কাপ যুদ্ধ

ফুটবল নয়, গোল্ডেন বুট ফিরতে পারে বাড়ি

Looks like you've blocked notifications!

ফুটবল বাড়ি ফিরবে। কিন্তু ফিরল না। ইংলিশরা পারলেন না। তাদের অপেক্ষা আরো বেড়ে গেল। সেই অপেক্ষা যদি কাতার পর্যন্ত হয়,  তাহলেও তার বয়স হবে ৫৬ বছর। তারপর যদি ফুটবল বাড়ি ফেরে। কিন্তু বত্রিশ বছর আগে শেষ বার সোনার বুট গিয়েছিল ইংল্যান্ডে। সেটা গ্যারি লিনেকারের সৌজন্যে। ম্যারাডোনার বিশ্বকাপে গোল্ডেন বুট জিতেছিলেন ইংলিশ ফরোর্য়াড লিনেকার। এবার কাপ জয়ের স্বপ্ন বিসর্জনের পর ইংলিশদের জন্য তৃতীয় হওয়ার সম্ভাবনা। আর হ্যারি কেনের গোল্ডেন বুট জয়ের স্বপ্ন।

তৃতীয় হওয়ার পথে ইংল্যান্ডের পথের কাঁটা সেই বেলজিয়াম। গ্রুপ পর্বে যাদের কাছে হেরেছিল ইংলিশরা। ভাগ্য আবার সেই দুটো দলকেই দাঁড় করিয়েছে মুখোমুখি। যেখানে কাপ জয়ের কোনো স্বপ্ন নেই। যে লড়াই জিততে পারলে শুধু সান্ত্বনা পাওয়া যাবে, হ্যাঁ, বিশ্বকাপে ‘তৃতীয় সেরা দল আমরা’! অথচ ইংল্যান্ড এবং বেলিজিয়াম যখন সেমিফাইনালে উঠে এসেছিল, তখন তাদের ভাবা হচ্ছিল কাপে অন্যতম দাবিদার। বেলজিয়ামের সোনালি প্রজন্ম বা গোল্ডেন জেনারেশন ফাইনালে তুলতে পারল না দেশকে। সেমি ফাইনালেই শেষ হয়ে গেল তাদের সোনালি দৌঁড়। হ্যাঁ,  বিশ্বকাপ ইতিহাসে বেলজিয়াম এখন পর্যন্ত তৃতীয় হতে পারেনি। এবার যদি পারে।’৮৬-র সেই ম্যারাডোনার বিশ্বকাপে তৃতীয় স্থান লড়াইয়ের ম্যাচে তারা হেরেছিল মিশেল প্লাতিনির ফ্রান্সের কাছে। সেই ফ্রান্স তারপর দুই দুই বার ফাইনাল খেলেছে। একবার কাপ জিতেছে। এবারও ফাইনালে উঠে কাপ জয়ের স্বপ্নটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আর বেলজিয়াম সেই ফ্রান্সের কাছে হেরে তৃতীয় স্থানের লড়াইয়ে।

বেলজিয়ামের কেউ এখন পর্যন্ত সোনার বুট জিততে পারেননি। এবার সেই সম্ভাবনা জাগিয়েছেন রোমেল লুকাকু। কিন্তু তাঁর সামনে এগিয়ে থাকা এক প্রতিদ্বন্দ্বী রয়েছেন। যিনি এক ইংলিশ। হ্যারি কেন, পাঁচ ম্যাচে ছয় গোল করে সোনার বুটের সবচেয়ে বড় দাবিদার। তাঁকে পেছনে ফেলে বুট জয়ের জন্য একটা ম্যাচকেই পাচ্ছেন লুকাকু। কিন্তু সেখানে তাঁকে কমপক্ষে গোটা তিনেক গোল করতে হবে। আর যদি হ্যারি কেন কোনো গোল না পান এ ম্যাচে। লুকাকুর জন্য কাজটা শুধু কঠিন নয়। কঠিনতর। তবে হ্যাঁ, গোল্ডেন বুটের লড়াইটা শেষ পর্যন্ত ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দুই ফুটবলারের মধ্যেই আটকে গেল। হ্যারি কেন টটেনহ্যামের ফরোয়ার্ড। আর লুকাকু ম্যান ইউর। দুটো দলই কিন্তু ইংলিশ লিগের শিরোপা জিততে পারেনি। বিশ্বকাপে অবশ্য তারা গোলপোস্টে বল পাঠিয়েছেন অন্যদের চেয়ে বেশি।

হ্যারি কেনের ছয় গোলের বিপরীতে লুকাকুর চার গোল। কেন অবশ্য সেটা পিস থেকে গোল করেছেন বেশি। আর গোটা তিনেক গোল তো এসেছে তাঁর পেনাল্টি কিক থেকে। তারপরও বুট জয়ের দৌড়ে তিনি এগিয়ে। এসেছিলেন যারা কাপ জয়ের স্বপ্ন নিয়ে, সেটা শেষ হয়ে যাওয়ার পর বুট জয়ের স্বপ্ন তাদের কতটা উজ্জীবিত করবে লড়াইয়ে তা নিয়েও দ্বিধা আছে। তারপরও কারো ক্যাবিনেটে যদি বিশ্বকাপের গোল্ডেন বুট থাকে, সেটা তাঁর সারা জীবনের বড় এক অর্জন ছাড়া কী। সেটা ক’জন ফুটবলারের বাড়িতে আছে। হ্যারি কেন, ফুটবল বাড়িতে ফেরাতে পারলেন না। গোল্ডেন বুট নিয়ে যদি ফেরেন, তাহলে বুড়ো বয়সে নাতি-নাতনিদের অন্তত গল্প করতে পারবেন, লেলিনের দেশে গিয়েছিলাম ফুটবলকে বাড়ি ফেরাব বলে। কিন্তু ক্রোয়েটদের কাছে হেরে আমাদের ফাইনাল খেলা হয়নি। রাশিয়া থেকে ‘গোল্ডেন বুট’-টা আমি বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম।

গোল্ডেন বুটের লড়াই যদি হয় হ্যারি কেন আর রোমেল লুকাকুর মধ্যে তাহলে গোল্ডেন বলের আপাত বড় দুই দাবিদার লুকা মদ্রিচ আর কিলিয়ান এমবাপে। একজন ক্রোয়েশিয়াকে টেনে তুলেছেন ফাইনালে। তিনি শুধু অধিনায়ক নন। মাঝমাঠে রীতিমতো ফিল্ড মার্শালের মতো খেলছেন। আরেকজন আর্জেন্টিনার বিপক্ষে স্বপ্নের দৌঁড়ে যে দুটো গোল করেছেন, তা এখনো ফুটবলপ্রেমীদের চোখে জল জল করছে। ফরাসি লিগে নেইমারের পাশে প্যারিস সেইন্ট জার্মেইয়ের হয়ে খেলেন। নেইমার এবং তার দেশ ব্রাজিল বিশ্বকাপ থেকে চলে গেছে। কিন্তু এমবাপে তাঁর দেশকে টিকিয়ে রেখেছেন ফাইনাল পর্যন্ত। লুক মদ্রিচ লা- লিগায় খেলেন রোনালদোর পাশে। রোনালদোর বেশিরভাগ গোলের ফাইনাল পাস তার পা থেকে আসে। কিন্তু কজন মনে রেখেছেন মদ্রিচের সেই পাসগুলোকে। রোনালদো বেলন ডি অর জিতেছিল। কিন্তু গোল্ডেন বল জিততে পারেননি। মদ্রিচ সেই গোল্ডেন বলের এবার অন্যতম দাবিদার। লুকা মদ্রিচ লড়াকু এক ফুটবলার। তাঁর জীবনটাই লড়াই সংগ্রামের। যুগোস্লাভিয়ায় যখন গৃহযুদ্ধ চলছিল, তখন এক শিশুর নাম লুকা। যিনি দেখেছিলেন তাঁর পিতামহকে চোখের সামনে হত্যা করতে। যাকে ঘর বাড়ি ছেড়ে প্রায় উদ্বাস্তু জীবন কাটাতে হেয়েছে। যে ক্রোয়েশিয়ায় আজ তিনি নায়ক, যে ক্রোয়েশিয়ার রাস্তাঘাটে মানুষ তাঁর নাম লেখা দশ নম্বর জার্সি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, একদিন সেই ক্রোয়েশিয়ার আদালতে দিনের পর দিন তাঁকে হাজিরা দিতে হয়েছে। তাঁর ক্যারিয়ারে তথ্য ভুল আছে এই অভিযোগে। এখন সেই লুকা মদ্রিচ ক্রোয়েটদের বড় অ্যামবেসেডর। তাদের দেশের সুন্দরী প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রীরাও লুকা মদ্রিচদের জার্সি গায়ে ক্যাবিনেট মিটিং করেন। মাঠে আসছেন। ড্রেসিংরুমে যাচ্ছেন।

রাশিয়ায় বিশ্বকাপ যে জিতে জিতুক, সোনার বল যার হাতে উঠুক কিংবা সোনালি বুট যিনি-ই বাড়ি নিয়ে যাক, বহু চরিত্র মিলে বিশ্বকাপ ইতিহাসের নতুন এক অধ্যায় লেখা হলো এবার। যেখানে হার নয়, জয় হলো ফুটবলের। কাপ, বল, বুটের রং যতই সোনালি হোক না কেন, মানবতার কোনো রং নেই। সেই মানবতারও জয় হতে যাচ্ছে রাশিয়ায়।

লেখক : সিনিয়র স্পোর্টস জানালিস্ট ও কলাম লেখক