কাপ যুদ্ধ

আর্জেন্টিনার ভরসা ঈশ্বরের পা!

Looks like you've blocked notifications!

নান্দনিকতা নাকি কার্যকারিতা? প্রশ্নটা যদি ফুটবলকেন্দ্রিক হয়, তাহলে অন্য দেশের কে কী উত্তর দেবেন, বলা মুশকিল। তবে উত্তরদাতাদের তালিকায় যদি বাঙালি থাকেন, তাঁরা বেশিরভাগ বেছে নেবেন প্রথমটাকে। বাঙালি শৈল্পিক বা কার্যকর, কোন ফুটবলটা খেলতে পারে, তা বাকি বিশ্ব জানে না। জানানোর সক্ষমতা এখনো তারা অর্জন করতে পারেনি। কিন্তু ফুটবল অনুরাগে তাদের মন জুড়ে থাকে শিল্প। বাঙালির চোখ ফুটবলে শিল্পের স্পর্শ খোঁজে। তাই ইউরোপিয়ান ফুটবলের কার্যকারিকাতে ছাপিয়ে বাঙালি লাতিন ফুটবলের সৌন্দর্যের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। সেটা দশকের পর দশক। ইউরোপিয়ান দলগুলোর সাফল্য তাদের সেভাবে ছুঁয়ে যায় না। কিন্তু সেই লাতিনদের মধ্যে যদি ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা নামের দুটো দেশ থাকে, তাহলে ফুটবল নিয়ে ঝগড়া-বিবাদে জড়িয়ে পড়তেও দ্বিধা করে না বাঙালি! তখন আবার ফুটবলবোধ, শিল্পের প্রতি দুর্বলতা, এসব কিছুই হাওয়া! তখন তাদের কাছে বড় হয়ে দাঁড়ায় একজন পেলে কিংবা একজন ম্যারাডোনা! অথবা একজন মেসি কিংবা একজন নেইমার। তাদের তর্ক-বিতর্কও হয়ে যায় খণ্ডিত ফুটবলদর্শন!

আর্জেন্টিনা কেন ভালো খেলতে পারছে না? এ প্রশ্নের উত্তরে অধিকাংশ বাঙালির মুখে সেই খণ্ডিতদর্শনের চর্চা। সব ফুটবলীয় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ পাশে সরিয়ে রেখে দিন শেষে তাঁরা একজনকেই দায়ী করছেন। লিওনেল মেসি। মেসি পারছেন না! কেন পারছেন না, সেই ব্যাকরণ খোঁজার তাগিদ তাঁরা অনুভব করছেন না। ফুটবল মাঠে একটা দলের হয়ে ১১ জন খেলোয়াড় যুদ্ধে নামে। সেই যুদ্ধের রণকৌশল ঠিক করেন একজন কোচ এবং তাঁর সহকারীরা। কিন্তু দল ব্যর্থ হলে বাঙালি খোঁজে একটা মুখ। হতে পারে সেই মুখ লিওনেল মেসি কিংবা নেইমার। দলটার নাম যখন আর্জেন্টিনা। অতএব, ব্যর্থতার দায় মেসির। সমীকরণটা খুব সহজে মিলিয়ে ফেলেন এ দেশের মানুষ। তার একটাই কারণ, বাঙালির আবেগ।

আর্জেন্টিনা দেশটার একটা ভৌগোলিক সীমারেখা আছে। কিন্তু এ দেশের ফুটবল নিয়ে বাঙালির আবেগের সীমা-পরিসীমা আছে বলে মনে হয় না। মেসিকে নিয়ে বাঙালির আবেগ সীমাহীন। তারও কারণ লিওর ওই শৈল্পিক ফুটবল। যেটা বাঙালির চোখে লেগে আছে। সেই মেসি আরো একবার তাঁর ফুটবল জীবনে কঠিন এক পরীক্ষার মুখোমুখি। কারণ, এবারের বিশ্বকাপে মেসির আর্জেন্টিনা প্রথম রাউন্ডেই খাদের কিনারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সেখান থেকে দলটাকে টেনে তুলতে মেসি ছাড়া অন্য কারো পায়ের দিকে অন্যরা তাকালেও বাঙালি তাকাবে না! কারণ, মেসির পা দুটোকেই ‌'লেগস অব গড' মনে করে তারা। আর্জেন্টিনা বিদ্বেষীরা ম্যারাডোনার সেই বিখ্যাত ‌'হ্যান্ড অব গড' নিয়ে যত সমালোচনাই করুন না কেন, তাঁরাও মানবেন মেসির দুটো পা সত্যি 'লেগস অব গড'। সেটা মুখে স্বীকার করুন বা নাই করুন। ঈশ্বরের সেই পা-ও যে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে, সেটা রাশিয়ায় আর্জেন্টিনার প্রথম ম্যাচেই দেখেছেন দর্শকরা। পেনাল্টি মিস করলেন মেসি! অতএব, সব দোষ মেসির।

আজ নাইজেরিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে নামার আগে আর্জেন্টিনা যেখানে দাঁড়িয়ে, তার দায় কি একা মেসির! ফুটবল তো ১১ জনেরই খেলা। ব্যর্থতার দায়টা একা মেসির কাঁধে কেন বর্তাবে! কিংবা বর্তানোর চেষ্টাই হবে কেন? কারণ, বাঙালির সেই নায়ক বন্দনার প্রবল ইচ্ছা। তাই মহানায়ককেও 'খলনায়ক' বানানোর ইচ্ছাটাও তাদের মধ্যে প্রবল!

নাইজেরিয়া-আর্জেন্টিনা ম্যাচের আগে মেসি নামক এক মহানায়কের পাশে মোহাম্মদ মুসা নামের একজনকে এমনভাবে টেনে আনা হচ্ছে, যেন তিনি এত দিন ফুটবলকাব্যে উপেক্ষিত ছিলেন এই মেসির কারণে। অতএব, এই ম্যাচে মেসিকে জবাব দেওয়ার সেরা সুযোগ তাঁর সামনে! হ্যাঁ, একটা ম্যাচে মুসা নায়ক হয়ে যেতেই পারেন। আগের ম্যাচে আইসল্যান্ডের বিপক্ষে দুই গোল করে আর্জেন্টাইন সমর্থকদের বুকে জমে থাকা কষ্টের বরফ কিছুটা হলেও গলিয়েছেন এই মুসা। আজ সেই মুসা যদি জ্বলে ওঠেন আর্জেন্টিনার বিপক্ষে, তাতেও কি তিনি লিওনেল মেসি হয়ে যাবেন? না। হয়তো কয়েকটা দিন তাঁকে নিয়ে আর্জেন্টিনাবিরোধী সমর্থকদের আবেগের বুদবুদটা থাকবে। কারণ, একজন মেসি একটা-দুটো ম্যাচ দিয়ে তৈরি হয় না।

একটা বিশ্বকাপ না পেলেও সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলারদের তালিকা থেকেও তাঁকে বাদ দেওয়া যাবে না। যদি মুসার গোলে আজ আর্জেন্টিনা হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায়ও নেয়, তারপরও মেসি আর মুসা একসঙ্গে ব্র্যাকেটবন্দি হবেন না। যদি তাই হতো, তাহলে আর্জেন্টিনার ম্যারাডোনা আর ক্যামেরুনের রজার মিলার সমতুল্য হয়ে যেতেন। কারণ, '৯০-এর বিশ্বকাপে আফ্রিকার দেশ ক্যামেরুনের কাছে প্রথম ম্যাচেই হেরেছিল ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনা।

পেলে, ম্যারাডোনাদের ১০ নম্বর সরণির বাসিন্দা মেসিও। তাঁদের ফুটবলীয় আভিজাত্য এবং সম্পদ অন্যদের থেকে অনেক বেশি। সেই মেসিকে নিয়ে সমর্থকদের আবেগটা বেশি থাকবে। তাঁর ওপর চাপ থাকবে। আর্জেন্টিনার প্রাণভোমরা সেও লিওনেল মেসি। সমর্থকদের আবেগ আর্জেন্টিনার প্রাণবায়ু। তাদের ভালোবাসা দলটার অক্সিজেন। নাইজেরিয়ার বিপক্ষে আজও সমর্থকদের ভালোবাসার অক্সিজেন মাস্ক সঙ্গে থাকবে আর্জেন্টিনার। তারপরও অনেকগুলো 'যদি', 'কিন্তু' নির্ভর হয়ে পড়েছে আর্জেন্টিনার পরের রাউন্ডে যাওয়া। সমর্থকদের আকুলতা অন্য রকম এক অনুপ্রেরণা হয়ে যেতে পারে আর্জেন্টিনার জন্য। আর সেই আর্জেন্টিনা হয়ে উঠতে পারে একটু বেশি বিপজ্জনক।

কিন্তু ড্রেসিংরুমে কোচের বিরুদ্ধের বিদ্রোহের আগুন জ্বেলে মাঠে কি ফুল ফোটাতে পারবেন মেসি-মাশ্চেরানো-অ্যাগুয়েরা-হিগুয়েনরা? পারলে লেনিনের রাশিয়ায় আর্জেন্টাইন ফুটবলের নয়া বিপ্লব ঘটে যেতে পারে। যে বিপ্লবের কৃতিত্বাধিকারী একজন মেসি বা মাশ্চেরানো হবেন না। হবে গোটা দল। আর বিপ্লব ব্যর্থ হলে সবার আগে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো লোকটার নাম হবে—লিওনেল মেসি।

আর্জেন্টাইন ফুটবলের প্রতি দায়বদ্ধতা কী জিনিস, সেটাও ভালো করে জানা আছে লিওনেল মেসির। তা না হলে কি অবসর ভেঙে আবার ফিরে আসেন! তবে হ্যাঁ, দলকে শেষ ষোলোতে টেনে নেওয়ার সব দায় মেসির নয়। সেটা বুঝতে হবে তাঁর দলের বাকি ফুটবলারদেরও। তা প্রথম একাদশ সাজানোর দায়িত্ব সাম্পাওলি নামক কোনো একজন পালন করুন বা মেসি-মাশ্চেরানো-অ্যাগুয়েরো সবাই মিলেই করুন। ব্যর্থ হলে আর্জেন্টিনা নামক দলটাই ব্যর্থ হবে। হতাশা আর বিষাদের ছায়া তখন আর্জেন্টিনার ভৌগোলিক সীমানা ছাড়িয়ে এই বাংলাদেশেও দেখা যাবে। জীবনে হাজার বিপন্নতার মাঝেও ফুটবল সৌন্দর্য দেখার জন্য এ দেশের কোটি কোটি মানুষ মুখিয়ে থাকে। যাঁরা জানেন না, তাঁদের নিজেদের দেশ কবে বিশ্বকাপ খেলবে? কিংবা আদৌ কোনো দিন খেলতে পারবে কি না! তারপরও আজ এ দেশের কত মানুষ কত আকুলতা নিয়ে তাকিয়ে থাকবেন নাইজেরিয়ার বিপক্ষে লাতিন আমেরিকার দেশটার জয় দেখার জন্য। এই আকুলতার রসায়নটাই বোধ হয় ফুটবলীয় সৌন্দর্য।

লেখক : সিনিয়র স্পোর্টস জার্নালিস্ট ও কলামিস্ট।