গোলাম সারওয়ার

এ পৃথিবী একবার পায় তারে

Looks like you've blocked notifications!

প্রেসক্লাবের মাঠে দাঁড়িয়েছিলাম। সাধারণত যে সময়ের অনেক আগে আমি অফিস থাকি, সেই রকম একটা সময়ে। তিনি ক্লাব থেকে বেরিয়ে আমাকে সামনে পেলেন, জানতে চাইলেন, 'অফিস যাওনি এখনো?'

বললাম, 'না ভাইয়া, এক্ষুনি যাব।'

জিজ্ঞেস করলেন, 'মোটরসাইকেল আছে?'

নেই জেনে বললেন, 'আমি অফিস যাচ্ছি। আমার সঙ্গে চলো।'

সেটাই সারওয়ার ভাইয়ের গাড়িতে আমার প্রথম এবং শেষ লিফট নেওয়া। প্রিয় সম্পাদক গোলাম সারওয়ারের সঙ্গে কাজ করেছি মাত্র বছর চারেক। খুব একটা নৈকট্য পেয়েছি, এমন দাবি করার সুযোগও নেই। তবু সেই একটি দিনের স্মৃতি এখন আমার মনে বড় বেদনা হয়ে বাজছে।

গাড়িতে চড়েই সারওয়ার ভাই বললেন, 'ওহাব সকালে যে গানগুলা শুনছিলাম, সেটা বাজাও তো।'

ওহাব ভাই দুই যুগের বেশি সময় সারওয়ার ভাইয়ের গাড়ি চালাতে চালাতে প্রায় পরিবারের সদস্য হয়ে উঠেছিলেন। অন্য কোনো একদিন ওহাব ভাইয়ের কাছে শুনেছিলাম, গাড়িতে একা থাকলেই গান শুনতেন বেশি। গান, কবিতা নিয়ে তাঁর সঙ্গে সেদিনের আগেও আমার অনেকবার কথা হয়েছে, বলেকয়ে খুব একটা প্রশংসা করেননি। তবে প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় আমার জন্য তাঁর সর্বদাই ছিল। তিনি বলতেন, সেই ষাটের দশকে তাঁরা যখন সাংবাদিকতা শুরু করেছিলেন, তখন সাংবাদিকরা সাহিত্য করতেন। রিপোর্টাররাও প্রচুর পড়াশোনা করতেন। এখনকার ছেলেপেলেদের মধ্যে পড়াশোনার আগ্রহ নেই। ফলে নিজের রিপোর্টটাও ভালো করে লিখতে পারে না বেশির ভাগ। সেদিন ওহাব ভাইকে গান বাজাতে বলার পর আমাকে বলছিলেন, গান শুনে দিনটা শুরু করা গেলে কাজ অনেক ভালো হয়।

সারওয়ার ভাই যখন গান শোনার মাহাত্ম্য বোঝাচ্ছিলেন, তখন তাঁর গাড়িতে বাজছিল, 'বড় বেদনার মতো বেজেছ তুমি হে আমার প্রাণে'। বোধ হয়, আমি যে গান শুনেই গলা চিনতে পারি, সেটা বোঝাবার জন্য তাঁকে বলি, 'ভাইয়া, কলিম শরাফী না?'

তিনি বললেন, 'হুঁ, এই রবীন্দ্রনাথের এই গানটা কলিম শরাফীর মতো আর কেউ গাইতে পারেননি।'

আমি বলি, 'ভাই, ইমন চক্রবর্তী নামে পশ্চিমবঙ্গের একটা মেয়ের গলায় এই গানটা শুনেছি আমি। অসাধারণ গেয়েছে সে।'

'তাই নাকি? আমি তো ওর গান শুনিনি বোধ হয়। তুমি শোনাবে তো।'

সারওয়ার ভাইকে ইমনের গাওয়া 'বড় বেদনা' আমার শোনানো হয়নি। অথচ কাজটা খুব কঠিন ছিল না। আমি তো অফিসে বসে, সবার ভিড়ের মধ্যেও ইউটিউব থেকে গান শুনি। ইমনের গানটাও ইউটিউবে সুলভ। এই না শোনাতে পারার বেদনা এখন বাজছে আমার মনে।

সত্যি 'মন যে কেমন করে মনে মনে তাহা মনই জানে।' আমিও তো বুঝতে পারিনি, তাঁর মৃত্যু আমাকে এমন বিষণ্ণ করবে। যথেষ্ট বয়স পেয়েছেন। যতটা সুকৃতি নিয়ে একজন মানুষের পক্ষে পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়া সম্ভব, তার চেয়ে অনেক বেশিই নিয়ে গেছেন তিনি। নিজেকে তিনি এমন একজন ব্যক্তিত্বে পরিণত করতে পেরেছিলেন, যাঁর বিদায়ে জীবনানন্দের কবিতার মতো বলতে হয়, 'এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর।'

তাঁর ছিল বর্ণাঢ্য ও কর্মমুখর জীবন। 'যুগান্তর' ও 'সমকাল' পত্রিকা দুটির তিনি প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। তিনি 'ইত্তেফাক'-এ ২৭ বছর বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সাংবাদিকতার গদ্য নির্মাণে তিনি ছিলেন পথিকৃৎ। হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন, ‘আপনার গদ্য তো সাংবাদিকতার গদ্য না, সহজ নির্ভার আনন্দময় গদ্য, এই খবরটা কি আপনাকে কেউ দিয়েছে?’ হুমায়ূন আহমেদ হয়তো জানতেন, তবে আমরা যাঁরা সাংবাদিকতা করি, তাঁরা তো অবশ্যই জানি, একজন বার্তা সম্পাদকের লেখা কত কত জনের লেখা হিসেবে প্রকাশ পায়। সেটি যদি হয় সারওয়ার ভাইয়ের মতো সম্পাদকের পত্রিকায়, যিনি সন্ধ্যায় বার্তাকক্ষে সর্বদাই বার্তা সম্পাদকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন। নিবিষ্ট মনে রিপোর্টারের লেখা খবরের কাটাকুটি করতেন, ইন্ট্রো লিখে দিতেন এবং কাব্যিক কিন্তু সাধারণের বোধগম্য শিরোনাম করতেন।

আমার মনে হয়েছে, সংবাদকে মানোত্তীর্ণ করার কাজটাই সবচেয়ে পছন্দ করতেন তিনি এবং এখানে থাকতে চাইতেন বেশি। অফিসে তাঁর জন্মদিন উদযাপনের ঘরোয়া একটা অনুষ্ঠানে একবার বলেছিলেন, 'নিউজরুমেই মরতে চাই আমি। তা না হলেও প্রার্থনা করবে যেন কর্মক্ষম থেকে মৃত্যুবরণ করতে পারি।' প্রকৃতপক্ষে তা-ই হয়েছে। হাসপাতালে যাওয়ার আগের দিনও অফিস করেছেন আমাদের সবার প্রিয় সারওয়ার ভাই, সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার। বার্তাকক্ষ থেকে বেরিয়ে, কর্মক্ষম থেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন তিনি। মরণেরে করে নিয়েছেন বরণ, যেন 'সন্ধ্যার নদীর জলে নামে যে আলোক' তেমন করে।

আমি দেখিনি, শুনেছি, তাঁর গাড়িতে 'সঞ্চয়িতা' ও 'গীতবিতান' থাকত সব সময়। ফিরে ফিরে পড়তেন রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতা। জীবনানন্দের অনেক কবিতা ছিল তাঁর মুখস্থ। সর্বশেষ তাঁর ৭৫ বছর পূর্তির জমজমাট অনুষ্ঠানেও স্মৃতি থেকে জীবনানন্দের কবিতা আবৃত্তি করে শুনিয়েছেন আমাদের।

বরিশালের সন্তান জীবনানন্দ কল্লোলিনী কলকাতায় গিয়ে আত্মাহুতি দিলেন। তাঁর কবিতায় ফিরে ফিরে এসেছে, বরিশাল অঞ্চলের ধানসিঁড়ি, কীর্তনখোলা, সন্ধ্যা ইত্যাদি নদীর কথা। আমাদের সারওয়ার ভাইও ফিরে ফিরে যেতেন বরিশালে। বরিশালের যা কিছু ভালো, তা নিয়ে বলার সময় গৌরব বোধ করতেন। একবার বললেন, সন্ধ্যা নদীর ইলিশ নাকি সবচেয়ে স্বাদু।

ইলিশ নিয়ে বিশেষ আয়োজন করা হয়েছিল ২০১৬ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরের সমকালে। কাজটা সমন্বয় করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আমাকে। মূল লেখাটিও আমি লিখেছিলাম এবং এ জন্য ইলিশ আয়োজনের রিপোর্টাররা ১৫ হাজার টাকা পুরস্কার পেলাম। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম, এই টাকা ইলিশ খেয়ে খরচ করা হবে। রিপোর্টিং টিমের সবাইকে খাওয়াতে চাইলে আরো টাকা লাগবে। সারওয়ার ভাই স্বয়ং উদ্যোগী হলেন, নিজে কিছু টাকা দিলেন এবং মুস্তাফিজ শফিসহ সিনিয়রদেরও অংশগ্রহণ করতে বললেন। নির্দিষ্ট দিনে বেশ ঘটা করেই ইলিশ খাওয়া হলো আমাদের। খেতে খেতে সারওয়ার ভাই বললেন, 'আমাদের সন্ধ্যার ইলিশের মতো ইলিশ আর কোথাও নেই।'

মনে মনে হাসি, হেডমাস্টার কয় কি? আড়ালে-আবডালে সর্বদাই আমি আমাদের সম্পাদককে হেডমাস্টার বলে ডাকি। সত্যি বলছি, এমন শিক্ষক দুর্লভ, যাঁর সান্নিধ্যে নিরন্তর শেখা যায়। তবে শিক্ষক বড় কড়া। সারওয়ার ভাইয়ের মুখোমুখি হলে সব সময়ই আমার হেড স্যার আবু সাঈদ মিঞার কথা মনে পড়ত, সেই শৈশব-কৈশোরে যিনি আমার মধ্যে জানার অপার কৌতূহল জাগিয়ে দিয়েছিলেন। সাঈদ স্যারকে ভীষণ ভয় পেতাম, বোধ হয় সেই ভয়টা সংক্রমিত হয়েছিল বলে সারওয়ার ভাইকেও ভয় পেতে শুরু করেছিলাম। নইলে নির্ঘাৎ বলে দিতাম, 'সন্ধ্যা নদীর ইলিশ আসলে আপনার নস্টালজিয়া।'

সত্যি তো এতকাল পদ্মার ইলিশের গল্প শুনে বড় হওয়া আমাদের পক্ষে সন্ধ্যার ইলিশের সুনামে বিশ্বাস করা কঠিন। সন্ধ্যা পাড়ের দুলাল, আমাদের সম্পাদক গোলাম সারওয়ার দেশজুড়ে খ্যাত হওয়ার পরও বারবার ফিরে গেছেন, তাঁর গ্রাম বানারীপাড়ায়। বাংলাদেশের গোলাম সারওয়ার নিজেকে বরিশালের সন্তান ভেবে গর্বিত হতেন। তাই সেদিন সন্ধ্যার ইলিশ নিয়ে তাঁর উচ্ছ্বাসে বিশ্বাস করিনি। মজার ব্যাপার হলো, এর কয়দিন পরই দেখা হলো মাছবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশের ইলিশ মাছ উন্নয়নের জন্য নিবেদিত ইকো ফিশ প্রকল্পের দলনেতা ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক ড. আবদুল ওহাবের সঙ্গে। সন্ধ্যার ইলিশের গুণাগুণ নিয়ে জিজ্ঞেস করতে ওহাব স্যার বললেন, 'সত্যি সন্ধ্যার ইলিশ বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ।' বৈশিষ্টগুলো কী বিস্তারিত বলেছিলেন ওহাব স্যার। তবু আমি পদ্মার ইলিশের চেয়ে ভালো কি না জানতে চাইলে বললেন, 'কারো কারো কাছে তো তা মনে হতেই পারে।'

মাত্র বছর চারেক আমি সারওয়ার ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। দেখেছি, কত অকারণেই না তিনি উত্তেজিত হয়ে উঠতে পারতেন এবং পরক্ষণেই অপরাধীকে ক্ষমাও করে দিতেন। ক্ষমাশীলতা ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ, ক্ষমাশীলতাই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। সমকালে যোগ দেওয়ার কয়েক মাস পর সারওয়ার ভাইয়ের জন্মদিনে সহকর্মীদের উপস্থিতিতে তাঁকে বলেছিলাম এই কথাটা। আরো বলেছিলাম আমার ব্যক্তিগত চাওয়া এই দুর্বলতাটা নিয়েই আপনি আমাদের মাঝে থাকুন আমৃত্যু। তিনি তাই ছিলেন। গত কয়েক বছরে আমি দুবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি। দুবারই তিনি ছিলেন পরম নির্ভরতা হয়ে।

লেখক : সাংবাদিক ও গল্পকার।