প্রথার নতুন দিনের আন্দোলন ও উচ্চশিক্ষায় পুরনো আগ্রাসন

Looks like you've blocked notifications!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সম্পর্কে একটি গতানুগতিক ধারণা ছিল একসময়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মানে বার্গার সংস্কৃতি, লাউঞ্জে বসে শিসা খাওয়া। তখন অবশ্য চল ছিল না ইয়াবার মতো এমন সর্বনেশা নেশার। অনেক আগেই বুঝেছি তবে দ্বিধাহীন কণ্ঠে আজ উত্তর সাগরের কুলে বসে স্বীকার করছি এসবই হলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের এক পুরাণ কথার ফানুস।

মূলত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাটাই এমন যেন সেখানে যারা বিজ্ঞান পড়েন তাদের সাথে ইতিহাস, দর্শন-নীতিশাস্ত্র বা সাহিত্য রাজনীতির কোন সম্পর্ক থাকা যাবে না। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে মানুষ নামের একটি যন্ত্র বের হচ্ছে। যে যন্ত্র শুধু জানে কীভাবে বহুজাতিক কোম্পানির প্রোডাক্টটি সুন্দর করে আপনাকে গছিয়ে দিতে হয়। কিন্তু মানবজগতের প্রতিটি বস্তু ও ঘটনার মধ্যে একটি পরম্পরা আছে, যোগসূত্র আছে-এভাবে সামগ্রিকভাবে দেখার সুযোগ বিশ্ববিদ্যালয় রাখেনি। সে কারণেই আমরা যখন কলা অনুষদের শিক্ষার্থীরা কলাভবন অপরাজয় বাংলা হয়ে কার্জন হলে মিছিল নিয়ে গেছি, তখন সেখানকার ছাত্ররা নাক সিটকিয়েছেন? এই যখন বাস্তবতা তখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নামের একটি পুরাণ কথার ফানুস থেকে যোজন যোজন দূরে থাকবে পাবলিক বা সর্বজন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।

কিন্তু আজ পাবলিক প্রাইভেটের বিতর্কের বিষয় নয়। এই বিতর্ক বরং যে অভূতপূর্ব আন্দোলন গড়ে উঠেছে যার ফলে এই প্রথমবার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিপুল আকারে সংগঠিত একটি শক্তি বা বর্গ হিসেবে হাজির হচ্ছে তার সম্ভাবনা ও ঐতিহাসিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে বাধা আসবে। আর দূরে বসে তখন শাসকশ্রেণি হাত তালি দেবে। নিশ্চয় আন্দোলনে থাকা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের ন্যায্যতার প্রশ্নে মাঠে সজাগ না থেকে অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক করবেন না। আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যাঁরা ভাবছেন আপাত এই  গ্লোবাল পুঁজির ধাক্কা তাঁদের ওপর দিয়ে যাচ্ছে না, সে কারণে ঘাপটি মেরে থাকবেন তাদের জন্য আরো মর্ম বেদনার সংবাদ হলো, এরই মধ্যে সরকার বড় ধরনের একটি পরিকল্পনা নিয়েছে যে আগামী ২০২৬ সালের মধ্যে সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে বেসরকারীকরণ করবে। ফলে এই লড়াই পাবলিক ও প্রাইভেট উভয়ের।

এই আন্দোলনের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক দিকটা বোঝা জরুরী। একই সঙ্গে আন্দোলনের ন্যায্যতা এর সাথে বিশ্বব্যাংকের সম্পর্ক বোঝাটা জরুরী। মূলত অধিক মুনাফা লোটার একটি বিষয় হিসেবেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু। এ কারণে ভ্যাট বিরোধী আন্দোলনের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের দাবি তোলা সঙ্গত যে, এতো টাকা দিয়ে কেন উচ্চ শিক্ষা কিনবো? কারণ যখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন তৈরী হয় সেখানে স্পষ্ট ছিলো, যে এটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হবে। কিন্তু দেশের ৯০ ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মুনাফা করছে। তারতো মুনাফা করার কোন সুযোগ নেই। আর এই অধিক মুনাফা করতে গিয়েই সে প্রতিবারই বাড়াচ্ছে সেমিস্টার ফি ও শিক্ষা ব্যায়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাথীরা এ দিকটি অবশ্যই মনোযোগ দিবেন।

আজ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যে ভ্যাট বিরোধী আন্দোলন করছেন সেখানেও মুনাফা লুটে নেয়ার বিষয়টি রয়েছে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা শুধু ভ্যাটের বিরোধীতাই করছেন। কারণ এটি তাদের চলমান অতি মূল্যে কিনে নেওয়ার উচ্চশিক্ষার পথে বড় আরেকটি বোঝা হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। আন্দোলনের এটি একটি দূর্বল দিক হলেও এই প্রথম আপাত শান্ত নিরীহ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একেকটি ক্যাম্পাস যে ভবিষ্যাতের অগ্নিগর্ভ তা গত দুইদিনেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দেশের গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাকে বেসরকারিখাতে ছেড়ে দেয়ার পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। ফলে এই লড়াইয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল সর্বজন বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে নামতে হবে তীব্র আন্দোলনে; সেটা আজ বা আগামিকাল অথবা নিটক আগামির অন্য যে কোনদিনে।

দেশের গোটা উচ্চ শিক্ষাখাতকে পণ্য হিসেবে ভাবা হচ্ছে। অর্থ্য্যাৎ এখানে ১৬ কোটি দেশের মানুষের বিশাল একটি বাজার আছে। এই বাজার দখলে বিশ্বব্যাংক মরিয়া হয়ে নেমেছে।

দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা যাতে গোটাইটাই বেসরকারিকরণ করা যায় তার বিস্তারিত প্রস্তাবনা দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ও বিশ্বব্যাংকের এই কৌশলপত্র অনুযায়ী ২০২৬ সালের মধ্যে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হবে।

কৌশলপত্রের নির্মাতারা একটি তীব্র ছাত্র আন্দোলনের মুখোমুখি হতে পারেন_এই ভেবে একসঙ্গে সব ভর্তুকি উঠিয়ে নেওয়া সম্ভব নয় বলে কৌশলপত্রে মন্তব্য করেছেন। এক সঙ্গে কৌশলপত্র বাস্তবায়ন হলে তীব্র ছাত্র আন্দোলনের মুখে পড়ার ভয় থেকে ধাপে ধাপে বেসরকারিকরণের পথ বেছে নিয়েছে ইউনিভাসির্টি মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ও বিশ্বব্যাংক।

চার পর্বের প্রথম ধাপগুলো হলো প্রাথমিক পর্ব ২০০৬-২০০৭, স্বল্পমেয়াদি ২০০৮-২০১৩, মধ্যমেয়াদি ২০১৪-২০১৯ এবং দীর্ঘমেয়াদি ২০২০-২০২৬। কৌশলপত্রের সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন হলে একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষার পুরোটাই অধিক দামে ক্রয় করতে হবে।

সময়ের হিসেবে এখন এই কৌশলপত্র মধ্যবর্তী অবস্থা পার করছে। এ কারণে ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টারের নামে শিক্ষা ব্যয় বেড়েছে, চট্রগ্রাম ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচণ্ড ছাত্র আন্দোলনের জেরে বেসরকারিকরণের বড় উদ্যেগ থামানো গেছে। কিন্তু নিরবে নানান নামে শিক্ষা ব্যায় বাড়ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতিনিয়ত।

এই কৌশলপত্রে আছে?

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয়ের ৫০ শতাংশ অর্থ আসতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ খাত থেকে। তবে এর মধ্যে শিক্ষার্থীদের বেতন-ফি বৃদ্ধির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ খাতে আয় বাড়ানোর দিকটা জোর দিতে হবে।
কৌশলপত্রের সুপারিশ অনুযায়ী, শিক্ষার পুরোটাই হবে বাজারনির্ভর একটি লাভজনক বাণিজ্যিক বিষয়। মৌলিক জ্ঞান আহরণ কিংবা বিজ্ঞান শিক্ষার পুরোটাই থাকবে উপেক্ষিত। কোন কোন বিষয়ে গবেষণা হবে তা নির্ধারণ করে দেবে বিশ্বব্যাংক, অন্যান্য ব্যাংকসহ অর্থায়নকারী ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। মৌলিক বিজ্ঞানের পাশাপাশি সাহিত্য, দর্শন বা ইতিহাসের মতো মৌলিক জ্ঞানচর্চার বিষয়গুলো ক্রমশ বন্ধ করে দেওয়া হবে। মানবিক ও বিজ্ঞান বিভাগ সম্পর্কে কৌশলপত্রের ১৩ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, 'পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় মানবিক ও বিজ্ঞান শাখা থেকে বের হওয়া স্নাতকের বর্তমান চাকরির বাজারে ও বাস্তব জীবনে তেমন কোনো মূল্য নেই।'

কৌশলপত্রের সুপারিশকৃত বিষয় সম্পর্কে ১৩ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, 'তথ্য ও প্রযুক্তি বিদ্যা, ব্যবসা ও শিল্প বিষয়ে উচ্চশিক্ষার দ্বার খুলে গেছে। কিন্তু এই নতুন শিক্ষা খাতের তুলনায় মানবিক শাখার কোনো ভবিষ্যৎই নেই।' মানবিক ও বিজ্ঞান শিক্ষার ভবিষ্যৎ না থাকায় কৌশলপত্রের অন্যত্র বলা হয়েছে মৌলিক বিজ্ঞান, সাহিত্য (বাংলা ও ইংরেজি), দর্শন, ইতিহাস, ভাষাতত্ত্বের মতো মৌলিক বিষয়গুলো উচ্চশিক্ষা থেকে বাদ পড়ে যাবে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন ছাত্রাবাস থাকবে না। কারণ হোল শিক্ষার্থীরা দলবদ্ধ থাকে-আর ছাত্র আন্দোলন করে। কৌশল পত্রের ভাষায় ‘অধিকসংখ্যক আবাসিক হল সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি করে।'
বিশ্ববিদ্যালয় কোন পরিস্থিতিকে বশে আনতে ব্যবহার করা হবে ক্যাম্পাসের নিজস্ব পুলিশ যার নেতৃত্বে থাকবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর।
আর এসবের সব অর্থ দিবে বিশ্বব্যাংক কৌশলপত্র বাস্তবায়নে বিশ্বব্যাংকের সাথে ২০০৯ সালের ৫ এপ্রিল বাংলাদেশের সঙ্গে ৫৬৭ কোটি টাকার ঋণ সহায়তা চুক্তি করেছে।

কৌশলপত্রে বলা হয়েছে ছাত্র রাজনীতি থাকা যাবে না। কৌশলপত্রের মতে, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের আন্তরিক চেষ্টা সত্ত্বেও রাজনৈতিক দলের ছাত্র নেতৃবৃন্দের জোরালো প্রতিবাদের কারণে বেতন-ফি বাড়ানো সম্ভব হয়নি। ছাত্ররাজনীতি থাকলে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোনোভাবেই বেতন-ফি বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়’। তার মানে কিছু ছাত্র সংগঠন এখনো আছে যারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষে দাড়ায়? বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরকেও এমন ছাত্র রাজনীতিই করতে হবে যা তাদের স্বার্থ রক্ষা করে।

আর এই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকরা সরকারের কাছ থেকে অনুদান পায় সেই অনুদানের টাকা কোথায় যায় সেটা জানার অধিকার আপনাদের আছে।

ভ্যাট না নিয়ে দুনীতি বন্ধ করুন
 

শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ভ্যাট নিয়ে সরকারের ঘাটতি বাজেট পূরণ করা যাবে না। কিন্তু যদি লুটপাট বন্ধ করা যায় তাহলে ঘাটতি বাজেট সহজেই পূরণ হয়ে যাবে।

দেখুন একটা হিসেবে, দেশে বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমান ৫৪ হাজার ৬৫৭ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। অথচ ২০০৯ সালে যখন যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলো তখন এর পরিমান ছিলো ২২ হাজার ৪৮১ কোটি ৪১ লাখ টাকা। মাত্র ছয় বছরে খেলাপি ঋণের সংখ্যা দ্বিগুন হয়েছে। সূত্র দৈনিক প্রথম আলো, ২৯ জুন ২০১৫
এর সোজা অর্থ হোল স্বাধীনতার ৩৯ বছরে সব মিলিয়ে যত টাকা ব্যাংক থেকে হাপিশ হয়ে গেছে ২২ হাজার কোটি টাকা। আর আওয়ামী লীগের গত ছয় বছরেই হাপিশ হয়ে গেছে ৩২ হাজার কোটি টাকা। আর এই ঘাটতি পূরণ করতেই কি ভ্যাট বসাতে হবে শিক্ষার্থীর উপর?

তবে এই হিসেবটা যদি আরো গভীরভাবে ভাবেন তাহলে মাথা নস্ট হবার জোগাড় হবে। প্রথম আলোর ওই প্রতিবেদন জানাচ্ছে, এখন পর্যন্ত ব্যাংকগুলো নিজেদের হিসাবের খাতা পরিষ্কার রাখতে ৩৬ হাজার ৯৭০ কোটি ৫৪ লাখ টাকা রাইট-অফ বা অবলোপন করেছে। অর্থাৎ এই পরিমাণ অর্থ আর খেলাপি ঋণ হিসাবে দেখানো হচ্ছে না। এর মধ্যে কেবল ২০১১ সাল পর্যন্ত অবলোপন করা ঋণের পরিমাণ ২০ হাজার ৮৪৩ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। সুতরাং এই অর্থ যোগ করলে খেলাপি ঋণ ৭৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। তো, এতো টাকা কারা তুললো ব্যাংক থেকে? আমাদের কৃষক ৫ হাজার টাকা দিতে ব্যর্থ হলে সোজা কোমড়ে দড়ি এরপর জেল। আর হাজার হাজার কোটি টাকা গত ছয় বছরে হাপিশ করে তারা সমাজে সবাই ভিআইপি বনে গেলেন? আজব দেশ!

‘নো ভ্যাট গুলি করো’ চেতনায় হানছে আঘাত

আন্দোলনের মধ্যেই মানুষ তার আপন সত্বাকে চিনতে পারে, খুজে পায় ‘মানুষ’ হয়ে জন্ম লাভের কারণ। এই আন্দোলন যারা করছেন তারা সত্যিকার অর্থে নতুন প্রজন্মের মানুষ, নতুন বাংলাদেশের মানুষ। নিউ লিবারেল ক্যাপিটাল বা উদার পুজি কিভাবে একজন মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে এসে ধাক্কা মারছে তা এতোদিন বহু মানুষ বুঝলেও শিক্ষার্থীদের মত এমন তীব্রভাবে কেউ আর গর্জে উঠেনি। লক্ষ্য করুন সে তার দাবি আদায়ে কেমন দৃড় প্রতিজ্ঞ যে, তিনি গুলি খেয়ে মরতে রাজি কিন্তু তবুও ভ্যাট দিবেন না। সত্যিই শেষ দশ বছরে এরকম শ্লোগান পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছে বলে এই মুহুর্তে মনে পড়ছে না। অন্তত আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক আন্দোলনকর্মী হিসেবে মনে করতে পারছি না।

চেতনায় আঘাত হানা এই নতুন প্রজন্মকে যদি বুঝতে ব্যর্থ হয় তাহলে সংকট আরো গভীর যাবে। সেই সংকট খোদ শাসকশ্রেণীকে বিপদে ফেলবে। নতুন শক্তি হিসেবে ময়দানে আসা এই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালিয়ের শিক্ষার্থীদের উত্থানটি আর কেউ না বুঝতে পারুক সম্ভবত সরকার বুঝতে পেরেছে, ঠিক এ কারণে আন্দোলনের ন্যার্য্যতা নস্ট করার জন্য নানান ধরনের উল্টা পাল্টা বিবৃতি বক্তব্য দেয়া হচ্ছে। তবে আশার বক্তব্য এটা যে-আজকের তরুন তরুনীরা এটা বুঝতে পারছেন যে নামেই ভ্যাটটা আসুক আর যাকেই দিতে বলা হোক-শেষ পর্যন্ত ভ্যাটের টাকা তাদেরই শোধ করতে হবে।

সাধারণ রোজগেরে দশ পাচটা অফিসে দিনানিপাত করে জীবন শেষ করা মানুষেরও কিন্তু ‘মানুষ’ হয়ে উঠতে ইচ্ছে করে, সেই ইচ্ছে থাকে বলেই সে অতৃপ্তি নিয়ে বেচে থাকে।

ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভাসির্টি থেকে শুরু হওয়া এ আন্দোলনের ফলে ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নেমে এলেন মাঠে রাজপথে তা তাদের মানুষ যাত্রার দিকে নিয়ে গেছে। যে মানুষ হবার জন্য দেব দেবিরাও আরাধানা করেন।

ফকির লালন শাহ যেমনটি বলেছিলেন, অনন্ত রূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই,
শুনি মানব রূপের উত্তম কিছুই নাই ।
            দেব-দেবতাগণ,
            করে আরাধন
জনম নিতে মানবে।।’

আমি এমন মানুষ খুজি যে যে মানুষ শব্দের ভেতরকার অর্থ ধারণ করে। কিন্তু সেই অধরা মানুষ, মনের মানুষ কিন্তু আপনা আপনি আসে না। সেই অধরাকে তখনই ধরা যায় যখন সে তার কর্তব্য সম্পাদন করে মানুষ হয়ে উঠে।

ভ্যাট বিরোধী আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সেই মানুষ হয়ে উঠুক যে মানুষের কথা কবি ভাস্কর বন্দোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘আপনি যদি ‘মানুষ’ শব্দটি
একবার উচ্চারণ করেন
যদি অন্তর থেকে করেন উচ্চারণ
যদি বোঝেন এবং উচ্চারণ করেন ‘মানুষ’
তো আপনি কাঁদবেন।
আমি মানুষের পক্ষে,
মানুষের সঙ্গে এবং মানুষের জন্যে।’

আমার বন্ধু নিরঞ্জন / ভাস্কর চৌধুরী

সংগ্রামে, দোহ্রে, আন্দোলনে, শ্লোগানেই কেবল মানুষ হওয়া যায় এবং অতি অবশ্য মানুষ চেনাও যায়। কে ভাই আর কে দুশমন সেটাও সেই ময়দানেই বোঝা যায়। আজ যারা অশ্লিল শব্দ দিয়ে আক্রমণ করছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ইয়াবা খায়, গাঞ্জা খায়, শিষা লাউঞ্জে যায় তাদের সাথে সেই কথিত ‘মুসলিমপন্থিদের’ কি কোন অমিল আছে? যারা শাহবাগ আন্দোলনের সময় বলেছিলেন, ওখানে ছেলে মেয়েরা একসাথে শোয়? না, নেই। শুধু সময় আর মুখগুলো পরিবর্তন হয়। কেউ  বলে ইসলাম রক্ষার নামে আর কেউ তা করে জয়বাংলা দিয়ে। কিন্তু আমরা জানি দুর্মুখেরা সব একই চৌরাস্তায় দাড়িয়ে আছে ঘাতক হয়ে। কেবল আমরা মানুষ হলেই অন্ধকার কেটে যাবে, পরাজিত হবে শত্রুর দল। ইতিহাস লড়াকুদের দিকে, অন্তত মানুষের ইতিহাস সেটাই বলে।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক