কাপ যুদ্ধ

রণকৌশল নিয়ে রুশ মাটিতে যোদ্ধারা

Looks like you've blocked notifications!

যুদ্ধটা শুরু হয়েই গেল। রাশিয়ায় যা শুরু হলো সেটা কী মহাযুদ্ধ নাকি বিশ্বযুদ্ধ! একটা কাপকে ঘিরে যে লড়াই গোটা বিশ্বজুড়ে, তাকে বিশ্বযুদ্ধ বললে খুব বাড়িয়ে বলা হবে না। তা ছাড়া বিশ্বযুদ্ধের ছায়াকে তো জড়িয়ে আছে বিশ্বকাপের ইতিহাসে। দু’দুটো বিশ্বকাপকে ছিনিয়ে নিয়েছে দু’দুটো বিশ্বযুদ্ধ। গত শতাব্দীতে ৪২ আর ৪৬ সালের বিশ্বকাপ ইতিহাসের পাতায় থাকবে বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসাবশেষ হিসেবে! তা না হলে বিশ্বকাপ মহলার একুশকাহন নয়, তেইশ কাহন-ই লিখতে হতো এবার।

বিশ্বকাপকে বিশ্বযুদ্ধ বলুন আর মহাযুদ্ধ বলুন, এই যুদ্ধ নিয়ে গোটা পৃথিবীতেই অন্যরকম এক আবহ। পৃথিবীর বাতাসে বারুদের গন্ধ নেই। গোলা কামানের শব্দ নেই। তবুও কখনো পৃথিবীর এক গোলার্ধ স্তব্ধ হয়ে পড়ছে। কখনো আরেক গোলার্ধ কাঁপছে উত্তেজনায়। ভাসছে আনন্দ উচ্ছ্বাসে। সেটা এশিয়া থেকে আফ্রিকা কিংবা ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা থেকে দক্ষিণ আমেরিকা সব জায়গায়। তারপরও স্বস্তির একটা জায়গাও আছে। শুরু হয়ে  যাওয়া যুদ্ধের পরিণত কী হবে, তা না জানলেও যুদ্ধটা এক মাসের বেশি স্থায়ী হচ্ছে না সেটা নিশ্চত। ১৫ জুলাই শেষ হবে এই কাপ যুদ্ধ।

বিশ্বযুদ্ধ। মানে সেখানে অনেক জোট-টোট থাকে। এই যুদ্ধে অবশ্য সেটা নেই। কেউ কাউকে পাশে পাচ্ছে না। নিজের শক্তিতেই সবাইকে লড়তে হচ্ছে। সেটা পারস্য সভ্যতার দেশ ইরান থেকে শুরু করে আরব বসন্তে ক্ষত-বিক্ষত আফ্রিকান দেশ মিশরকেও। বিশ্বযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থ জাপান, তারাও রাশিয়ায় গেছে জয়ের নেশায়। অর্থনৈতিকভাবে খুব একটা সমৃদ্ধ না হলেও আফ্রিকান দেশ তিউনিসিয়া, যারা একমাত্র আফ্রিকান দেশ, বিশ্বকাপে অংশ নিয়েই ম্যাচ জিতেছিল  তারাও নতুন কিছু জিততে চায়। আর এই জয়ের পথে কেউ কাউকে সামান্য সাহায্যের হাত বাড়াবে না। সামান্য ছাড়ও দেবে না। তবে হ্যাঁ, কখনো কখনো যুদ্ধটা মনে হতে পারে আন্ত:মহাদেশীয় যুদ্ধ। যেখানে সবচেয়ে দুর্বল শক্তি এশিয়া। পেট্রো ডলারের জোরে বিশ্ব অর্থনীতি চাঙা বা মন্দা করায় ভূমিকা রাখা মধ্যপ্রাচের দেশ সৌদি আরব বুঝেছে এই যুদ্ধটা অন্যরকম। এখানে মার্কিনিদের সাথে সুসম্পর্ক রেখেও কোন লাভ নেই। রুশ ফুটবলীয় গোলাবারুদে রীতিমত বিধ্বস্ত তারা শুরুতেই। তবে এশিয়া কিন্তু আন্ত:মহাদেশীয় যুদ্ধে যৌথ শক্তি হয়ে গেছে। অস্ট্রেলিয়া, যারা নিজেরাই একটা মহাদেশ এই বিশ্বকাপ যুদ্ধে তারা এশিয়ার প্রতিনিধি! যদিও এশিয়ানরা তাদের সমর্থন করবে এমনটা ভাবার কোনো লক্ষণ দেখছি না!

 বরং এশিয়ানরা অনেক বেশি ঝুঁকে আছে ল্যাটিন আমেরিকানদের দিকে। বিশেষ করে বিশ্বফুটবলের দুই মহাশক্তির দিকে তাদের সমর্থনটা অনেকে বেশি। আর বাংলাদেশে তো ব্রাজিল -আর্জেন্টিনা জনভোট হলে কে জিতবে সেটা বলা মুশকিল। ব্রাজিলের দিকে বাঙালির পক্ষপাতিত্বের একটা কারণ না হয় বুঝলাম, গত শতাব্দীতেই তারা চারবার বিশ্বকাপ জিতেছিল। এই শতাব্দীতেও একবার জিতেছে। একটা প্রজন্ম প্রাথমিকের পাঠ্যপুস্তকেই পড়েছেন  'পেলে' নামে এক কালো মানিকের আত্মজীবনী। যিনি নিজে তিন তিনবার বিশ্বকাপে চুমু দিয়েছেন। তিনটা বিশ্বকাপ জয়ের মেডেল যার ড্রয়িংরুমে। একটা প্রজন্ম এখনো নষ্টালজিক ফুটবল সম্রাট বলতেই!

আবার আর্জেন্টিনা? যারা প্রথম বিশ্বকাপেই ফাইনাল খেলেছিল। আবার ৭৮ সালে নিজের দেশে বিশ্বকাপ জিতেছিল। কিন্তু তারপরও দেশটা প্রায় অপরিচিত ছিল বাঙালির কাছে। সেটা পরিচিতি পেলো ম্যারগারেট থ্যাচার নামক এক ব্রিটিশ লৌহ মানবীর সৌজন্যে। আশির দশকের গোড়ায় ফকল্যান্ড যুদ্ধ শুরু হলো ব্রিটেন ও আর্জেন্টিনার মধ্যে। সেই যুদ্ধে ব্রিটিশরাই জিতেছিল। কিন্তু তার প্রতিশোধ নিলো আর্জেন্টাইনরা '৮৬তে। পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চির এক ভদ্রলোকের সৌজন্যে। ফুটবল ঈশ্বর যার প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখিয়েছিলেন। ফুটবল গ্রহে ঈশ্বর তাঁকেই এক মাত্র হাত দিয়ে গোল করার অধিকার দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। তিনি নিজেও অবশ্য ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বারবার বলেছেন: তিনি তো আর তাঁর হাত দিয়ে গোল করেননি! ওটা তো ছিল 'হ্যান্ড অফ গড'। হ্যাঁ, ডিয়েগো ম্যারডোনা নামক ছোটখাটো এই ভদ্রলোক বাঙালির হৃদয়ে জড়ানো নীল -হলুদ জার্সিটার অর্ধেকটাই ছিঁড়ে নিয়ে গেলেন। বাঙালির একটা প্রজন্ম তাঁর সৌজন্যেই হৃদয়ে জড়িয়ে নিলেন আকাশি নীল জার্সি! সেই জার্সি যাদের হৃদয়ে জড়ানো তাদের স্বপ্নের ভার বয়ে বেড়াতে হচ্ছে গত কয়েকটা বিশ্বকাপে লিওনেল মেসি নামের একজনকে। ঈশ্বর নাকি তাঁকে আবার অন্যগ্রহ থেকে এই ফুটবলগ্রহে পাঠিয়েছেন!

তবে সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হতে পারে, ল্যাটিন আমেরিকার দুই প্রতিবেশী ব্রাজিল-আজেন্টিনা কোন ম্যাচে মুখোমুখি হয়ে গেলে। গোটা বিশ্বের হৃদস্পন্দন বাড়তে পারে এই ম্যাচকে ঘিরে। আবার বাংলাদেশে ম্যাচ শেষে থমকে যেতে পারে বহু মানুষের হৃদস্পন্দন! দুই ইউরোপিয়ান প্রতিবেশী তো প্রথম রাউন্ডে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই মুখোমুখি। স্প্যানিশদের সাথে পর্তুগীজদের লড়াই। এই লড়াইটা অবশ্য অনেক পুরনো। স্পেন কাতালান রাজ্য দখল করে নিয়েছিল সেই ১৭১৪ সালে। তারপর স্পেন থেকে আলাদা হওয়ার জন্য কাতালানদের কত লড়াই। কত আর্তি! গণভোট পর্যন্ত হয়েছে। কিন্তু কাতালানরা ফিরে পায়নি তাঁদের হারানো স্বাধীনতা। কিন্তু তাতে কি! রাশিয়ার এই কাপ যুদ্ধে স্প্যানিয়ার্ড, কাতালান সবাই প্রাণপণ ঝাঁপাবে স্পেনের জয়ের জন্য।

রাশিয়ায় এই ফুটবল যুদ্ধ শুরুর আগেই বেদনায় নীল ইউরোপের এক পরাশক্তি। সেই নীল চোখের মানুষগুলে এবার রাশিয়ায় আসার ছাড়পত্রই পায়নি। চার চারবারের বিজয়ী ইতালি ছাড়া বিশ্বকাপ! ভাবা যায়! কিন্তু এটাই বাস্তবতা। যুদ্ধ শুরুর আগেই ক্ষত-বিক্ষত কত মানুষের হৃদয়। আবার আইসল্যান্ডের মত একটা দেশ, যে দেশটার লোক সংখ্যা মাত্র কয়েক হাজার। যারা বছরের বেশিরভাগ সময় থাকেন বরফে আচ্ছন্ন, তারাই উষ্ণতা ছড়াতে এসেছে বিশ্বকাপে! ফুটবল ঈশ্বরের এও এক রসিকতা।

হ্যাঁ, ফুটবল ঈশ্বরের রসিকতা সে তো নতুন কিছু নয়! চেরিফুলের রংয়ে যারা ফুটবল বিশ্বকে রাঙিয়েছে বারবার, টোটাল ফুটবল নামক এক শব্দযুগল ঢুকে পড়লো যাদের সৌজন্যে ফুটবল অভিধানে, সেই ডাচরাও নেই এই যুদ্ধে! তিন তিনবার ফাইনাল খেলে বারবার হতাশা হয়েছে যাদের সঙ্গী তারা রাশিয়া পর্যন্ত পৌঁছুতেই পারলো না। স্বগর্বাসী হুয়ান ক্রুয়েফ ওপারে বসে, এক আইরিশ ভদ্রলোককে বলতেই পারেন, 'জর্জ, তোমার দুঃখ তুমি বিশ্বকাপ খেলতে পারোনি। আমার হতাশা ফাইনাল খেলেও কাপ ছুঁয়ে দেখতে পারিনি। সেই হতাশা আরো বাড়িয়ে দিল ওরা। এখন আমার দেশের ছেলেগুলো রাশিয়ায় যাওয়ার সামর্থ্যও রাখে না!'

এরকম হতাশার পাশাপাশি কত আনন্দ-উচ্ছ্বাসের কাব্য রচিত হয়েছে এই বিশ্বযুদ্ধকে ঘিরে। প্রথম বিশ্বকাপের আয়োজক এবং চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়েকে ঘিরে মাতামাতিটা তাদের নিজেদের দেশের সীমানা ছাড়াতে পারেনি! শুধু প্রথম বিশ্বকাপ কেন? বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ব্রাজিলের মাটিতে ব্রাজিলকে হারিয়ে কাপ জিতেছিল ওরা। গোটা মারাকান স্টেডিয়ামকে নিঃস্তব্ধ করে দিয়ে, ব্রাজিলিয়ানদের হাতাশায় ডুবিয়ে কাপ নিয়ে দেশে ফিরেছিল সুয়ারেস-কাভানিদের পূর্বসূরীরা। সেই কাপ জয়টাই যেন অভিশাপ হয়ে আছে উরুগুয়ানদের জন্য! তা না হলে এতবার বিশ্বকাপ খেলছে, কিন্তু ফুটবলপ্রেমীদের হৃদয় জয় করতে পারছে না। কাপও জিততে পারছে ন! রাশিয়ায় শাপমুক্তির আশাও করতে পারছে বলা যাচ্ছে না উরুগুয়ানরা।

হিটলারের দেশের লোকগুলো বিশ্বযুদ্ধের কথা ভুলতেই পারেন না।  বিশ্বযুদ্ধে ভাগ হয়েছিল জার্মানি পূর্ব-পশ্চিমে। দুই জার্মানির মাঝে বার্লিন প্রাচীর দাঁড়িয়ে যাওয়ার পরও তারা বিশ্বকাপ জিতেছে। আবার বার্লিন প্রাচীর ভেঙে পড়ার পরও জার্মানরা বিশ্বকাপ জিতেছে। রুশিয়ায় অবশ্য জার্মানরাই শুধু গেছে কিছু হারানোর শংকা নিয়ে। কারণ, অন্যদের চ্যালেঞ্জ কাপ জেতা। জার্মানদের চ্যালেঞ্জের নাম—কাপ ধরে রাখা।

ফ্রান্স নিজেদের দেশে গেলো শতাব্দীর শেষ বিশ্বকাপে ফরাসি বিপ্লব ঘটিয়ে প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। কিন্তু রাশিয়া যতই সৌদিকে বিধ্বস্ত করে এই বিশ্বযুদ্ধের কিক অফ করুক না কেন, এবার ফুটবলীয় রুশ বিপ্লবের সম্ভবনা নিয়ে এমকিউসির মত কিছু থাকলে সেখানে বেশিরভাগ ফুটবলানুরাগী টিক চিহ্ন বসাবেন ‘অসম্ভব’-এর আগে। লেনিনের দেশে আবার কোন একদিন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটলে ঘটতেও পারে। কিন্তু এবার রুশরা বিশ্বকাপ জিতবে, সেই সম্ভবনা উড়ে যেতে মার্কিনিদের পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহারের প্রয়োজন পড়বে না।

ও হ্যাঁ, মার্কিনিরা অবশ্য আটলান্টিক পেরিয়ে রাশিয়ায় যাওয়ার সুযোগই পায়নি। তাতেও কি খুব স্বস্তিতে থাকবে রুশরা? থাকতেই পারে অন্য একটা কারণে, নিজেরা এই যুদ্ধ জিততে না পারলেও সুন্দর আয়োজনের মধ্য দিয়ে জিততে পারেন তারা বিশ্ববাসীর মন। আসলে ফুটবল গ্রহের এই মহাযুদ্ধ প্রাণনাশের নয়। হৃদয় জয়ের যুদ্ধ!

লেখক : সিনিয়র স্পোর্টস জার্নালিস্ট এবং কলাম লেখক।