গাজীপুর সিটি

নগরে নির্বাচন তাতে ভোটারের কী?

Looks like you've blocked notifications!

রোজকার পোড়-খাওয়া যাপিত জীবনে বাঙালির কাছে এখনো ভোট এক উৎসবের নাম। যদিও তাঁরা নিশ্চিত নন, তাঁদের কাছে যত্নে রাখা দেশের সাংবিধানিক আমানত ভোটের অধিকারটা সঠিক গণতন্ত্র চর্চায় জুতসই কাজে লাগছে কি না? এর কারণ এখনো বাংলাদেশিরা মোটের ওপর রাজনৈতিক দ্বিধারায় বিভক্ত। এর একটি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং অপরটি ক্ষমতাহীন বিএনপি। বাকিরা এই দুই দলের পদাঙ্ক অনুসারী মাত্র। সেই ক্ষমতাহীনদের বরাবরের অভিযোগ, তাঁরা ভোট দিতে পারেন না কিংবা তাঁদের পছন্দসই প্রার্থীকে ভোট দিতে দেওয়া হয় না। কাজেই অন্তত এই অর্ধেক জনগোষ্ঠীর কাছে ভোটের উৎসব এখন আর আলাদা কোনো মাহাত্ম নিয়ে আসে বলে বোধ হয় না।

এমন বাস্তবতায় আজ গাজীপুর সিটি করপোরেশনে দ্বিতীয়বারের মতো ভোট অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এখানেও যথারীতি দুই দলেরই বাহাস, কাজিয়া আর পাল্টাপাল্টি অভিযোগের বহর। বাকি পাঁচ মেয়র প্রার্থীকে জনগণ তেমন চেনে না কিংবা চেনা-জানার খুব একটা আগ্রহও ছিল না তাঁদের।

স্মরণকালের নির্বাচনগুলোর মধ্যে গাজীপুর সিটি নির্বাচনের এবারের প্রার্থীরা সবচেয়ে বেশি প্রচারণার সুযোগ পেয়েছেন। তফসিল ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পরও আদালতের নির্দেশে অতিরিক্ত এক মাস সময় আর কোনো নির্বাচনে দেওয়া হয়নি। বলা হয়েছিল, এই এক মাস প্রার্থীরা তাঁদের প্রচারকাজ থেকে বিরত থাকবেন, কিন্তু বাস্তবে তার উল্টোটাই ঘটেছে। কার্যত এই সময়ক্ষেপণের জন্য দুই বড় দলের প্রার্থীর ফলাফল আগের অনুমান থেকে ভিন্নতর হতে পারে। ১৫ মের নির্বাচনে যেখানে ধারণা করা হয়েছিল, বিএনপি প্রার্থী ভালো ফল করবে, সেখানে এখন ধারণা করা হচ্ছে ফলাফল ক্ষমতাসীনদের অনুকূলে যেতে পারে। এর বহুবিধ কারণ আছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া খুলনা সিটি নির্বাচনের একটা প্রভাব এখানকার দোদুল্যমান ভোটারদের ওপর পড়তে পারে। আর প্রচারণায় সরকারি দলের প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম যতটা সুযোগ পেয়েছেন, বিএনপি প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার ততটা পাননি বলে বারবার অভিযোগ এসেছে। এমনকি সরকারি দলের প্রার্থীর আচরণবিধি লঙ্ঘন করে প্রচারণার বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে বেশ কয়েকবার লিখিত অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাননি বলে বিএনপি প্রার্থী অভিযোগ করে এসেছেন। অন্যদিকে এসব অভিযোগের ব্যাপারে এই নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা রকিবউদ্দিন মণ্ডল নৌকা মার্কার প্রার্থীকে মৌখিক সতর্ক করার মধ্যেই তাঁর দায়িত্ব সীমিত রেখেছেন।

এ ছাড়া গেল দেড় মাস ধরেই বিএনপি প্রার্থীর আরেকটি গুরুতর অভিযোগ হলো, তাঁর কর্মী-সমর্থক এমনকি নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্যদেরও পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। অনেককে নাকি ভয়ভীতিও দেখানো হয়েছে। এমন এক পরিস্থিতিতে নির্বাচনী পরিবেশের সবচেয়ে পরিচিত শব্দবন্ধ ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ সমুন্নত রাখার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধই থেকে গেছে। বিএনপির অভিযোগ, নৌকা মার্কার প্রার্থীকে বিজয়ী করার জন্য সরকার তাদের প্রশাসন মনমতো সাজিয়েছে। যেখানে বিএনপির ভালো কিছুই আর পাওয়ার আশা নেই। তবু আমরা প্রগতিবাদী ও মানুষের সমান অধিকারে বিশ্বাসীরা নির্বাচনের কমিশনের ওপর আস্থা রাখতে চাই এই বিশ্বাসে যে দেশ-বিদেশে তাদের বিরূপ সমালোচনা হয় এমন কাজ থেকে বিরত থেকে নিশ্চয় একটা গ্রহণযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন তারা উপহার দেবেন।

আজকের নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীর এজেন্টরা ৪২৫টি ভোটকেন্দ্রে থাকতে পারবেন কি না, এই নিয়ে বরাবর বিএনপির তরফে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে গাজীপুর পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদকে প্রত্যাহারের দাবির পাশাপাশি নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ না হলে নির্বাচন কমিশনকে পদত্যাগ করতে বলেছে বিএনপি। কিন্তু বিএনপির এসব দাবির প্রতি কোথাও কোনো প্রতিক্রিয়া আমরা দেখিনি, ভবিষ্যতে দেখব এমনটাও বোধ করি না। কাজেই দেশের আর পাঁচটা নির্বাচনের মতো গাজীপুর সিটি নির্বাচনটাও হয়ে যাবে।

বিএনপি যদিও বলে রেখেছে, তারা শেষ পর্যন্ত ভোটের মাঠে থাকতে চায়। কিন্তু আমরা অতীত অভিজ্ঞতা থেকে জানি, প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে নির্বাচনী ঘোড়দৌড়ে নামলেও পরাজিত হলে বিএনপি বলবে, তারা এই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে। তবে বিস্ময়কর হলেও সত্যি যে সব পক্ষের সমঅধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া তথা যথার্থ গণতন্ত্র চর্চার জন্য তাদের বক্তব্যের সত্যতা নির্ণয়ে কোনো প্রতিবাদ, বিদ্রোহ বা আন্দোলন বলে বিএনপির কিছুই হয়তো অবশিষ্ট নেই। মূলত এই জায়গাটিতে ক্ষমতাসীনরা বারবার ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে চলেছে। তাতে মেয়র বা কাউন্সিলর পদে যাঁরা পাস করবেন কিংবা শাসকগোষ্ঠীর লাভ হতে পারে দল-মত নির্বিশেষে সব আমজনতার কী লাভ, তা কেউ জানে না।

পাঁচ বছর আগে গাজীপুর সিটিতে প্রথম নির্বাচন হয়েছিল। সে সময় সরকারি দল মনোনীত দোয়াত-কলম মার্কার প্রার্থী আজমত উল্লা খান কিংবা বিএনপি সমর্থিত টেলিভিশন মার্কার বিজয়ী প্রার্থী এম এ মান্নান এখন আর দৃশ্যপটে নেই। আজমত উল্লা খান মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন। এম এ মান্নানও বয়সের ভার ও আইনি ঝামেলায় জর্জরিত। এই সিটির প্রথম মেয়র বিভিন্ন মামলায় তাঁর কর্মকালের ২২ মাস জেলেই কাটিয়েছেন। চেয়ারে ছিলেন আওয়ামী সমর্থিত কাউন্সিলর তথা প্যানেল মেয়র আসাদুর রহমান কিরণ। পাঁচ বছর আগে গাজীপুর যেমনটা ছিল, সেখান থেকে সামান্যতম উন্নতিও সিটির অধিকর্তারা করে দেখাতে পারেননি। নগরের রাস্তা কিংবা মহাসড়ক সবখানেই ভয়াল যানজটে নষ্ট করে দিচ্ছে মানুষের মূল্যবান কর্মঘণ্টা। জলাবদ্ধতা, রাস্তাঘাটের বেহাল অবস্থা, যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, মাদক নিয়ন্ত্রণের মতো স্থানীয় ইস্যুগুলো আগে যেমন ছিল, এখনো তেমনই আছে।

এমন প্রেক্ষাপটে নতুন মেয়র যিনিই আসুন, রাতারাতি এই ঘনবসতিপূর্ণ পোশাকশ্রমিক অধ্যুষিত শহরকে তার সমস্ত সংকট বিদায় করে দিয়ে বাসযোগ্য করে ফেলবেন এমন আলাদিনের চেরাগ হয়তো কারো কাছেই নেই। দীর্ঘদিন ধরেই গাজীপুরের মহাসড়কের যেখানে সেখানে হকারদের বসিয়ে দিয়ে কিংবা লেগুনা, টেম্পো ও ব্যাটারিচালিত রিকশার স্ট্যান্ড বানিয়ে দিয়ে চাঁদাবাজি করছে কিছু সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী। তাদের লোভ দমাতে পারবেন এমন সাহসী মানুষ আজকাল আর আছে বলে বোধ করি না।

কাজেই গাজীপুর সিটিতে যদি হাসান উদ্দিন সরকার পাস করে তবে বয়সের ভারে ন্যুব্জ তিনিও আরেকজন এম এ মান্নানের বেশি কিছু হয়ে উঠতে পারবেন না। অন্যদিকে তরুণ জাহাঙ্গীর আলম পাস করলে তাঁর বিপুল সংখ্যক কর্মীবাহিনী অথবা ভোটারের মন ভেঙে দিয়ে কারো বাড়ি ভেঙে রাস্তা বা ড্রেনেজ যেমন করতে পারবেন না, তেমনি হকার ও লেগুনা স্ট্যান্ড উচ্ছেদ করে দিয়ে কারো বাড়া ভাতে ছাইও দিতে পারবেন না। এমনকি শহরজুড়ে বৃক্ষরোপণ করে তাঁর প্রতিশ্রুত ‘গ্রিন ও ক্লিন’ নগরীও উপহার দিতে পারবেন না। অতএব, গাজীপুর নগরবাসী আজকে ভোটের আগে যেমন এক দমবন্ধ পরিবেশে আটকে থেকে জীবন চালিয়ে নিচ্ছিলেন, আজকে ভোটের পরও তাদের দুর্গতি কমবে বলে কেউ বিশ্বাস করে না।

জাতীয় নির্বাচনের আগে গাজীপুর সিটি নির্বাচন সরকারের জন্য এসিড টেস্ট, এই নির্বাচন ভালো না হলে বিএনপি এই সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে যাবে না—এসব তাত্ত্বিক কথার কোনো মূল্য কোথাও আছে বলে এখন আর দেখি না। অধিকার আদায়ে ব্যর্থদের মুখে এসব আর মানায়ও না। কাজেই গণতন্ত্র চর্চা, মানুষের ভোটের অধিকার বা সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ ফিরিয়ে দেওয়া এসব গুরুগম্ভীর কথার বাইরে এসে নগর জীবনে সামান্য উন্নয়ন বা স্থিতিশীলতার স্বপ্নদেখা মানুষগুলোর কথা যদি নগরের বিজয়ী অধিকর্তারা সামান্য হলেও মনে রাখত, তাতেই খুশি থাকত মিলিয়ন ভোটার ও তাদের স্বজনরা। কিন্তু ভোট ফুরোলে কে মনে রাখে কার কথা?

লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।