দৃষ্টিপাত

পর্দার আড়ালে মালয়েশিয়ায় যা ঘটেছে

Looks like you've blocked notifications!

২০১২ সালের ডিসেম্বরে ড. মাহাথির বিরোধী দলের সাথে কাজ করতে শুরু করেন এবং নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। এই সম্পর্কের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশজুড়ে ছিল আনোয়ারকে পুনরায় ক্ষমতায় ফেরানো এবং তাঁর মুক্তি এবং ক্ষমা সুরক্ষিত করা। নাজিবের পতন, আইনের শাসন পুনর্বহাল এবং রাজনৈতিক সংস্কারের ডাক দেওয়ার মাধ্যমে চলতি মাসে ৯২ বছর বয়সী মাহাথির বিরোধীদের জয় ছিনিয়ে নেন। ১৯৯০ সালে আনোয়ারের যে এজেন্ডাগুলো এক সময় সমালোচনার শিকার হয়েছিল সেগুলোই এখন গ্রহণ করা হচ্ছে সেই ব্যক্তির দ্বারা যিনি এক সময় তাঁকে প্রত্যাখ্যান করে শাস্তি দিয়েছিলেন। এবার আনোয়ারের মুক্তির মাধ্যমে দুজন পুনরায় জোট বেঁধেছেন এবং তারা একইসঙ্গে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন রাজনৈতিক সংস্কারের।

এই দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে আনুগত্যের পরীক্ষার লড়াইটা ছিল স্পষ্ট। কারণ তাদের একজন এক সময় আরেকজনকে কারাগারে পাঠিয়েছিলেন। সদ্য নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ ও আনোয়ার ইব্রাহিমের মধ্যে এই সম্পর্কের গল্পটি এতটাই নাটকীয় যে, একে কেউ কেউ শেক্সপিয়রের নাটকের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ১৯৯৯ সালে দেশটির অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তিনি আনোয়ার ইব্রাহিমকে দুর্নীতি এবং সমকামিতার অভিযোগে জেলে পাঠিয়েছিলেন। এখন মাহাথিরের বিজয়ের সাথে সাথে আনোয়ার ইব্রাহিম কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী তিনিই হতে যাচ্ছেন এমন সংবাদও গণমাধ্যমে ফলাও হয়েছে। এটাও এক পরিহাস যে,  তিনি একদা তথাকথিত সমকামিতার অভিযোগে মিত্র থেকে শত্রুতে রূপান্তরিত হওয়া যে আনোয়ার ইব্রাহিমকে কারাগারে পুরেছিলেন,  সেই আনোয়ারের আশীর্বাদ ও তাঁর দলের সমর্থিত প্রার্থী হিসেবেই মাহাথির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন।

মালয়েশিয়া তাঁর রাজনীতির ইতিহাসের একটা অভূতপূর্ব পালাবদল দেখছে। মূলত সাধারণ মানুষ ‘মিথ্যা ও হয়রানিমূলক’ মামলায় দণ্ডিত ইব্রাহিমকেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত করেছেন। তিনি দণ্ডিত, তাই নির্বাচনে অযোগ্য। মাহাথির অবশ্য নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে ইব্রাহিমকেই দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন।

সাম্প্রতিক দেশটির রাজনীতিতে পট পরিবর্তনে পর্দার আড়ালের বাস্তবতা হলো, ইব্রাহিমই গেম মেকার এবং চেঞ্জার। মাহাথির পুষ্পবৃষ্টির মধ্য দিয়ে শপথ নিয়েছেন। সাধারণ মানুষ তাঁর ভুল স্বীকার করা, ঔদার্য ও মহত্তম উদাহরণ তৈরির জন্যই তাঁকে এভাবে স্বাগত জানিয়েছেন। একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে মাহাথির ও ইব্রাহিমের এই বিরল সমঝোতা বা রিকনসিলিয়েশন সত্যিই এক বিস্ময়। গণতন্ত্রকে যে ‘আর্ট অব কম্প্রোমাইজ’ বলা হয়, মালয়েশিয়া তা বিশ্বকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। ৯২ বছর বয়সী ড. মাহাথির ২২ বছরের বেশি সময় মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। যেহেতু তাঁর তখনকার শারীরিক অবস্থা আর বর্তমান শারীরিক অবস্থা অবশ্যই এক রকম নয়। সে হিসেবে তিনি ইব্রাহিমকেই বেছে নিতে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। তাঁর এই সিদ্ধান্তটির যথেষ্ট যৌক্তিকতা রয়েছে।

বিভিন্ন কারণেই বর্তমান অবস্থায় মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে যথেষ্ট চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি ড. মাহাথির যে দায়িত্ব নিয়ে অবসর থেকে আবার রাজনীতিতে ফিরে এসেছেন (তাও আবার নিজের নেতৃত্ব দেওয়া জোটের বিরুদ্ধে), তা ভবিষ্যতে সঠিক পথে চালিত যদি না হয়, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে সাধারণ মানুষ। এবারের নির্বাচনে মালয়, চায়নিজ ও ইন্ডিয়ানদের মধ্যে একটি বিভাজন আচ্ছাদিত থাকলেও ভবিষ্যতে ঘটনাপ্রবাহের ধাক্কায় সেই আচ্ছাদনটি যদি খুলে যায়, তাহলে তা আন্তগোষ্ঠী বিরোধে পরিণত হতে পারে। আর যদি গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে সব দল তাদের  কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে এবং মাহাথিরের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রেখে মালয়েশিয়ানদের ঐক্যবদ্ধ করে সামনের দিকে এগোতে থাকে, তবে আশা করা যায় মালয়েশিয়ার মানুষ একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ পাবে। 

এ ছাড়া ভবিষ্যতে জোটে নতুন কোনো মেরুকরণ যে হবে না সে সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সত্যি বলতে কি, রাজনীতিতে কত কিছুই তো ঘটে থাকে, যা কখনো কেউ আগাম কল্পনা করতে পারে না। মাহাথিরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করার ব্যাপারে ইব্রাহিম বলেন, ‘আমার লক্ষ্য দেশের মঙ্গল। মাহাথির আমার মুক্তির জন্য অক্লান্ত চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। সংস্কারের লক্ষ্যেও তিনি অবিচল। আমার তাঁর প্রতি ক্ষোভ থাকবে কেন?” তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক এখন অত্যন্ত ইতিবাচক। আর মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন জোটের শরিকদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং সহনশীলতা। তবে এত দিন যাঁরা বলে আসছিলেন, মাহাথির উন্নয়নের গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, সদাশয় স্বৈরাচার এবং বিরোধীদলীয় মতামত কম গ্রাহ্য করেছেন, এবারের অনন্য পর্বে তাঁকে সেই অভিধায় ফেলা যাবে না। শত্রুকে মিত্র হিসেবে মেনে নিয়ে যে অনন্য নজির স্থাপন করেছেন তা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্রফেশনাল স্টাডিজ।