অভিমত

ট্রাম্পের বাড়াবাড়িতেই কি হত্যাকাণ্ড?

Looks like you've blocked notifications!

বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের বিক্ষোভে ইসরাইলি হত্যাকাণ্ড মানবাধিকারের সর্বোচ্চ লঙ্ঘন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ইচ্ছাকৃত এবং উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে ঘটানো এই হত্যাকাণ্ডটিকে নিঃসন্দেহে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে দাবি করা যায়। ২০১৪ সালে গাজা যুদ্ধের পর এটিকে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী দিন হিসেবে চিহ্নত করা যেতে পারে। এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের মধ্যে নিকৃষ্টতম হলো, ইসরাইলি স্নাইপাররা শিশুদেরকেও নির্মমভাবে হত্যা করেছে। রক্তাক্ত ঘটনা ইতিপূর্বে আরো অনেক ঘটলেও গাজার সাম্প্রতিক গণহত্যার ঘটনাটির বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। নানা কারণে বিশ্বাস করতে হচ্ছে যে, এই ঘটনার রেষ দীর্ঘস্থায়ী হবে। বিশেষ করে গাজার ঘটনায় সাময়িকভাবে হলেও সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সুসম্পর্কে ফাটল সৃষ্টির শঙ্কা রয়েছে। মূলত তাঁদের মধ্যে সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছিল উভয়ের ইরানবিদ্বেষের সূত্রে। গাজার গণহত্যার ঘটনায় সে সম্পর্কে অনিবার্যভাবে চিড় ধরবে- এটাই স্বাভাবিক।

সৌদি আরবের ধর্মভিত্তিক প্রতিষ্ঠিত গোষ্ঠী ও রক্ষণশীল শক্তিগুলো অজুহাত খোজার অপেক্ষায়। গাজার গণহত্যার ঘটনা তাদের সেই সুযোগ করে দিয়েছে। এসব কারণে ইসরায়েলি উসকানিতে ইরানের বিরুদ্ধে কোনো আরব শাসকের সঙ্গী হওয়া জটিল বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অনেক আরব হয়তো ইরানের ব্যাপারে শত্রুভাবাপন্ন, কিন্তু এ ঘটনার পর তাদের অনেকে হয়তো বুঝতে শুরু করবে, তাদের আসল শত্রু হলো নেতানিয়াহু।

১৫ মে ফিলিস্তিনিরা নাকবা দিবস পালন করে। ১৯৪৮ সালের এই দিনে ইহুদি সশস্ত্র গোষ্ঠী ফিলিস্তিনিদের তাদের বাড়িঘর ও জমি থেকে উচ্ছেদ করেছিল। ১৯৪৮ সালের ১৫ মে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয় জাতিসংঘ। এ বছর ফিলিস্তিনিদের সেই নাকবার মুহুর্তেই ট্রাম্প প্রশাসন জেরুজালেমে দূতাবাস স্থানান্তর করল। ফিলিস্তিনিরা শুরু থেকেই এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে। এখনও ফিলিস্তিনিদের বিক্ষোভের মধ্যেই দূতাবাস হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলো। ফিলিস্তিনিদের বিক্ষোভ দমনে ইসরায়েলি সেনারা গুলি চালায়। এটা ভাবতে খুবই খারাপ লাগছে যে, এভাবে যতদিন ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকবেন, ততদিন হয়তো ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের হত্যা করবে, তাদের ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দিবে, ভূমি দখল করবে।

কিন্তু একদিন ট্রাম্প চলে যাবেন। দুই দেশের সমস্যা সমাধানের আশা মরে যাবে। বর্তমান অবস্থা এ কথা বলছে যে, ইসরায়েলের মদদে সংখ্যালঘু ইহুদিরা সংখ্যাগুরু মুসলমানদের ওপর ছড়ি ঘোরাবে, তাদের বঞ্চিত করবে। অথচ ট্রাম্পের আগে ইসরায়েলের সঙ্গে মার্কিন ঐক্য একবার ভেস্তে যাচ্ছিল, যখন নেতানিয়াহু ও আমেরিকান ইসরায়েল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হন। ডোনাল্ড ট্রাম্প এসে তার জোড়া লাগালেন। ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করলেন। এই বন্ধন কেবল ডেমোক্র্যাট থেকে রিপাবলিকানই নয় বরং আমেরিকান ইহুদি থেকে নেতানিয়াহুর সরকার পর্যন্ত।

যদিও গত বছর আমেরিকার ইহুদি কমিটি কর্তৃক পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, আমেরিকার ইহুদিদের মাত্র ২১ শতাংশ ট্রাম্পকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। যেখানে আশ্চর্যজনকভাবে ৬৮ শতাংশই জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তরের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে। খুব সম্ভবত আমেরিকান ইহুদিরা এটা ভাবছে যে, ট্রাম্পকে পরিচালিত করছে খ্রিষ্টানরা। আর ট্রাম্প হয়তো ইসরায়েলকে গণতন্ত্র থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে এবং নিরাপত্তা নিয়েও সংকট তৈরি হবে। তার চেয়েও বড় বিষয় হয়তো তারা ট্রাম্পের ‘শান্তির’ বুলিতে আস্থা আনতে পারছে না। কারণ তারা বাস্তবে শান্তির বিপরীতটাই দেখছে।

ইসরায়েল ১৯৬৭ সালে অস্ত্রের জোরে জেরুজালেম দখল করে নিয়েছিল। দখল করা বিভিন্ন ভূখণ্ডে ইসরায়েল অনেক পরিবর্তন ঘটিয়েছে। যেমন- গোলান মালভূমিতে অনেক অবৈধ বসতি স্থাপিত হয়েছে, সেখান থেকে অনেক জ্বালানি তেল চুরি গেছে, সেখানে ইসলামিক স্টেট ও আল-কায়েদার জন্য অনেক অস্থায়ী হাসপাতাল তৈরি করেছে ইসরায়েল। এসব সত্ত্বেও গোলান এখনো সিরিয়ার। জেরুজালেমের মতো গোলান মালভূমিও দখলকৃত ভূমি। কিন্তু আন্তর্জাতিক আইনে অথবা বিশ্বের অন্যান্য সরকারের কাছে দখলটা নজরে পড়েনি। সত্যি বলতে কী, গত ৫০ বছর প্রত্যেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাঁদের দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তরের অঙ্গীকার করেছেন, অন্তত নির্বাচনী দৌড়ঝাঁপের সময়। কোনো প্রেসিডেন্ট অঙ্গীকার পূরণের পথে না হাঁটলেও ব্যতিক্রম শুধু ট্রাম্প।

ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত যে শেষ পর্যন্ত রক্তগঙ্গা বইয়ে দেবে, সেটা বোধ হয় তিনি বুঝতেই পারেননি। তাঁর চারপাশের পেশাদার লোকজন কিন্তু ঠিকই সেটা বুঝেছিল। বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর এই বিতর্কিত সিদ্ধান্তের অনুকূলে কোনো প্রতিনিধিত্বশীল আন্তর্জাতিক বা পশ্চিমা সম্প্রদায়ের সাহায্য-সমর্থন কুড়াতে সক্ষম হবেন বলে প্রতীয়মান হয় না। একদিকে ট্রাম্প তাঁর নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণ করার কথা বললেও এ বিষয়ে কোনো সংশয় নেই যে, কিছু প্রশ্ন সত্ত্বেও ফিলিস্তিন-ইসরায়েলি সংকটে যুক্তরাষ্ট্র যে এক মর্যাদাসম্পন্ন ও নির্ভরযোগ্য মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে আসছিল, ১৪ মে তার কবর রচিত হয়েছে।

তবে সভ্যতা সুরক্ষার স্বার্থে এই সমস্যার সমাধান হতেই হবে। মার্কিন পদক্ষেপের কারণে বিশ্ব বিবেক নিশ্চয় স্তব্ধ ও আন্তর্জাতিক আইন অন্ধ হয়ে যাবে না। এখন শঙ্কা থাকবে, আরব ও মুসলিম বিশ্বের রাজপথ যদি ফুঁসে ওঠে, তাহলে বিশ্বের দেশে দেশে মার্কিন বিরোধিতা আরও বাড়তে পারে। গাজায় যে সহিংস প্রতিবাদ, তা নিশ্চিতভাবেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের দায়িত্বহীন আচরণের প্রতিক্রিয়া।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্রফেশনাল স্টাডিজ।