বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামকে ক্রিকেট জাদুঘরে পাঠিয়ে দিল আইসিসি!

Looks like you've blocked notifications!

ক্রিকেটের বিশ্বায়নের স্বপ্ন দেখেছিলেন ভদ্রলোক। কারণটাও ছিল খুব পরিষ্কার। অন্যান্য খেলার সঙ্গে বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে থাকতে হলে ক্রিকেটকে ছড়িয়ে দিতে হবে। এই দর্শন নিয়ে তিনি আইসিসির প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। অর্থ ছাড়া ক্রিকেট নামক খেলাটার প্রসার এবং মান উন্নয়ন সম্ভব নয়। কিন্তু অর্থ কোথায়? এর উত্তরটা তিনি পেয়েছিলেন নিজের ব্যবসায়িক মস্তিষ্ক থেকে। খেলাটা টেলিভিশনের মাধ্যমে বেশিসংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারলে বেশি পরিমাণ অর্থ আসবে। এবং সেটা টেলিভিশন সম্প্রচার স্বত্ব আর বিজ্ঞাপণের বাজার থেকে। তার জন্য প্রয়াত জগমোহন ডালমিয়াকে লড়াই শুরু করতে হয়েছিল নিজের দেশ থেকে। আইন-আদালতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। আইসিসির দায়িত্ব নিয়েও নিজের বাণিজ্যিক দর্শন থেকে সরে আসেননি তিনি।

ক্রিকেট বিপণনের জন্য খুব ভালো পণ্য। সেটা তিনি আইসিসির বাকি কর্তাদের বোঝাতে পেরেছিলেন। কাজটা করেও দেখিয়েছিলেন। তিনি যখন আইসিসির দায়িত্ব নেন তখন বিশ্বক্রিকেট সংস্থার কোষাগারে জমা মাত্র হাজার বিশেক পাউন্ড। বছর তিনেকের মধ্যে সেই অঙ্কটাকে সাত মিলিয়ন পাউন্ডে নিয়ে যান। এই বাণিজ্যিক বিপ্লব তিনি ঘটিয়েছিলেন ক্রিকেটের বিশ্বায়নের স্বপ্ন থেকে। আর তাঁর স্বপ্নযাত্রা শুরু ঢাকার বঙ্গবন্ধু ক্রিকেট স্টেডিয়াম থেকে। আইসিসি বিশ্বকাপের আদলে আরো প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক এক টুর্নামেন্ট ‘মিনি বিশ্বকাপ’ চালু করলেন। পরবর্তী সময়ে সেই টুর্নামেন্ট আইসিসি চ্যাম্পয়িনস ট্রফি নামে দারুণ জনপ্রিয় হলো। বাণিজ্যিকভাবেও লাভজনক হলো। সেই লাভের বড় অংশটা ক্রিকেট বিশ্বের অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোকে দেওয়া শুরু হলো। পাশাপাশি ক্রিকেটের বাজার সম্প্রসারণের চেষ্টা হলো। বাংলাদেশকে রোল মডেল হিসেবে তিনি দাঁড়ও করিয়ে দিলেন। চীনের মতো বিশাল জনগোষ্ঠীর দেশ ক্রিকেটের বড় বাজার হতে পারে। সেটাও আঁচ করলেন। ভারত-পাকিস্তান রাজনৈতিক বৈরিতা ভুলে চীনের ক্রিকেট উন্নয়নে সাহায্যের হাত বাড়াল। নেপথ্যে সেই ডালমিয়ার মস্তিষ্ক। পরিকল্পিতভাবে, ধাপে ধাপে ক্রিকেট নামক খেলাটকে গোটা কয়েক টেস্ট প্লেয়িং দেশের কোটর থেকে বের করে আনলে কি হয়, তার প্রমাণ আজকের বাংলাদেশ। শুধু ক্রিকেট বাজার নয়, ক্রিকেট প্লেয়িং দেশ হিসেবেও বাংলাদেশ আজ শক্ত অবস্থানে দাঁড়িয়ে। এটাও জগমোহন ডালমিয়ার উন্নত ক্রিকেট আর ব্যবসায়িক মস্তিষ্কের চিন্তনপ্রাণালি থেকে বেরিয়ে আসা প্রোডাক্ট।

ডালমিয়া বিপ্লব ঘটাতে পেরেছিলেন আাগমী দিনের কথা চিন্তা করে। আগামীর ক্রিকেট বিশ্বকে দেখতে পেয়েছিলেন তিনি। সেটা ক্রিকেটীয় চিন্তায়। কিন্তু এরপর তাঁর স্বদেশি ক্রিকেট কর্তারা ক্রিকেটকে দেখছেন সোনার ডিম পাড়া হাঁস হিসেবে।গত শতাব্দির শেষ দিকে ভারত মুক্তবাজার অর্থনীতির জামানায় প্রবেশ করার পর থেকে ফেঁপেফুলে উঠছে ভারতীয় অর্থনীতি। ক্রিকেট তাদের কাছে এখন বড় এক পণ্য। যা গোটা পৃথিবীকে গেলানোর চেষ্টা হচ্ছে। বিশ্বের যে গোলার্ধেই ভারতীয়রা আছেন, সেখানে ক্রিকেট আফিমের মতো বিক্রি হচ্ছে। ক্রিকেট নেশাগ্রস্ত মানুষের সংখ্যাও দিনে দিনে বাড়ছে। তাই আরো বেশি উত্তেজক ব্র্যান্ড হিসেবে ‘টি-টোয়েন্টি’-কে বিক্রি করা হচ্ছে। মানুষ কিনছে। আর সেই ক্রেতাদের তালিকায় যখন ভারতীয়দের সংখ্যাটা অনেক বেশি, তখন ভারতীয় ক্রিকেট কর্তারাই এখন ক্রিকেটের ব্র্যান্ড স্বত্ব দাবি করা শুরু করেছেন। অর্থের মানতণ্ডে তাঁদের দাবির যৌক্তিকতা বিচার করা হচ্ছে। ভারতীয়দের দাবির গায়ে সমর্থনের সিলছাপ্পর মেরে দিতে দ্বিধা করেননি ইংলিশ ও অস্ট্রেলিয়ানরা। কারণ, কিছু পাউন্ড-ডলার গোনার সুযোগ তারাও পাচ্ছেন এবং সেটা সৌজন্যে ভারত।

ক্রিকেটের বিশ্বায়নের স্বপ্নদ্রষ্টা জগমোহন ডালমিয়া প্রয়াত। এবার তাঁর শহর কলকাতায় বসেই তাঁর স্বপ্ন সৃষ্টিরকেও সমাধিস্থ করা হলো। ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দেওয়া হলো আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফির। ঠিক কুড়ি বছর পর বন্ধ করে দেওয়া হলো ডালমিয়ার চালু করা চ্যাম্পিয়ন ট্রফি। সেই টুর্নামেন্টের পরিবর্তে এখন দুই বছর পর দুটো করে ‘কুড়ি -–কুডি বিশ্বকাপ’ হবে।

ডালমিয়ার চালু করা চ্যাম্পিয়নস ট্রফির যাত্রা শুরু ’৯৮ সালে ঢাকার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে। নন টেস্ট প্লেয়িং একটা দেশ কত সফলভাবে এ রকম একটা বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে পারে, সেটা দেখেছিল ক্রিকেট বিশ্ব। এক ছাদের তলায় নয় নয়টা টেস্ট প্লেয়িং দেশের ক্রিকেটারদের বসবাস। একটা স্টেডিয়ামে খেলা। গ্যালারি দর্শকে ভরা। ক্রিকেটের বিপণন আর বিজ্ঞাপণের জন্য বাড়তি কিছু কী আর দরকার ছিল। সেই বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম থেকে মিনি বিশ্বকাপ জিতে নিলো নেলসন ম্যান্ডেলার দেশ সাউথ আফ্রিকা। এ যেন ইতিহাসের অন্যরকম এক যুগলবন্দি। এ রকম সফল আয়োজনের পর ক্রিকেট গ্রহের প্রথম নিরপেক্ষ ভেন্যু হিসেবে টেস্ট আয়োজনের সুযোগ পেল বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম। মাত্র এক বছর পর সেখানেই বাংলাদেশ খেলেছিল তাদের ইতিহাসের প্রথম টেস্ট। এবং সেটা ভারতের বিপক্ষে। চ্যাম্পিয়নস ট্রফি বেঁছে থাকা মানে তাঁর জন্মকথায় ‘আতুঁড় ঘর’ হিসেবে চিহ্নিত ছিল বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম। কলকাতায় আইসিসির সভায় সেই চ্যাম্পয়িনস ট্রফির ডেথ সার্টিফিকেট লেখা হলো। তাতে বাংলাদেশেরও নিশ্চয়ই সই আছে। আইসিসি চ্যাম্পয়িনস ট্রফি এখন মৃত। আর বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামও এখন ক্রিকেট জাদুঘরে।

আইসিসিতে তিন মোড়লের কেচ্ছা নিয়ে ইংরেজিতে একটা ফিল্ম তৈরি হয়েছিল কিছুদিন আগে। ‘ডেথ অব অ্যা জেন্টেলম্যান।‘ তাঁরা এবার উদ্যোগী হতেই পারেন, সিকোয়াল তৈরির।

লেখক : সিনিয়র স্পোর্টস জার্নালিস্ট।