গ্রিসে কেন বামপন্থীরা বিজয়ী হলেন
ইউরোপের বামপন্থাকে চাঙ্গা করে তুলেছে সিরিজার বিজয়। ২০০৮ সালের সংকটকাল থেকে যারা নতুন ভাবনা আর আশাবাদের খোরাক খুঁজে ফিরছিলেন, তাঁরাও সিরিজার জয়ে দেখছেন ‘নতুন কিছু’। সবখানেই এখন ‘সিরিজা-কাণ্ড’ নিয়ে তুমুল আলাপ-আলোচনা! বিশেষ করে স্পেনে, যেখানে বামপন্থী রাজনৈতিক দল ‘পদেমোস’ ২৫ শতাংশ ভোট পেয়েছে-সেখানে এই আলাপ বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করে বৈকি!
কিন্তু আজকের দিনে ইউরোপীয় ভূখণ্ডে এমন বামপন্থী দলের সরকার গঠন করার গল্পটা খুব সোজা কাজ নয়। মাসখানেক ধরে আমি একটি তথ্যচিত্র নির্মাণকারী দলের সাথে সম্পৃক্ত থেকে সিরিজার নেতাকর্মীদের প্রচারণা কার্যক্রম অনুসরণ করেছি। আমি দেখেছি, তারা কীভাবে কৃষকদের নতুন আশার কথা শোনাচ্ছেন; সাথে প্রয়োজনীয় উপকরণ, রসদ আর খাবারের জোগান দিচ্ছেন। পুরোনো মতাদর্শের বামপন্থীদের পরাস্ত করা, চীনাদের সাথে তাদের কর্মসম্পৃক্ততাকে সরিয়ে আনা, দুর্নীতিগ্রস্ত অভিজাতদের প্রতি সমর্থন তুলে নিয়ে কীভাবে একটি বিক্ল্প এবং তারুণ্যনির্ভর রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তুলেছেন তাঁরা, তা আমি দেখেছি নিবিড়ভাবেই। সেই সাথে তাদের নেতা অ্যালেক্সিস চিপ্রাস কীভাবে সংকটকালে দপ্তরে বসে পরিস্থিতি সামলান, তারও সাক্ষী আমি।
চিপ্রাসের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এমনই আকর্ষণীয় যে তাঁর কোনো বিশ্বমানের প্রেস উইংয়ের দরকার আছে বলে মনে হয়নি আমার। নির্বাচনী প্রচারণার পয়লা সপ্তায় আমি যখন তাঁর সাক্ষাৎকার নিলাম, তখন বুঝলাম যে প্রচারণার ক্ষমতায় তাঁদের কোনো কমতি নেই! দলের প্রেস সেক্রেটারি দানাই বাদোজিয়ানি তাঁদের নেতা অ্যালেক্সিসের মতো পরিষ্কার ইংরেজিতে অকপটে জানালেন, প্রেস উইংয়ের বিষয়টি নেতিবাচক উদাহরণ তৈরি করতে পারে ভেবে তাঁরা এটাকে পরিহার করেছেন। চিপ্রাসের প্রচারণা কার্যক্রম শুরু হয়েছে সংসদে বিরোধীদলীয় অবস্থান থেকে। একই সাথে, পুরো দলের সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে নতুন কিছু করার জন্য তিনি ঢেলে সাজিয়েছেন সবকিছু। বেশি মনোযোগ দিয়েছেন নীতিনির্ধারকদের ওপর।
তাঁর বেপরোয়া তারুণ্যের কথা বলতেই হয়। চোস্ত ইংরেজিতে টানা কথা বলতে পারেন তিনি, সাথে রয়েছে তাঁর জাদুকরি হাসি। তিনি মোটেও ‘পারফেক্ট’ রাজনীতিবিদদের মতো আচরণ করেন না, আর এসব বিষয়ে তাঁর মাথাব্যথাও নেই! নিরাপত্তাবেষ্টনীর তোয়াক্কা না করেই তিনি গ্রিক তরুণীদের সাথে সেলফি তোলেন। মিনিটখানেকের মধ্যে এটা যে ফেসবুকে চাউর হয়ে যাবে আর তার ফলাফল ভালোমন্দ কেমন হতে পারে, তা নিয়ে একেবারেই চিন্তিত হন না চিপ্রাস।
অর্থনীতির জনাচারেক অধ্যাপককে নিয়োগ করার বাইরেও পলিটিক্যাল ইকোনমি নিয়ে পরিষ্কার ধারণা আছে চিপ্রাসের। ইউরোপের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাথে বিদ্যমান সংকট মোকাবিলায় তিনি যে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে যাচ্ছেন, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। এসব ছাড়াও পেশাদারিত্ব আর শৃঙ্খলার বিচারে নতুন উদাহরণ তৈরি করেছেন চিপ্রাস। একই সাথে বলতে হবে তাঁর সহকর্মীদের কথা।
তাঁদের নির্বাচনী প্রচারণা কার্যক্রম নিয়ে অনেক আলাপ হয়েছে সর্বত্র। কিন্তু সত্যি বলতে কি, সিরিজার প্রচারণা কার্যক্রমে বিশেষ কোনো ‘মহান’ কর্মপদ্ধতি ছিল না। আবার অন্যদিকে ‘মহান’ বলা যেতেই পারে কারণ এই কর্মপদ্ধতির মূলে ছিল তারুণ্য, বিশ্বাসযোগ্যতা আর সারল্য! সিরিজার অনেক প্রার্থীই বয়সে একেবারে তরুণ এবং সব দিক থেকে দারুণ আধুনিক। তাঁদের বয়সসীমা বিশ আর ত্রিশের কোঠায়। একই সাথে তাঁদের জীবনযাপন আর আবাস একেবারেই সাদামাটা, সাধারণ। এ কারণেই গণমাধ্যমের বিশাল অংশ চিপ্রাস ও তাঁর দলের বিরুদ্ধাচরণ করা সত্ত্বেও সিরিজার উত্থান কেউই রুখতে পারেনি।
তুষারে ছেয়ে যাওয়া গ্রামগুলোয় ব্যাংকঋণের চাপ আর খাদ্যাভাবে দারুণ বিপদে পড়েন কৃষকরা। এ বিপদ থেকে কোনো অবস্থাতেই মুক্তি মেলেনি তাদের। হতাশায় আর অর্থাভাবে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন অনেকেই। সিরিজার কর্মকাণ্ড আর প্রতিশ্রুতি নতুন আশা জোগায় তাঁদের। নিরুপায় এই কৃষকদের অভিযোগ, ডানপন্থীরা তাঁদের জন্য হতাশা আর প্রবঞ্চনা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেনি। এ জন্য সিরিজাকেই তাঁরা একমাত্র আশাভরসার দল হিসেবে দেখেছেন। তবে, নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থী থিওফানিস কুরেম্বিস অবশ্য গ্রামবাসীদের এমন বিশ্বাসের পেছনে কেবল ‘কথা আর প্রতিশ্রুতি’র চমককে মানতে নারাজ। তিনি বলেন, ‘আমরা তাঁদের কাছে যাই এবং সাধ্যমতো সাহায্য করি। তাঁরা যখন আমাদের কিছু বলেন, আমরা মনোযোগ দিয়ে শুনি। তাঁরা যখন সাহায্য চান, আমরা সেখানে হাজির থাকি। অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের টিঁকিটিও আপনি সেখানে খুঁজে পাবেন না।’
এ রকম অনেক কষ্টসাধ্য কাজ গত দশ বছর ধরেই করে আসছে চিপ্রাসের দল। আর বিগত বছরের এই চর্চার কারণেই দলটি এবার ক্ষমতায় এসেছে। এক কৃষক আমাকে বলেন, ‘আপনারা সাংবাদিকরা এতটা পথ পেরিয়ে আমাদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য আসেন। এভাবে আমাদের সাথে কথা বলতে আর একটি মাত্র দলই আসে, তা হলো সিরিজা পার্টি। তারা আসে এবং আমাদের কথা শোনে। অন্য কারো সাথে আমরা কথা বলব কী করে? আমরা তো তাদের দেখাই পাই না!’
সিরিজার জয়ের পেছনে এই গ্রামাঞ্চলই বিশাল ভূমিকা রেখেছে। একে তো এখানকার মানুষ উচ্চহারে কর ও সরকারি কম ভর্তুকির দ্বিমুখী চাপে চিঁড়ে চ্যাপ্টা, তার ওপর রয়েছে রাজনীতিবিদদের দুর্নীতির বোঝা! বণিকগোষ্ঠী আর আড়তদাররা কৃষকদের কাছ থেকে ফসল কিনে প্রায়ই লাপাত্তা হয়ে যান। পরে নালিশ করলে তাঁরা নিজেদের দেউলিয়া বলে দাবি করেন। একই সাথে ‘কালো টাকা’র ধোঁকাবাজি তো আছেই! আইনকানুন এই লুটেরাদের রক্ষা করে, কোনো ধরনের সমাধান মেলে না কৃষকদের। কিন্তু সিরিজার মাধ্যমে এই অবস্থা কাটিয়ে ওঠার আশা দেখতে পাচ্ছেন কৃষকরা। এই প্রবঞ্চনার সাথে আর আপস করবে না বলে স্রেফ জানিয়ে দিয়েছে গ্রিসের কৃষকসমাজ।
এ পরিস্থিতি সমাধানে সবকিছু নতুন করে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা চিপ্রাসের। চিপ্রাস আমাকে বলেন, ‘আমরা একটা নতুন রাজনৈতিক যুগের সৃষ্টি করব। রাজনৈতিক দলগুলোর ফন্দিবাজি আর চলতে দেওয়া হবে না। এমন একটি রাষ্ট্র আমরা তৈরি করব যা জনগণের পাশে থাকবে এবং জনগণের জন্য কাজ করবে। আয়কর-সংক্রান্ত এসব তামাশা আমরা একেবারে চুকিয়ে দিতে চাই।’
দেশের জায়গায় জায়গায় খাদ্য মজুদের বন্দোবস্ত করেছে সিরিজা। সিরিজাকর্মীদের এ বিষয়ক কার্যক্রম আমি নিজেই দেখেছি। এথেন্সের বাজারে তারা ভদ্রভাবে কৃষকদের বোঝান যে এক বস্তা আলু অথবা কমলালেবু দরিদ্রদের কতটা উপকারে আসবে। আর এই দান কীভাবে তাদের সামাজিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে আর এটি কী দরকারি ভূমিকা রাখবে। এসব কথা বলার আধঘণ্টার মধ্যেই ঝুড়িগুলো খাবারে ভরে যায়! এই কার্যক্রমকে দান হিসেবে নয় বরং সহায়তা হিসেবেই আমলে নেন তাঁরা।
এভাবে প্রচারণার শেষ সপ্তাহে সিরিজার জয় যে আসন্ন, তা স্পষ্ট হয়ে যায়। এসব কার্যক্রম যদি তাঁদের বামপন্থী মতামতের সাদামাটা নিদর্শনও হয়ে থাকে, সেটাও ছিল অনতিক্রম্য। কারণ, মধ্যম বা ডানপন্থীরা তো কালেভদ্রেও এমনটা করেন না। সুতরাং সেসব নেতা বহু লম্বাচওড়া বক্তৃতা দিলেও তাতে চিঁড়ে ভেজেনি। তাঁদের মালিকানাধীন গণমাধ্যমগুলোও সিরিজার কর্মকাণ্ডকে নেতিবাচক আখ্যা দিয়েছে। সেসব প্রপাগাণ্ডাও নিরর্থক প্রমাণিত হয়েছে।
‘আশার শুরু আজ’, এই হলো চিপ্রাসের মন্ত্র। কফিশপ থেকে শুরু করে বাড়ির খাবার টেবিলে সব জায়গাতেই এখন একই বিশ্বাস-আমরা আর ভীত নই।’
১৯৭৪ সালে সামরিক জান্তার পতনের পর থেকে দুটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল গ্রিস শাসন করেছে। বামপন্থীদের সহ্য করে নিলেও এরা যেন কখনোই ক্ষমতায় আসতে না পারে, সে বিষয়টা তারা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছে। কার্যত, বহুদিন ধরে তারা এই চেষ্টায় সাফল্যও পাচ্ছিল। এ ধরনের দমননীতির কারণে গ্রিসে বামপন্থীরা উল্টো শক্ত অবস্থান তৈরি করে ফেলে। চিপ্রাসের দলের অনেকেই সামরিক-জান্তাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁরা গত কয়েক বছরে বিপ্লবী চেতনা, চে গুয়েভারার অনুপ্রেরণা আর শক্তিশালী শ্রমিক ইউনিয়ন দাঁড় করিয়েছেন এবং আরো বেশি সংগঠিত হয়েছেন। একই সাথে সাম্যবাদী, উদ্যমী তরুণদের নিয়ে জাদুকরি ভাবমূর্তি তৈরি করেছে সিরিজা। নির্বাচনী প্রচারণার শেষ সপ্তাহে গ্রিসের বামধারার চিন্তাশীলরা বুঝতে পেরেছেন যে তাদের চারপাশের প্রতিবন্ধিকতার দেয়ালগুলো ভেঙে গেছে। ক ডানপন্থী প্রতিবেশী, কি অরাজনৈতিক সহকর্মী- সবাইকেই তাঁরা অবলীলায় পর্যুদস্ত করেছেন একটি মাত্র শব্দ দিয়ে- ‘চিপ্রাস’! আর শেষের দিনে তাঁর পুরো নামটাও নিতে হয়নি, শুধু ‘তিনি’ বা ‘উনি’ বললেই বোঝা গেছে। এভাবেই বেপরোয়া প্রচারণা, খাদ্য সঞ্চয় কার্যক্রম আর অভিনব ব্র্যান্ডিংয়ের ফলাফল হিসেবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হতে যাচ্ছে সিরিজা।
সিরিজার একজন প্রতিনিধি, বর্তমানে সংসদ সদস্য কুরেম্বিস বলেন, ‘মানুষ এখন ভিন্নভাবে ভাবতে শুরু করেছেন। তাঁরা বুঝতে পেরেছেন যে প্রাচীনপন্থী রাজনীতিবিদদের সাথে পথচলার দিন শেষ। বিষয়টি তাঁরা টের পেয়েছেন যে, সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য নতুন কিছু করতে হবে, এ এখন তাঁদের দৃঢ় উপলব্ধি।’
...
পল ম্যাসন : চ্যানেল ফোর নিউজের অর্থনীতি বিভাগের সম্পাদক। গ্রিসের রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে নির্মিত ‘দ্য এন্ড অব অস্টেরিটি’ নামক তথ্যচিত্র নির্মাণকারী দলের সাথে তিনি কাজ করেছেন। সিরিজা দলের নির্বাচনী প্রচারণা আর কার্যক্রমকে অনুসরণ করেছেন কাছ থেকে। বর্তমান প্রবন্ধটি ২৮ জানুয়ারি ২০১৫ সালে দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার অনলাইনে প্রকাশ হয়। সেখান থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর করেছেন সামি আল মেহেদী।
বি.দ্র.
এনটিভি অনলাইন সকল মত ও পথের লেখকদের লেখা ছাপাতে আগ্রহী। তবে সেই রচনায় লেখকের মতের সঙ্গে এনটিভির সম্পাদকীয় নীতি বা মত সবসময় অভিন্ন হবে এমন ভাবার অবকাশ নেই। ভিন্নমতকে প্রকাশের সুযোগ দিয়ে আমরা গণতান্ত্রিক চর্চায় শামিল হচ্ছি কেবল।