কাপ যুদ্ধ

লাইফ সাপোর্টে আর্জেন্টিনা, হোঁচট সামলেছে ব্রাজিল

Looks like you've blocked notifications!

কাপ-যুদ্ধটা এখন বাগযুদ্ধে পরিণত হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে মূলধারার গণমাধ্যম—সব জায়গায় সেই যুদ্ধের তাপটা টের পাওয়া যাচ্ছে। আর সেই যুদ্ধে নয়া রসদ যোগ হয়েছে এক নাইজেরিয়ানের কারণে। ভদ্রলোকের নাম মোহাম্মদ মুসা। বিশ্বকাপ শুরুর আগে এই মুসার নাম কজন শুনেছেন? কিন্তু ক্রোয়েশিয়ার কাছে আর্জেন্টিনা বিধ্বস্ত হওয়ার পর বাংলাদেশের অর্ধেক মানুষ প্রায় বাকরুদ্ধ। তাঁদের হৃদস্পন্দনই প্রায় থেমে যাওয়ার মতো অবস্থা। তারপরও খানিকটা অস্ফুট স্বরে তাঁরা যা বলছেন, সেটা এক ধরনের বিলাপ। প্রলাপ। কারণ, রাশিয়া বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ডেই তাঁরা আর্জেন্টিনাকে ‘লাইফ সাপোর্ট’-এ চলে যেতে দেখেছেন। আর্জেন্টিনার এই মুমূর্ষু অবস্থার কারণ হিসেবে বাঙালির মনোজগৎ থেকে যেসব এক্স-রে রিপোর্ট বের হচ্ছে, সেটা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে যেভাবে প্রকাশ হচ্ছে, তা দেখে মনে হয় একেকটা মেডিকেল বুলেটিন!

কেউ বলছেন, এই দলটার গোলকিপার ডুবিয়েছেন! কেউ বলছেন, এদের তো ডিফেন্স বলে কিছু নেই। কেউ বলছেন, মিডফিল্ডে কোনো ফুটবলার নেই, যিনি নিখুঁত পাস বাড়াতে পারেন। নেই এমন কোনো ফুটবলার, যিনি প্রতিপক্ষের পা থেকে বল কেড়ে নিতে পারেন। কিন্তু দলটা আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে চলে গেল তার মূল কারণ, এই দলের হৃৎপিণ্ডটা ঠিকমতো কাজ করছে না। আর আর্জেন্টিনার হৃৎপিণ্ড? সেটা তো লিওনেল মেসি। ফুটবল বিশ্ব যে মেসিকে চেনে তাঁকে কি রাশিয়ায় এখন পর্যন্ত কেউ দেখেছেন! কোথায় তাঁর চোখ ধাঁধানো ড্রিবলিং! কোথায় গোলের ঠিকানা লেখা নিখুঁত পাস! কোথায় প্রতিপক্ষের গোলকিপারের রক্তচাপ বাড়িয়ে দিয়ে বল জালে জড়িয়ে দেওয়ার সেই দৃশ্য! এই মেসি তো পেনাল্টি থেকেও গোল করতে পারলেন না! অতএব, যত দোষ সব মেসির। কিন্তু ভদ্রলোক মাঠে পাশে পাচ্ছেন কাদের? যাঁরা খেলছেন মেসির সঙ্গে, তাঁরা কেউ কাউকে চেনেন বলে মনে হয় না। সাম্পাওলি নামক কোচ ভদ্রলোক নিজে কী করতে চাইছেন, সেটাও বোঝা দায়। কিন্তু সব সমালোচনা সইতে হচ্ছে সেই মেসিকে!

সমালোচনা বেড়ে গেছে আরো অনেক কারণে। ম্যারাডোনার ১০ নম্বর জার্সির ভার বইতে হচ্ছে মেসিকে। ম্যারাডোনা পেরেছেন, মেসি পারেন না! এর পাশাপাশি তুলনা চলছে রোনালদো, না মেসি—কে বড় ফুটবলার? এবার সেখানে উপহাসের সুরে আরেকটা তুলনা শুরু হলো! মেসি আর্জেন্টিনাকে আইসিইউতে নিয়ে গেছেন। মোহাম্মদ মুসা কিছুক্ষণের জন্য হলেও আর্জেন্টিনাকে খানিকটা অক্সিজেন দিচ্ছেন! কারণ, নাইজেরিয়ান এই মুসা আইসল্যান্ডের বিপক্ষে গোটা দুয়েক গোল করে আর্জেন্টিনার শেষ ষোলোতে যাওয়ার প্রায় ডুবন্ত স্বপ্নকে আবার খানিকটা জাগিয়ে দিয়েছেন। তবে সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে আবার মেসিকেই অন্য রকম কিছু করে দেখাতে হবে সেই মুসার দেশের বিপক্ষে। কিন্তু এই আর্জেন্টিনার পক্ষে কি সেটা সম্ভব? মেসির দেশের পক্ষে বাজি ধরার লোক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না; বরং মেসির দেশের ফুটবল পণ্ডিত থেকে শুরু করে বাংলাদেশের অলিগলি, পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে প্রান্তিক জনপদের লোকজনও বিশ্বাস করতে পারছেন না, এই আর্জেন্টিনা দলটা তেমন কিছু করতে পারবে। অনেকে বলেই ফেলেছেন, আর্জেন্টিনা শেষ ষোলোতে গেলে সেটাই হবে রাশিয়া বিশ্বকাপের বড় ‘অঘটন’!

আবার কেউ আরেক ধাপ এগিয়ে বলছেন, এই আর্জেন্টিনা রাশিয়া বিশ্বকাপে এসেছে, এটাই তো একটা ‘অঘটন’! বাছাইপর্বে আর্জেন্টিনা যা খেলেছে, তাতে সত্যিই কি সেরা বত্রিশে জায়গা পাওয়ার মতো ফুটবল খেলতে পেরেছিল? কিন্তু অঘটন ঘটিয়ে তারা এসেছে। কারণ, তাদের দলে একজন মেসি ছিলেন। যিনি একা শেষ ম্যাচে ম্যাজিক দেখিয়ে অনেক সমীকরণ মিলিয়ে আর্জেন্টাইনদের রাশিয়ায় নিয়ে এসেছেন। তাই আইসিইউ থেকে বেরিয়ে আর্জেন্টিনা শেষ ষোলোতে পৌঁছাতে পারে যদি মেসি ম্যাজিক দেখা যায় মুসার নাইজেরিয়ার বিপক্ষে।

ফুটবল দর্শকরা কিন্তু রোনালদো ম্যাজিক দেখেছে পর্তুগালের প্রথম ও দ্বিতীয় ম্যাচে। প্রথম ম্যাচে হ্যাটট্রিক। সঙ্গে চোখে লেগে থাকা দুর্দান্ত ফ্রিকিক। পরের ম্যাচেও গোল করে দলকে জিতিয়েছেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। পর্তুগালের এক গরিব ঘরে জন্ম নেওয়ার পর যাঁর বাবা খুব প্রভাবশালী মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের নামের সঙ্গে মিল রেখে তাঁর নাম রেখেছিলেন রোনালদো। তাঁর জয় করার উচ্চাঙ্ক্ষা তো লুকিয়ে নামের মধ্যেই। সেই লোকটাকে ঘিরেই পর্তুগিজদের স্বপ্ন আবর্তিত হচ্ছে। আর তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী মেসির স্বপ্ন এখন অস্তরাগে। আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন এবার অস্ত যেতে পারে প্রথম রাউন্ডেই।

অন্যদিকে আমরা দেখলাম, দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া ব্রাজিল কোস্টারিকার বিপক্ষে ঘুরে দাঁড়াল দারুণভাবে। শেষ বাঁশি বাজার আগে, যোগ করা সময়ে ব্রাজিলের স্বপ্নদৌড় শুরু। সেটা কৌতিনহো-নেইমারদের সৌজন্যে। ব্রাজিল এই নামটার প্রতি বাঙালির একটা বাড়তি মায়া আছে। ব্রাজিল মানে ফুটবল। আর থাকবে না কেন? ব্রাজিলের ভূগোল মানে ফুটবল। তাদের ইতিহাস মানে ফুটবল। তাদের গান মানে ফুটবল। তাদের কবিতা মানে ফুটবল। নাচ মানে সাম্বা আর ফুটবল। তাদের ছবি মানে দেশটার সৌন্দর্য আর ফুটবল। দেশটার অর্থনীতিরও বড় অংশ জুড়ে ফুটবল। অর্থনৈতিকভাবে বেশ দুর্বল দেশটার মানুষের ব্যথা-বঞ্চনা, অভাব-কষ্টের ওপর প্রলেপ দেওয়ার একটাই রূপকথা—ফুটবল। নেইমার-মার্সেইলো-কৌতিনহো-পাউলিনহোরা সেই রূপকথা রাশিয়ায় কীভাবে শেষ করবেন, সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে পায়ে পায়ে ছড়িয়ে পড়া শিল্পের আলপনা কিন্তু আঁকতে শুরু করেছেন ব্রাজিলিয়ানরা। শেষ ম্যাচে দলের নৈপুণ্যের পাশাপাশি ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের ঝলকানিও দেখিয়েছেন কৌতিনহো, নেইমাররা। সুন্দর ফুটবল। শিল্পীর ফুটবল। সেটা ব্রাজিল ছাড়া আর কে দেবে? ব্রাজিল মানে ডজ, ড্রিবল, ওভারল্যাপিং, বাঁকানো শট। চোখের আরাম।

তবে রাশিয়ায় প্রায় প্রতিটি ম্যাচে শেষ মুহূর্তে যে নাটকীয়তা দেখা যাচ্ছে, তাতে ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের সৌন্দর্য যেকোনো মুহূর্তে উবে যেতে পারে! তবে আপাতত স্বস্তি বিরাজ করছে ব্রাজিল শিবিরে। হোঁচট খেয়ে আবার উঠে দাঁড়িয়েছে ব্রাজিল। স্বপ্নের দৌড়টাও শুরু করেছে তারা।

লেখক : সিনিয়র স্পোর্টস জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।