বং এক্সপ্রেস
কপালের সেই চাঁদ
আমার মনে পড়ে ছোট্টবেলায় ছবির সঙ্গে লেখা বইগুলো বাবা নিয়ে আসত। সেইগুলো ছিল মজার পড়াশোনো। ও ধরনের বইতে দেখতাম মায়ের মতো কে যেন একটা ছোট্ট বাচ্চা কোলে নিয়ে চাঁদমামাকে দেখাচ্ছে। আমার খুব ওই টিপের দিকে মন যেত। লাল গোল টিপ। আমার মাকেও ছোটবেলায় আমি হরেক রকমের টিপ পরতে দেখেছি। কাঁচ লাগানো টিপ, গোল রং-বেরঙের, লম্বা টিপ । আর আয়নার কোণে নিত্য পরা টিপগুলোর ভিড় থাকত। আমি বড় আয়নায় হাত পেতাম না, টিপগুলো দেখতাম কেবল। এখন আমিও টিপ পরি। আমি অবশ্য শুধু কালো গোল টিপ পরি। কিছুদিন আগেও টিপ পরা একদমই পছন্দ করতাম না। কিন্তু মনের কোনো কোনো জায়গা বোধ করি পৃথিবীর সব নিয়তি থেকে পূর্ববর্তী কোনো শিখন নিয়ে থাকে, কারণ আমরা যা অভিজ্ঞ প্রতিক্রিয়া দেই মাঝেমধ্যে যেন সবই জানা! এই তো এই টিপ না পরা শূন্য আকাশে যখন হুট করে চাঁদ আঁকলাম। দেখলাম আকাশের তথা কপালের বেশ গর্ব হয়েছে।
আসলে প্রত্যেক খালি ভাব সেই ফাঁকা মুহূর্তকে ভালোবেসে ফেললেও একটা সময়ের পর সে বোধ করি এক কণা বিন্দুকেও কাছাকাছি চায়, নিজেকে ভরাটভাবে প্রকাশ করতে। আর একেকটা মেলবন্ধনই এক প্রকার হয় যা একে অপরকে প্রতিভাত করে নব নব রূপে। আমরা তো শুনেইছি কোনো এক শাড়ির ব্যান্ডের বিজ্ঞাপনে ‘ছোট্ট টিপ, হালকা লিপস্টিক আর সম্ভবত কী যেন সেই শাড়ির নাম’। অতএব শাড়িকে প্রতিভাত করতে সেই টিপের এক তীব্র দায়িত্ব আছে। টিপ নিয়ে যেমন সংস্কারের কথা আছে তেমনই কিছু বাজে ইতিহাস শ্রুতিতে আছে। যেমন শোনা যেত, বিজিত রাজ রাজরারা তাদের আঘাতের রক্ত দিয়ে পরাজিত নারীকে চিহ্নিত করতেন সেই থেকে কোনো এক দাসত্ব বোঝাতে এই টিপের প্রচলন শুরু হয়।
আবার সনাতন হিন্দু ধর্মে নাকি কিছু সৎ কারণ দর্শানো হয়েছে যেমন মাটির লাল টিপ শক্তি, স্থৈর্য, শান্তি, সন্তান ইত্যাদির সমৃদ্ধির নাকি পরিচয় বহন করে। হিন্দু ধর্মের বিবাহসম্পর্কিত সিঁদুরের ব্যবহার তো সবারই জানা সেই বিষয়ে আর কথা তুললাম না। তবে এখন মানুষ অনেক উন্নত, জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা ও সচেতন। ফলে নিজস্ব আনন্দ, লাগা, সংস্কার-কুসংস্কার, বিজ্ঞান কোন পথে সে নিজেকে চালিত করবে তারা এখানে সেই অর্থে মেয়েরা জানে। তবে কুমকুমের টিপ বা ধর্মবিশ্বাস থেকে পরিহিত টিপ যে সবসময় মেয়েরাই পরে এসেছে তা কিন্তু নয় । ছেলেরাও সেই সময় ভীষণভাবেই টিপ পরত। রাজটিকা দিয়ে রাজার অভিষেক , কিম্বা বিজয়ের পর তার উৎসবে শামিল হতে রাজা-রানি, নারী-পুরুষ নির্বিশেষেই টিপ পরত। আর কালো টিপ পড়ে কুনজর থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার বিশ্বাস বহু অঞ্চলে বহুল প্রচলিত। শিশুকে সাধারণত এই কারণেই কাজলের টিপ পরানো হতো।
এখন লাগার নিজস্ব সংবেদনশীলতায় নারীরা টিপ পরে। নকশা করা টিপ, পাথরের টিপ, কুমকুমের টিপ, আলপনা দেওয়া টিপ। শুনেছি টিপের ব্যবসা করেই এক নারী তার জীবনের কুটিরশিল্প শুরু করেছিলেন তারপর লাগার বাহুল্য আজ তা ব্র্যান্ড সম ব্যবসা। কতখানি পরীক্ষিত সত্য তা না জেনেও শোনা যায় চোখের সব সিলিয়ারি পেশি, শিরা-উপশিরার নাকি একটি মুখ্যস্থল কিম্বা মুখমণ্ডলেরও মুখ্যস্থল নাকি দুই ভ্রুর মাঝখান ফলে এই অংশে ক্ষণিকের চাপও নাকি ইতিবাচক। কিম্বা এই টিপ পরা মুখের দৃশ্য দৃশ্যতই নাকি মনের পক্ষে ইতিবাচক! আমরা রকমারির ঝকমারিকে মনে রাখি না, পরিবর্তনশীলতা আমাদের উজ্জীবিত করে । আমরা একই পথের বিভিন্ন কাঠামোতে সুখ বোধ করি। আমাদের ছদ্ম আলো লাগে, যেমন চাঁদের মায়া। তেমন এই ছদ্ম টিপ... কোনো এক গানে এ রকম কলি ছিল 'মিথ্যে হোক তবু ভালো তো বাস' ...কিছু কিছু যাপনের মুহূর্ত আমাদের কাছে এত মায়াবী যাচনার তাকে আমরা ছদ্ম জেনেও গ্রহণ করে ফেলি। অবশ্য সেদিক দিয়েই টিপ ছদ্ম হলেও ক্ষতিকারক নয়। যেহেতু দুই চোখের মধ্যমণি হয়ে তার অবস্থান তাই তার প্রকাশ ও প্রভাব দুই তীব্র। আমাদের অজস্র জীবন এককের মাঝেও এইগুলোই রঙিন সম্পদ যা ভরিয়ে রাখতে তুলনাবিহীন। এগুলো অপরিহার্য না হয়েও ব্যবহারের মাহাত্ম্যে, স্মৃতিতে, সাহিত্যে, মননে এমনভাবে দানা বাঁধে যা একটি দাগের মতো হয়ে আমূল বেঁচে থাকে ও বাঁচিয়ে রাখে। আমার মায়ের কাছে শুনেছি তাদের ছোটবেলায় দুপুরে রেডিওতে রহস্য বা ভূতের গল্প শোনা যেত। আমরা সেভাবে রেডিও সংস্পর্শ পাইনি। সেখানে এক ডাকপিয়ন এক বাড়িতে চিঠি বিলি করতে যেত, সে ঘন দুপুরে বাড়ির বউয়ের পিঠ ছাড়া চুল বড় বড় চোখের মাঝে বড় টিপের সংযোজন এতই অতিরিক্ত হয়ে উঠত যে তা ভয়াবহ জায়গায় পৌঁছাত আর সেই ডাকপিয়নের শিহরণ জাগত।
ভূত-পেত্নীর গল্প সংকলনে 'সেই মুখ' বলে একটি চমৎকার গল্প পড়েছিলাম ছোটবেলায়, আমার মাসতুতো ভাই সে আসলেই ওই গল্পটা মাকে পড়ে শোনাতে বলতেন আর তার একটা ছবি ছিল ওই বইতে আশ্চর্য ভয়ঙ্কর , তার কপালেও টিপের ব্যবহার ও বাহুল্য ছিল দেখার মতো এবং নিঃসন্দেহে তা ভয় জাগাত মনে। তো এই হল টিপের সাজসজ্জা একটা ছোট্ট শিল্পকর্ম প্রেম থেকে ভয় উভয় জাগাতেই ওস্তাদ।
লেখক: কবি, পশ্চিমবঙ্গ