অভিমত

ইভিএম, নির্বাচন কমিশন ও কয়েকটি প্রশ্ন

Looks like you've blocked notifications!

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে. এম. নুরুল হুদাকে প্রায়ই সাহসী বক্তব্য দিতে দেখি। অনেক ক্ষেত্রে দু-একটি সাহসী উদ্যোগও নিয়েছেন তিনি। আবার অনেক সময় ভ্লাদিমির লেনিনের লেখা সেই বিখ্যাত বই ‘ওয়ান স্টেপ ফরোয়ার্ড, টু স্টেপস ব্যাক’-এর মতো হতে দেখা গেছে তাঁকে। অর্থাৎ কোনো কোনো বিষয়ে এক পা এগিয়ে, আবার দুই পা পেছানোর ঘটনাও আমরা অবলোকন করেছি। অল্প কিছুদিন আগেও তিনি বলেছিলেন, সব রাজনৈতিক দল ঐকমত্যে না পৌঁছালে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) জাতীয় নির্বাচনে ব্যবহার করা হবে না। কিন্তু সম্প্রতি হঠাৎ করেই ইভিএম কেনার ইস্যুতে গণমাধ্যমে তুমুল বিতর্কের সুযোগ করে দিয়েছেন। এ নিয়ে শুধু রাজনৈতিক মহলেই মতবিরোধ হয়েছে তা নয়, কমিশনের ভেতরেও হয়েছে বিরোধিতা। গত ৩০ আগস্ট জাতীয় নির্বাচনে ব্যালটের পাশাপাশি ইভিএম ব্যবহারের সুযোগ রেখে নির্বাচন-সংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) সংশোধনী প্রস্তাবও অনুমোদন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ফলে হঠাৎ করেই ইভিএম কেনা এবং আরপিও সংশোধনের সিদ্ধান্তে এ বিষয়ে নতুন করে আমাদের ভাবার সুযোগ করে দিয়েছে কমিশন। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী ইভিএমকে এখনো পরীক্ষামূলক অবস্থায় আছে বলে বক্তব্য দিলে পরক্ষণেই সিইসি নড়েচড়ে বসলেন এবং কৌশল করে আরো একটি বক্তব্য দিয়ে সৃষ্ট বিতর্কের সমন্বয় ঘটালেন।

কয়েক দিন হলো ইভিএমের আলোচনা কিছুটা কমেছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় লক্ষণীয় হলো, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য থেকেই কি কমিশন ইভিএম কেনার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে? যদি তাই হয়, তাহলে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের প্রশ্নে এবং ভূমিকার প্রশ্নে বেশ কিছু প্রশ্ন আমাদের আঁকড়ে ধরবে। ইভিএম কেনা এবং সে অনুযায়ী নির্বাচনের আয়োজনের হঠকারী উদ্যোগ থেকে কমিশনের সরে আসার প্রশ্নে কিছুটা খটকা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।

নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। আর এই স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্তে অনবরত নড়চড় হওয়ার ইস্যুটি খুব বেশি ইতিবাচক নয়। কমিশন যদি মনে করে, সরকার তাদের নিয়োগকর্তা এবং সরকারের বিরাগভাজন হওয়ার ঝুঁকি তারা নিতে চায় না, তাহলে তাদের নিরপেক্ষতা এবং পদে থাকার বিষয় নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। তবে এটাও ঠিক, রাজনৈতিক দল যদি না চায়, নির্বাচন কমিশন সেই ব্যবস্থায় নির্বাচন আয়োজন করতে পারে না। কিন্তু সেই প্রশ্নটি আগেই সমাধান হয়ে গেছে, যখন বিএনপিসহ তাদের সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো ইভিএমের বিরোধিতা করেছে। অন্যদিক, সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও সমমনা আরো কিছু দল, যারা ইভিএমের অধীনে ভোট চেয়েছিল। যেহেতু ঐকমত্য আসেনি, সে জন্য নির্বাচন কমিশন আগে থেকেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছিল, এ নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবস্থা থাকছে না। তবুও তাদের সাময়িক উদ্যোগের বিষয়টি আমাদের অবাক করেছে।

এ কথা ঠিক, এখনই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ইভিএমের ব্যবহার যুক্তিসংগত হবে কি না, সেটি নিয়ে আরো ভাবতে হবে। কারণ, যে দেশে নাগরিকদের রাজনৈতিক সচেতনতার স্তরই অনেক নিম্ন, সেখানে উন্নত প্রযুক্তিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা হলে ভোটারদের আস্থার ক্ষেত্র নিয়ে শঙ্কা থেকেই যাবে। উন্নত দেশগুলোতেই ইভিএম ব্যবহারের প্রশ্নে এখনো শতভাগ ঐকমত্য আনা সম্ভব হয়নি। অনেক রাষ্ট্রই আছে, যারা শিক্ষা ও সচেতনতায় অনেক এগিয়ে, সেসব রাষ্ট্রেও ইভিএম ব্যবহারের প্রশ্নে একমত হতে পারেনি।

উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের রায় হ্যাকিং করে পাল্টে ফেলা হয়েছিল বলে ডেমোক্রেট দলের অভিযোগ ছিল। সন্দেহের তীর ছিল রাশিয়ার বিরুদ্ধে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেছেন, চীনা হ্যাকাররা এ কাজ করেছে। জানা গেছে, আমাদের ইভিএম নাকি কেনা হবে চীন বা হংকং থেকে। এমনিতেই নির্বাচন প্রক্রিয়ায় জনগণের আস্থায় চিড় ধরেছে। তার ওপর এই হ্যাকিং-ভীতি। হ্যাকাররা যদি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার সরিয়ে নিতে পারে, তাহলে ইভিএম হ্যাক করে ভোটের ফল পাল্টে দেবে না, এর কি নিশ্চয়তা আছে? এই প্রশ্নগুলোর সদুত্তর পাওয়া খুবই জরুরি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ইভিএম চালু করেছিল, কিন্তু অনতিবিলম্বে এই পদ্ধতি বাতিলও করেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আয়ারল্যান্ড ই-ভোটিং পরিত্যাগ করেছে ২০০৬ সালে। ২০০৯ সালে জার্মানির ফেডারেল ভোট ইভিএমকে অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা দিয়েছে। ২০০৯ সালে ফিনল্যান্ডের সুপ্রিম কোর্ট তিনটি মিউনিসিপ্যাল নির্বাচনের ফল অগ্রহণযোগ্য বলে ঘোষণা করে। নেদারল্যান্ডসে ই-ভোটিং কার্যক্রম শুরু হলেও জনগণের আপত্তির মুখে তা প্রত্যাহার করা হয়। ড. অ্যালেক্স হালডারমেন আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে ইভিএমের ওপর গবেষণা করে প্রমাণ পেয়েছেন যে ইভিএম টেম্পারপ্রুফ নয়। আমেরিকায় ২২টির বেশি অঙ্গরাজ্যে ইভিএমকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং বাকিগুলোতেও নিষিদ্ধ হওয়ার পথে। ভারতের কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ ভরদ্বাজ মনে করেন, একটি গোপন কোড জানা থাকলেই ই-ভোটিং মেশিনের গণনা পদ্ধতি সম্পূর্ণ পরিবর্তন করা সম্ভব। মেশিনের মাদারবোর্ড তখন সে অনুযায়ীই কাজ করবে।

কাজেই সারা বিশ্ব যখন ইভিএম পদ্ধতি নিয়ে সংশয়াচ্ছন্ন, তখন নির্বাচন কমিশনের এমন ধরনের তড়িঘড়ির ইস্যুটি কাউকেই খুব বেশি খুশি করতে পারেনি। এমনকি আওয়ামী লীগের অনেক নেতা এ বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখালেও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সেটা পাওয়া যায়নি। এ বিষয়টি অনেকেই অনুধাবন করে এবং স্বীকার করে যে বাংলাদেশে ইভিএম ব্যবহারের প্রতি জনগণের আস্থা তৈরির জন্য এখনো অনেক সময়ের প্রয়োজন। যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোই পারস্পরিক আস্থার ক্ষেত্র তৈরি করতে পারেনি, সেখানে সাধারণ ভোটারদের আস্থার প্রশ্নটি আরো চিন্তাযোগ্য। এককথায় বলা যায়, যে দেশের অর্ধেকের বেশি লোক অসচেতন, শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে তাদের এ মুহূর্তে ইভিএম পদ্ধতিতে ভোটের সম্মুখীন করা কতটা যুক্তিসংগত, সেটি নিয়ে ভাবার সুযোগ রয়েছে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।