বং এক্সপ্রেস

দুধে-মাছে বাঙালি

Looks like you've blocked notifications!

ঝাঁ চকচকে বং থেকে গোবর্ধন অবধি সকল পেটুক বাংলা শব্দ ব্যবহারকারীর দল কিন্তু দুধে-মাছে পুষ্টতাকামী। কী ভীষণভাবে এটা আমাদের চিহ্নিতকরণের সংকেত ভাবলে অবাক হবেন না, তবু বলি আমি বহু জায়গায় গিয়ে যখন বলেছি মাছ খেতে তেমন পছন্দ করি না, লোকে আমায় ছে ছে করেছে বলেছে, বাঙালি হয়ে মাছ খাও না, সেকি কথা। নিউট্রিশনের একটা সেমিনারে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন খাদ্যের স্পেশালিটি সম্পর্কে কথা হচ্ছিল, সেখানেও দেখি বাংলার প্রাতঃরাশের তালিকায় বিশেষ পুষ্টিসুম্পন্ন খাদ্য হিসেবে দুধ-মুড়ির স্থান। দুধের উপকারিতা বা ওই জাতীয় গরুর রচনা লিখে আমি পাঠকগণকে বিব্রত করব না। তবু এ কথা তো সত্য দুধ-ভাত কিংবা দুধ-রুটি, দুধ-মুড়ি আম সহযোগে বিখ্যাত ও ধনী হয়ে ওঠে। আর সন্দেশ, ছানা এসব কত কী যে দুধ বানাতে পারে, তার ইয়ত্তা নেই বলে কাজ নেই। তবে নদিয়া জেলার অধরের সরপুরিয়া আর পয়ধি (একপ্রকারের দই) যদি না খেয়েছেন, তবে বুঝবেন দুধ আসলে কতখানি প্রতিভাবান হয়েছে বাঙালির জিভের অত্যাচারে।

মাছের এমনি প্রতিভা বা ফ্লেভার, যা তীব্র প্রভাবশালী তা আমি বুঝেছি এক অদ্ভুত মুহূর্তে। আমি সাধারণত মাছ খাই না, তবে রান্না দেখে খুব লোভনীয় মনে হলো ওই ঝোলটা ভাত দিয়ে মেখে খেতাম। তা হলো কী একবার সিকিম ঘুরতে গিয়ে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়ি, মুখের স্বাদ প্রায় নষ্ট। ওখানে সবই কম সেদ্ধ খাবার, তার মধ্যে কোল্ডস্টোরেজের সবজি। হঠাৎ আমি মাকে বললাম, আমি যে কবে গিয়ে দিদার হাতের মাছের ঝোল ভাত খাব! মা তো শুনে হতবাক ভূতের মুখে এ মহা রামনাম। সেদিন বুঝেছি, ভেতরে কোথাও বাঙালপনা লুকিয়ে লুকিয়ে ফুটছে আর অজান্তে সে আমার মধ্যেও বহমান! কী মেছো প্রভাব রে বাবা! ফিরে এসে সত্যি আমি তৃপ্তি করে মাছ-ভাত খেয়েছিলাম, যদিও ধেড়ে মেয়েকে মা কাঁটা বেছে খাইয়ে দিয়েছিল।

এই যে এখন আমাদের এখানে পশ্চিমবাংলায় ‘মাংস বিশু’ নামক কোনো এক উদ্ভট লোকের পাল্লায় পড়ে মাংসের ময়লা নয়ছয় কাণ্ড রাজ্যজুড়ে শুরু হয়েছে। তাতে বাঙালির যে খুব দুর্গতি হয়েছে, তা কিন্তু নয় (এটা অন্য সাপেক্ষে বলছি) কারণ মাছ তো বাঙালির রক্তের সম্পর্ক। আমিও প্রতিকূল অবস্থায় রেস্তোরাঁয় বসে ভার্জিন মোজিটো সহযোগে স্টিম ফিশ, বেকড ফিশ, ফিশ স্টেগ অগত্যা উপভোগ করছি।

বিশিষ্ট লেখক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘বাজার সফর সমগ্র’, যা আজকাল প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত, সেই বই আসলে খাদ্যরসিকতার এক তুমুল বই। অপূর্ব সব রচনা খিদেকে এক নৈসর্গিক আবেদন দেয়। ২০০২ সাল ও তার পরবর্তী সময়ে বাজারের দাম, প্রভাব ও মনোভাবের এক আদুরে মেজাজ ছড়িয়ে আছে তার লেখায়। খাদ্য যে এক শিল্পের মতো বাঙালির জীবনে জড়িত তা এখানে স্পষ্ট। ‘আড় জ্ঞানে আড়ট্যাংরা’, ‘পমফ্রেট থেকে মোকাসিন’, ‘ধানিপোনা দিয়ে ধাড়িপোনা কেনা’, ‘মৎস্যের ন্যায্য দর হয় না’, ‘মাছের মায়েরও দরদ আছে’, ‘ইরাবতীর ইলিশ ও মাছ ডাকাতি’ কিংবা ‘ইলিশের কোনো ঠিকানা নেই’—আশা করি নামেই বুঝতে পারছেন কী চূড়ান্ত জীবন ও খাদ্যরসিক হলে এবং বাঙালির রোজনামচার নাটকীয় মাছভক্তি তিনি গোচরে এনেছেন।এসব নাম শুনে, লেখা পড়ে আপনি খাবারের প্রেমে নিতান্ত বেরসিক হলে তবেই পড়বেন না।

দুধ দিয়ে চালের গুঁড়া কিংবা সাবু কিংবা এই যে বাচ্চাদের জন্য সেরেল্যাক, ডেক্সোল্যাক সব দুধের মাহাত্ম্যকে মানদণ্ডে রেখেই পুষ্টিমূল্যে অবতীর্ণ হয়। তারপর এখন সিসিডির স্টাইলিশ সব মিল্কশেক ছাড়া প্রায় নিতান্তই অকেজো। শুনেছি পূর্ববঙ্গে থাকত মায়ের ঠাকুমার বাড়িতে মাসুম বলে এক ছেলে দুধ দিয়ে যেত, সেই দুধ হাতে নিলে তেলতেলে হয়ে যেতে। বাড়িতে ঘি, দই, সন্দেশ তৈরি হতো। শুনেছি ভিয়েন বসত তার কাছে নাকি এখনকার ক্যাটারিং নস্যি। বাঙালির খাদ্য মীমাংসায় যদি সব বাদও যায়, দুধে আর মাছে তারা কেল্লাফতে করে দেবে। কদিন আগেই একটি বিদেশি ভ্রমণসংস্থার প্রচারে দেখছিলাম যে ব্রিটিশরা মাছের ব্যাপারে খুবই সুখী জাতি, তাই এই কাটলেট, ফিশ ফ্রাই মানে কাঁটামুক্ত আরামদায়ক ফিল পদ্ধতিতে খাওয়া তারা পছন্দ করে, তা হলো কী বাঙালির এই ইলিশ ব্রিটিশদের মুখে লেগে গেল, কিন্তু এত কাঁটাকে নিয়ন্ত্রণ করা মুশকিল হয়ে গেল, তবে ওই যে বলে না ইচ্ছে থাকলে উপায় হবেই। তো ইচ্ছের এমনই তীব্রতা যে তারা এক অদ্ভুত পদ্ধতি নিয়ে ইলিশকেও বাগে এনে ফেলেছিল। মাছের শরীর ছুরি দিয়ে কেটে কেটে কাঁটা আলাদা করে তাকে উপভোগ করল, যদিও এটি সময়সাপেক্ষ। এমনি এমনি তো আর বাংলায় তারা এত দিন নাচন-কোদন করেনি!

লেখক : কবি, পশ্চিমবঙ্গ।