কাপ যুদ্ধ

রাশিয়ায় কি নতুন রূপকথা লেখা হচ্ছে?

Looks like you've blocked notifications!

মস্কোয় রুশ বিপ্লব! হয়তো সেটা ফুটবলীয় বিপ্লবের ইঙ্গিত। রুশ বিপ্লবের আগুনে পুড়ল স্প্যানিশ ফুটবলীয় শিল্প। শেষ হলো স্প্যানিশ ফুটবলের অন্যতম সেরা শিল্পী আন্দ্রেস ইনিয়েস্তার দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপ ছুঁয়ে দেখার স্বপ্ন। মেসি-রোনালদোর পর ইনিয়েস্তার বিদায়ও নকআউট পর্ব থেকে। রুশদের কাছে স্প্যানিশদের হার টাইব্রেকারে। কন্তু হার তো হারই! জয় আর হারের মধ্যে তফাৎ অনেক। তাই রুশরা বিপ্লবের ঝাণ্ডা উড়িয়ে টিকে রইল বিশ্বকাপে। আর স্পেন শিল্পের ক্যানাভাস গুটিয়ে দেশে ফিরল। আবার চার বছরের অপেক্ষা। হয়তো কাপ জয়ের নতুন স্বপ্ন শুরু হবে তাদের। কিন্তু কাতারে মরুর বুকে শিল্পের ছোঁয়া লাগাতে স্পেন পাবে না ইনিয়েস্তা নামক কোনো শিল্পীকে।

জার্মানি, আর্জেন্টিনা, পর্তুগালের পর স্পেনের বিদায়। সেইসঙ্গে অনেক তারকা-মহাতারকার বিদায়। যে বিদায় বিষাদে মোড়ানো। সব বিদায় তো আর স্বপ্নের মতো হয় না। স্পেন টাইব্রেকার নামক লটারিতে হেরে যেভাবে বিদায় নিল, তাতে স্প্যানিয়ার্ডরা দুঃখের সাগরে ভাসতে পারেন। আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা ম্যাচ শেষে বলতে পারেন, ‘জীবনের সবচেয়ে দুঃখের দিন।’ কিন্তু সেই দিনটা যে আবার রুশ ফুটবলে বিপ্লবের দিন।

সেই বিপ্লবের সঙ্গে কোনো একজন লেনিনের নাম জড়িয়ে থাকবে না। জড়িয়ে থাকবে না পুতিনের নামও। লেনিন-পুতিনের দেশ যে বিপ্লব দেখল, সেখানে নায়ক একজন ইগর আকিনফেভ। তাঁর হাত আর পায়ের সৌজন্যে বিশ্বকাপের শেষ আটে পৌঁছাল রুশরা। বিশ্বকাপে এটাই ওদের প্রথম কোয়ার্টার ফাইনাল! ইতিহাসের পাতা উল্টে অনেকে হয়তো চমকে যাচ্ছেন। মনে হচ্ছে কেন, ছেষট্টির ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে ওরা ছিল না কোয়ার্টার ফাইনালে! ছিল। তবে রাশিয়া নামে নয়। সেটা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বিশ্বকাপ। লেনিনের দেশে সমাজতন্ত্রে দাঁড়ি পড়ে গত শতাব্দীতে নব্বই দশকের গোড়ায় একজন গর্ভাচভের হাত ধরে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে টুকরা টুকরো হয়ে যায়। তার সবচেয়ে বড় টুকরোটার নাম এখন রাশিয়া। যে দেশকে বিশ্ব এখন বেশি চেনে পুতিনের সৌজন্যে। বিশ্বকাপে দেশটাকে নতুন করে আরেকটু বেশি মনে করালেন যিনি, তার নাম ইগর আকিনফেভ। রুশ গোলকিপার। যাঁর কৃতিত্বে এবারে বিশ্বকাপে রূপকথার মতো একটা জয় পেল রাশিয়া।  লেনিন বা পুতিনের উত্তরাধিকারী নন ইগর আকিনফেভ। তিনি অবশ্যই রুশ ফুটবলের রূপকথার আরেক মহানায়ক লেভ ইয়াশিনের উত্তরাধিকারী। ইয়াশিনকে নিয়ে রূপকথা কেন, কত কথাই লেখা হয়েছে ফুটবল ইতিহাসে। তাঁর দেশে বিশ্বকাপ হচ্ছে, সেই নামটা উঠে আসবে না তা কী করে হয়! ইগর আকিনফেভ তাঁকে মনে করিয়ে দিলেন।

আবার এই ইগরের কৃতিত্বকে মনে করিয়ে দিলেন রুশ টেনিস তারকা মারিয়া শারাপোভা। নিজে টুইট করে লিখেছেন, ‘হুররে...! দারুণ জিতেছ!’ হ্যাঁ, রাশিয়ার দারুণ জয়। যে জয়কে রূপকথাই মনে করছে ফুটবলবিশ্ব। রাশিয়ার কাছে হেরে যাবে সাবেক চ্যাম্পিয়ন স্পেন! কেউ ভাবতে পারেননি। কিন্তু রাশিয়া এবার জন্ম দিচ্ছে অনেক অবিশ্বাস্য ঘটনার। প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় নেবে জার্মানি, কে ভেবেছিলেন? চ্যাম্পিয়নদের পর গতবারের রানার্সআপরা বিদায় নেবে নকআউটের প্রথম ম্যাচেই! ভাবা গিয়েছিল? তাও পিছিয়ে পড়ে মেসিরা ফ্রান্সের বিপক্ষে দারুণভাবে ফিরে আসার পর! মেসির বিদায়! সেটা দেখে মনে হলো না কি ঈশ্বরও অসহায়! মেসির মতো একই দরজা দিয়ে বিদায় নিলেন তাঁর প্রবলতম প্রতিদ্বন্দ্বী ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। একইভাবে। নকআউট পর্বে। তারপরই গেলেন ইনিয়েস্তাও। চ্যাম্পিয়ন, সাবেক চ্যাম্পিয়নদের বিদায় মিছিল লম্বা হচ্ছে। নক্ষত্র পতনের তালিকায়ও বাড়ছে! রাশিয়ায় কাপ পুনরুদ্ধারের যুদ্ধে এখনো টিকে আছে উরুগুয়ে, ফ্রান্স, ব্রাজিল, ইংল্যান্ড। এই তালিকাও ছোট হয়ে আসতে পারে আজ রাতে। ব্রাজিল বিদায় নিলে, শুধু এক সাবেক চ্যাম্পিয়নের বিদায় হবে না। পতন হবে আরেক নক্ষত্রের। তিনি নেইমার।

চ্যাম্পিয়নরা রাশিয়ায় এসেছিল ব্যাগে ভরে ইতিহাস আর স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু জার্মানি, আর্জেন্টিনা, স্পেন ফিরে গেল স্বপ্নকে বিসর্জন দিয়ে। তাদের ব্যাগে থাকল শুধু তাদের ইতিহাস। কিন্তু রুশরা পুরোনো ইতিহাস আঁকড়ে পড়ে থাকতে চাইছে না। রাশিয়ায় কি তাহলে নতুন কোনো ইতিহাসের জন্ম হতে যাচ্ছে? সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে। সমাজতন্ত্র উবে গেছে। তাহলে আর পুরোনো ইতিহাস আঁকড়ে পড়ে থাকা কেন! সত্যিই কি রাশিয়ায় লেখা হতে যাচ্ছে নতুন কোনো রূপকথা!

লেখক : সিনিয়র স্পোর্টস জার্নালিস্ট ও কলামিস্ট।