অভিমত

‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা’

Looks like you've blocked notifications!

শিরোনামটি দুই শব্দে এবং বন্ধনীর ভেতরে রাখার উদ্দেশ্য হলো, গণমাধ্যম বলতে আমরা কী বুঝি এবং স্বাধীনতা বলতে ঠিক কার স্বাধীনতা––সেটি ব্যাখ্যার দাবি রাখে।

প্রতি বছর ৩ মে বিশ্বব্যাপী পালিত হয় মুক্ত গণমাধ্যম দিবস। এখানে ‘মুক্ত’ এবং ‘গণমাধ্যম’ শব্দ দুটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। প্রশ্ন হলো এই মুক্তি কার জন্য ?  প্রশ্নটি এমন এক সময়ে আমরা করছি, যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুক অনেক সময় মূলধারার গণমাধ্যমের চেয়েও অধিকতর ‘শক্তিশালী’ বা ‘প্রভাবশালী’ হয়ে উঠছে।
রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিভিন্ন ইস্যুতে এমন অনেক কিছুই আমাদের ফেসবুক ওয়ালে দৃশ্যমান হয়, সাংবাদিকতার ভাষায় যার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কিন্তু এসব ভুয়া, বানানো ভিডিও ও ছবি বিশ্বাস করার লোকেরও অভাব নেই। ফলে আমরা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বা গণমাধ্যমের মুক্তি নিয়ে যখন কথা বলছি, তখন আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এই সোশ্যাল মিডিয়ার প্রপাগাণ্ডা বা অপপ্রচার।

সব গণমাধ্যমই মাধ্যম, কিন্তু সব মাধ্যমই গণমাধ্যম নয়। সেই অর্থে সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কোনো অর্থেই গণমাধ্যম নয়। যদিও বা সেটি মাঝেমধ্যে গণমাধ্যমের চেয়ে অধিকতর প্রভাবশালী কিংবা মূলধারার গণমাধ্যমকে প্রভাবিত করে। প্রভাবিত করার অনেক উদাহরণও এরইমধ্যে তৈরি হয়েছে। আবার এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে অনেক বড় ঘটনা (গণজাগরণ মঞ্চ, কোটা সংস্কার আন্দোলন) ঘটে গেলেও মূলধারার গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা এবং দায়বদ্ধতার প্রশ্নটি অনেক সময়ই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

আমরা কেন গণমাধ্যম বলতে মূলধারা শব্দটি ব্যবহার করছি? কেন শুধু গণমাধ্যম বললেই বিষয়টি পরিষ্কার হচ্ছে না?  কারণ ইন্টারনেটের এই দুনিয়ায় যখন হাতে হাতে স্মার্টফোন এবং ইন্টারনেট সহজলভ্য, তখন এর সুযোগ নিয়ে ভুরি ভুরি অনলাইন সংবাদপত্রের জন্ম হচ্ছে, যাকে অনেকে ব্যাঙের ছাতার সঙ্গে তুলনা করছেন। এসব ব্যাঙের ছাতা প্রচলিত অর্থে হয়তো গণমাধ্যম, কিন্তু তার বিশ্বাসযোগ্যতা বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ। চটকদার শিরোনামের ভেতরে কোনো ‘সংবাদ’ নেই। যা আছে তা প্রপাগাণ্ডা, অপপ্রচার, বিভ্রান্তি। শুধু তাই নয়, এসব কথিত গণমাধ্যমের ‘খবর’ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে সামাজিক মাধ্যমে এবং এসব বিশ্বাস করার লোকের অভাব নেই। বিশ্বাস করেই তারা ক্ষান্ত হচ্ছে তা নয়; বরং এসব প্রপাগাণ্ডায় বিশ্বাসীরা এসব খবর ভাইরাল করছে, যাচাই-বাছাই ছাড়াই এসব খবরের বিষয়ে ‘বুদ্ধিদীপ্ত’ মন্তব্য জুড়ে দিচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের অনেকে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, আমাদের দেশের মানুষ এখনো ফেসবুক ব্যবহারের যোগ্যতা অর্জন করেনি। কথাটিকে সাধারণীকরণ করা হয়তো যৌক্তিক নয়, কিন্তু বাস্তবতা হলো, একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী একইসঙ্গে একজন ব্রডকাস্টার বা সম্প্রচারকারীও। অর্থাৎ পথ চলতে তিনি যদি কোনো দুর্ঘটনা দেখেন, সেটি মূলধারার গণমাধ্যমের ক্যামেরা ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী তাৎক্ষণিকভাবে মোবাইল ফোনে ছবি তুলে বা ভিডিও করে ফেসবুকে দিয়ে দিচ্ছেন। কেউ কেউ ঘটনাস্থল থেকে লাইভও করছেন। ফলে তিনি তখন একজন সম্প্রচারকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ। এখানে মূলধারার গণমাধ্যমের চেয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এগিয়ে। যেমন সিলেটের শিশু রাজনকে পিটিয়ে হত্যার দৃশ্য ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছিল বলেই মূলধারার গণমাধ্যম সেই ছবি ব্যবহার করেই সংবাদ প্রচার করে এবং দেশের ইতিহাসে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ওই ঘটনার বিচার হয়।

পক্ষান্তরে এই ফেসবুকে এমন সব মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর ঘটনাবলিও ভাইরাল হয়, যেগুলো ব্যবহার করে একশ্রেণির অনলাইন সংবাদপত্র সংবাদের মোড়কে সেগুলো প্রকাশ করে। ফলে তখন পুরো সাংবাদিকতাই প্রশ্নের মুখে পড়ে। আমরা যতই ডিজিটাল হচ্ছি, ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ানোর প্রবণতাও বাড়ছে। ফলে আমরা যখন গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলি, তখন আমাদের সুস্পষ্টভাবে বুঝতে হবে, গণমাধ্যম বলতে আমরা কাদের বুঝব? কোনটি বিশ্বাস করব বা করব না।
কোনো একটি সংবাদ দু তিনটি টেলিভিশনে প্রচারের পরও সেটি যত না দ্রুত মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে, তার চেয়ে অনেক দ্রুত ছড়ায় ফেসবুকে প্রচারিত কোনো খবর। কারণ ডিজিটাল সুবিধার কারণে প্রান্তিক মানুষও এখন ইন্টারনেটে সংযুক্ত। তা ছাড়া বাঙালির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে সে ভালো খবরের চেয়ে খারাপ খবর বা প্রপাগাণ্ডায় বেশি বিশ্বাস করে। ফলে যতই বলা হোক যে, মূলধারার একাধিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত না হলে কোনো খবর বিশ্বাস করবেন না, সেই কথায় কান দেয়া লোকের সংখ্যা কম। বরং যেহেতু এখনও আমাদের দেশের মানুষের একটা বড় অংশই অল্পশিক্ষিত এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত নয়, ফলে তাদেরকে যেকোনো বিষয়ে প্রভাবিত করা বা উসকানি দেয়া সহজ।

ফলে আমরা যখন গণমাধ্যম এবং বাকস্বাধীনতার কথা বলি, তখন এটিও বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন যে, বাকস্বাধীনতা বলতে আমরা কী বুঝি? আমার যা খুশি তাই বলা, অন্যের সম্পর্কে যা কিছু লেখা বা সত্যমিথ্যা যাচাই না করে কিছু একটা প্রকাশ করে দেওয়াকে আমরা বাকস্বাধীনতা বলব কি না? আবার ব্যক্তিগত চরিত্রহনন, ভুল তথ্য দিয়ে মানুষকে উসকানি দেওয়াকে আমার গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বলতে পারি কি না?

‘আর্টিকেল ১৯’ নামে একটি বেসরকারি সংগঠনের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৭ সালে দেশে ৩৩৫টি ঘটনা ঘটেছে যা বাকস্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করেছে। এর মধ্যে ৭০ শতাংশই ঘটেছে তৃণমূল পর্যায়ে। এখানে গণমাধ্যম বলতে তারা মূলধারার গণমাধ্যমকেই বুঝিয়েছে।

স্থানীয় সংবাদপত্রের বিকাশ ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে একটি গবেষণার সময় দেখেছি, দেশের বাইরে বিভিন্ন জেলা উপজেলা পর্যায় থেকে যেসব সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়, তার একটা বড় অংশই সাংবাদিকতার কোনো নীতিমালার ধার ধারে না। পয়সা দিয়ে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যেকোনো সংবাদ ছাপানো যায়। সাংবাদিকতার পরিচয় দিয়ে মানুষকে ব্ল্যাকমেইল করার ঘটনা অহরহ ঘটে। এসব সংবাদপত্রের অধিকাংশেরই কোনো পাঠকপ্রিয়তা নেই, গ্রহণযোগ্যতা নেই। এসব সংবাদপত্রের কোনো কর্মী যখন কোনো অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হন, তার প্রতিকারের জায়গা নেই। সুতরাং এসব ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা যাবে?

তার মানে আমরা যখন মুক্ত গণমাধ্যমের কথা বলি, তখন আমাদের এই প্রশ্নটিও করা প্রয়োজন যে, আমাদের গণমাধ্যম কতটা দায়িত্বশীল এবং জনবান্ধব ভূমিকা পালন করছে? কতগুলো সংবাদপত্র, টেলিভিশন, রেডিও এবং অনলাইন পোর্টাল আসলেই ‘গণমাধ্যম’? এই গণমাধ্যমগুলোর একটা বড় অংশই কি কালো টাকা সাদা করার হাতিয়ার নয়? এই গণমাধ্যমগুলোর একটা বড় অংশই কি তার কর্মীদের বিনা বেতনে খাটিয়ে অন্যায় পথে পা বাড়াতে বাধ্য করে না? এই গণমাধ্যমগুলোর একটা বড় অংশই কি কোনো বিশেষ দল বা মতের পক্ষে প্রপাগাণ্ডা চালায় না? এই গণমাধ্যমের একটা বড় অংশই কি করপোরেট পুঁজির দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দি নয়? যদি এসব প্রশ্নের উত্তর হয় ‘হ্যাঁ’, তাহলে আমাদের এই প্রশ্নও তুলতে হবে, আমরা কোন গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলছি…।

লেখক : সাংবাদিক