প্রাণের সঙ্গেই লুকাচুরি খেলতে মন চায় তাই এই ছোট মুক্তির পথ বারান্দা। যেন শৈশবের কোলে থাকার এক খেলা। আর ছাদের কথা কী বলব, সে আকারে হাবভাবে রাজকীয়। মাথার ওপরে তার বসবাস। তার মায়া কাটানো ভারী মুশকিল। এই ছাদ কত কিছুর সাক্ষী! প্রেম, আত্মহত্যা, লেখকের বা শিল্পীর শিল্পকে বাঁচানো, আকাশকে ভালোবাসতে শেখানো। বিশিষ্ট অভিনেত্রী অপর্ণা সেন নির্দেশিত  সিনেমা ‘গয়নার বাক্স’-তে ছাদ তো এক বিরাট ভূমিকা নিয়েছে। ছাদের পরিবেশ ছাড়া সত্যি কি সেই দৃশ্যগুলো জমতে পারত, যারা সিনেমা দেখেছেন তারা নিশ্চয় জানেন! কত ঘুমিয়ে থাকা ইতিহাস এই ছাদের দেয়াল বহন করে তা ছাদই জানে!

ছাদ নিয়ে এখন যদি বলি তবে তার পরিসর আরো লম্বা হতে থাকব। শুধু বলব ব্যস্ত বাঙালি যখন কোথাও ঘুরতে যেতে পারে না, এরাই তার সঙ্গী। অলস বাঙালি যখন আর কোনো কাজ পায় না এই ছাদ আর বারান্দারাই তাদের অণুপ্রেরণা। যারা একা থাকেন ছাদ আর বারান্দারা তো তাদের বিশেষ সুহৃদ। ছাদ যে প্রেমের ফল্গুধারার নারী-পুরুষে জাগাতে পারে তার আহ্লাদই আলাদা... আসুন আমরা ছাদ ও বারান্দার হয়ে উঠি... আমাদের ঘরের প্রাণ ওখানে শ্বাসবায়ু জমিয়ে রাখে যে... ।

লেখক : কবি, পশ্চিমবঙ্গ।