ব্যঙ্গ বাস্তব

শান্তি নাই মনে, চলো যাই বনে

Looks like you've blocked notifications!

ডিমের হালি একদিনে কয়েক টাকা বেড়ে যাওয়ায় বিরক্ত হয়ে দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম, ডিমের দাম এত বাড়ল কেন?

—বিদ্যুতের দাম বেড়েছে তাই। দোকানদারের ঝটপট উত্তর।

—বিদ্যুতের সাথে ডিমের সম্পর্ক কী?

প্রশ্ন শুনে আমার দিকে কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে রইল। যেন সৃজনশীল প্রশ্ন জীবনে প্রথম শুনছে।

—সুয়েজ খালের মতো মুখ হাঁ করে রেখেছেন কেন? ইসরায়েলি জাহাজ ঢুকে যাবে। প্রশ্নের উত্তর থাকলে দেন।

আমার আর তর সইছে না। এবার গলা কেশে পাল্টা প্রশ্ন করলেন দোকানদার।

—ডিম কারা পারে?

—কারা মানে? মুরগি!

—মুরগি থাকে কোথায়?

—মুরগির খামারে!

—মুরগিকে খামারে সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখতে কী দিতে হয়?

—তাপ ও বাতাস!

—তাপ ও বাতাস দিতে কী চালু রাখতে হয়?

—লাইট আর ফ্যান!

উত্তর দিয়ে আমিই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। আসলেই তো, আগে খেয়াল করি নাই। ডিমের সাথে দূরতম হলেও বিদ্যুতের সম্পর্ক আছে।

—এবার আপনার সুয়েজ খালটা বন্ধ করে বলেন, কয়টা ডিম দেবো?

দোকানদারের তাচ্ছিল্য মেনে নিতে পারলাম না। ডিম না কিনেই বাসায় ফিরে এলাম। রিকশাওয়ালাকে ১০ টাকা অতিরিক্ত ভাড়া দিতে হলো। কীভাবে যেন সে শুনেছে তেলের দাম বেড়েছে। তাঁর রিকশার চাকার বেয়ারিংয়ে নাকি নিয়মিত তেল দিতে হয়। তেলের ব্যবহার সরাসরি করছে বলে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করাটা নাকি তাঁর জন্য ‘জায়েজ’।

তেল-বিদ্যুতের দাম বেড়েছে বলে তো আর না খেয়ে থাকা যায় না? হোটেলে খাবার বিলে দেখি, ভ্যাটের সঙ্গে এক্সট্রা বিল যোগ করা হয়েছে। মেজাজ এমনিতেই সপ্তাকাশে ছিল। ম্যানেজারকে ডেকে যা শুনলাম, তাতে ডিপফ্রিজের মতো ঠান্ডা হয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। গ্যাস বিল বেড়েছে। তাঁদের খাবার-দাবার সব রান্না হয় গ্যাসে। ভ্যাট যেহেতু কাস্টমার থেকে নেওয়া হয়ে থাকে, তাই তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, অতিরিক্ত গ্যাস বিলও কাস্টমার থেকেই নেওয়া হবে। অভিনব পদ্ধতি দেখে নতুন বুদ্ধি এলো মাথায়। সে মাসের বিদ্যুৎ বিলের পাশাপাশি গ্যাস বিল ও অতিরিক্ত সিএনজি ভাড়ার ভাউচার জমা দিলাম অফিসে। মাস শেষে বেতনের সঙ্গে অফিস এসব বিলের সমপরিমাণ টাকা দিতে বাধ্য থাকিবে মর্মে একটা পত্রও দিলাম।

পরের দিন অফিসের সুন্দরী রিসিপশনিস্ট আমায় পাল্টা পত্র ধরিয়ে দিল। পত্র হাতে পেয়ে ভালোই লাগছিল। সেই কৈশোরে থাকতে বড় ভাইদের দেখতাম, চিঠি চালাচালি করে প্রেম করতে। এই মেইল, ফেসবুক, হটসঅ্যাপের যুগে চিঠির মাধ্যমে প্রেম? আইডিয়াটা মন্দ নয়। প্রেমপত্র পড়তে হয় গোপনে। ডানে-বাঁয়ে না তাকিয়ে সোজা চলে গেলাম ওয়াশরুমে। পত্র খুলে মাথায় বাজ পড়ার দশা। ‘আমাকে আর এ অফিসে আসার দরকার নাই’ মর্মে এই অব্যাহতি পত্রখানা বসের দেওয়া। তার মানে চাকরিতে লাল বাতি জ্বলে গেছে। ‘ভিক্ষা চাই না কুত্তা সামলা’ স্টাইলে বসের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করলাম। লাভের লাভ কিছুই হলো না। প্রায় ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে অফিস থেকে বের করে দিল। দেশটার হলো কী?

এত দিন ‘বাড়তি’ ইস্যুতে নানা জায়গা থেকে শুধু লজ্জা পেয়েছি, এবার রীতিমতো অপমানিত হলাম। এই অপমান কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। কী করা যায়...ভাবছিলাম। এক কলিগ পরামর্শ দিলেন, ‘অবাসযোগ্য শহরের তালিকায় দুই নম্বরে থাকা শহর ছেড়ে চলে যান। একেবারে বনে। বনবাস।’

তাই তো, বিষয়টি এত দিনে মাথায় আসে নাই কেন? অবাসযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়। একটুর জন্য হয়তো প্রথম হতে পারি নাই। প্রথমে আছে সিরিয়া। যেখানে যুদ্ধবিগ্রহ লেগে আছে বলে ঢাকা পেরে উঠে নাই। তা ছাড়া আমাদের হারানোর মতো কাউকে দেখছি না। যে শহরের মানুষকে প্রতিনিয়ত তীব্র যানজটের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়, পাঁচ মিনিটের বৃষ্টিতে গলা সমান পানির সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়, ভাঙাচোরা রাস্তার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়, সিএনজি/রিকশাওয়ালার সঙ্গে ন্যায্য ভাড়া নিয়ে যুদ্ধ করতে হয়, ভাড়াটিয়াকে বাড়িওয়ালার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়, কাঁচাবাজার, মাছ দোকানির সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়, সে শহরকে বাসযোগ্য শহরের তালিকায় রাখে এমন সাধ্য কার?

তাহলে ভাই, আমরা রবিযুগে ফিরে যাই? মানে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলেন এই নগর একদিন বাসযোগ্য থাকবে না। তাই তিনি বলেছিলেন, ‘দাও ফিরিয়ে সে অরণ্য, লও এ নগর।’ এরচেয়ে ভালো বনে চলে যাবো। ‘ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড’-এর ব্রিয়ার গিলসের মতো জোক, শুঁয়োপোকা, গাছের বাকল-টাকল খাবো। রান্নার ঝামেলা নাই। পেঁয়াজের প্রয়োজন নাই। গ্যাস লাগবে না। দিনে সূর্য, রাতে চাঁদ। বিদ্যুতের দরকার নাই। গাছের শেকড়, লতাপাতা ধরে ঝুলে ঝুলে এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে যাতায়াত করব। রিকশা, বাস, সিএনজি ভাড়া লাগবে না। সব মিলিয়ে লাইফ উইল বি বিউটিফুল।

সমস্যা হচ্ছে, সবাই যদি আমার মতো বনের রাস্তা ধরে, তাহলে তো সেখানেও লতাপাতা জ্যাম (এখানকার ট্রাফিক জ্যামের মতো) বেঁধে যাবে। এ ছাড়া একাধিক মানুষ থাকলে একজন নেতা হয়ে উঠবে। একজন নেতা হয়ে উঠলে সরকারব্যবস্থা গড়ে উঠবে। সরকার মানে তো আবার সেই...!

মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ : রম্য লেখক