বং এক্সপ্রেস

ঘাটজুড়ে সব গল্পগাছা

Looks like you've blocked notifications!

বাংলার এই গঙ্গা, পদ্মা আরো কতশত নদী ও তাদের ঘাটের গল্প যেন এক জীবন্ত চলমান ইতিহাস! বাংলার সমস্ত গল্পে, কবিতায়, জীবনে এই নদী, পুকুরের ঘাট অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে।আমাদের এই প্রত্যেক শহুরে বেঁচে থাকার মধ্যে একটা শীতল মায়াবী গ্রাম্য ধারা অগোচরে বইতে থাকে।আমি আমার দিদার কাছে শুনেছি যখন তারা নদীয়া জেলার শিমুলতলায় থাকতেন সেখানে জলঙ্গী তথা খোড়ে নদীর বান আসত, যেই ভয় পেয়ে দূরে সরে যেতেন। সেই নদীতেই সারাবছর তারা সাঁতার কেটে বেরাতেন। আমি নিজে একবার ঘুরতে গিয়ে গৌরাঙ্গ সেতুর কাছাকাছি ধার দিয়ে নিচে নেমেছিলাম সতর্ক সন্ত্রস্ত ভাবে। সে যে কী অপূর্ব, যেন কোনো স্বপ্ন দেখছি। নিচে এক ছোট্ট মন্দির আর সবুজ ঘাস একদিকে আর একদিকে নদীর চড়া। নদীর মধ্যে  ছোট্ট নৌকো বয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর এত শান্ত পরিণত পরিচ্ছন্ন রূপ বোধহয় নদীর ঘাটেই পাওয়া যায়।

বারাণসীতে গঙ্গার ঘাট সেও এক জীবন বহন করে। একটি সংস্কারহীন বাউন্ডুলে ছেলে সময়ের বহু কিছুর সঙ্গে জেহাদ করে এই নদীর কোলে এসে নিজেকে মুক্ত করে। একজন সংস্কার সম্পন্ন মানুষও তার নিত্যদিনের যাচনা, স্নান, কর্মকে একীভূত করে। কোনো স্বামী হারা নারীর সমস্ত সুখ হয়ত এই নদীর ঘাটই মুছে দিত চিরতরে। আকাশকে ক্ষণিক আদরে ধারণ করার নদী অগণতি মানুষের জীবনের এক একটা সময়ের গল্পকে ধারণ করতে ঐতিহাসিক প্রস্তরের মতো। ইতু পূজার ব্রতকথার যে গল্প তাতে শোনা যায় তাতে দরিদ্র, ক্ষুধার্ত ব্রাহ্মণ সংক্রান্তির পিঠে-পুলি খাওয়ার জন্য সে নদীর বসে ফন্দি আঁটত, কীভাবে কখন গুড় ভর্তি নৌকো নদীর তীরে আসে! সেই আশায় কাদা দিয়ে দিয়ে নদীর তীর সে পিছল করত যাতে মাঝি এসে গুড়ের হাড়ি নিয়ে পিছলে পড়ে আর সে সেই ফাঁকে গুড় জোগাড় করে নিতে পারে। নদী বা পুকুরে  বিয়ের সেই জল সাধতে যাওয়া আর হয়তো অকালে স্বামী হারানো মেয়েটার সেই নদীতেই সিঁদুর রং মুছিয়ে দিল পড়শিগণ। তারপর সাম্প্রদায়িকতার কতশত ছদ্ম ভুলের খুনে লাল রং জলের আড়ালে লুকিয়ে পড়ত বা পড়ে কেউ টেরও পায় না।

বাংলাদেশে রাজশাহীতে পদ্মা নদীর ঘাটে বসে দেখেছি সে জনজীবনের মুক্তিকে আহ্লাদে ধারণ করে রেখেছে। নদী সত্যি এক মা আর তার ঘাটগুলো তার কোল। যাতে বাবা-বাছার মতো আমাদের জীবনের কর্ম- অপকর্মরা বিনা বাধায় সাধিত হয়। এই চূড়ান্ত ডিমনাটাইজেশনের সময় রাশি রাশি অবৈধ টাকার বস্তা ঝুলি নদীর বুকে ভেসে উঠত। বিদেশিদের নদীর ঘাটের মতো নয়।

বাঙালির সব কর্ম-অপকর্ম এর দায় এই নদীমাতৃক ঘাট বহন করে। এই ঘাটের পাশে কৈশোরের প্রথম প্রেমে হাওয়া লাগে। এই ঘাটের মধ্যে বসে বেকার যুবক তাস খেলে সময় কাটায়। এই ঘাটের বুকে মৃতপ্রায় গাছের চারা আবার বেঁচে ওঠে। কুচুরিপানার দল জল বেয়ে বেয়ে এগিয়ে চলে যায়। আর কুকুরগুলো গ্রীষ্মের এই তীব্র দাবদাহ থেকে সরে এসে নদীর হাওয়া গায়ে লাগিয়ে চোখ দুখান মুদে রাখে, আর লেজ নাড়ে, বোধ করি বুঝতে পারে এ পৃথিবী তারও কিছুটা। বসন্তের বিকেলে কোকিলের ডাক, আলো-ছাড়া গোধূলির কবিতা ভরা এই নদীর ঘাট গরীবের তীর্থস্থান, ভ্রমণের ভ্রাম্য সুখ। বাড়িতে গুরুত্ব কমে আসা বৃদ্ধের ঠকঠক লাঠির আওয়াজ এই ঘাটের বুকে বেজে বেজে ওঠে। বস্তির দু-একটি ছিন্ন পরিবার যারা পাখার হাওয়া কী জানে না, বোঝে না তারা এখানে চট পেতে শোয়। ঘুগনিওয়ালা, ফুচকাওয়ালা যাদের আজও কোনো স্থায়ী স্টল নেই তারা এই ঘাটে আসে, সংসারের বাতাস বানায়।

আমাদের যা কিছু জট বুকের ভেতর এসে কানাকানি করে, বাঙালি তো অসহায় জাতি নিজস্ব কারণে, তাই তার ভরে ওঠা জ্বালা সে নদীর বুকে এসে খুলে দেখতে পারে, এক কলি গান গেয়ে উঠতে পারে ‘আলোকেরই ঝর্নাধারায় ধুইয়ে দাও”।

নদীর এই জোয়ারে, ভাঁটায় ঘাটের রূপ বদল হয়। সাঁকোগুলো তবু বলে আছি, ঘাটও বেঁচে থাকে কেবল রং বদলায়। ভোরে বড় বড় হাড়ি নিয়ে জেলেরা আসে মাছ উঠে আসে। বাঙালির পাতে পাতে প্রোটিনের ছড়াছড়ি হয়, তবু কেন এত অসহায়তা জাগে যেখানে দরিদ্র থেকে ধনীর মতো করে বেঁচে থাকে শহর! বোধ হয় তেমন ভালোবাসিনি আমরা, শিখিনি ভালোবাসার গদ্য ও কবিতারূপ। যে নদী ও তার ঘাট এতকাল আমাদের বাঙালি দস্যিপনা সহ্য করল আজ তার বয়সে আমরা কি তাকে একটুও আদর করতে পারি না। পৃথিবীর নব নব প্রেম এখানে জেগে থাকে। আমাদের নদী মা –এর ঘাট কোল বাঁচিয়ে রাখি চলুন। অসহায় না হয় রইলাম তবু কী খচ্চর ধর্ম থেকে বেরোতে পারব না আর?

লেখক : কবি, পশ্চিমবঙ্গ