অভিমত

সার্জেন্ট, ট্রাফিক আইন ও নারীর অসম্মান

Looks like you've blocked notifications!

প্রায় সকলেই এরই মধ্যে ভাইরাল হওয়ার ভিডিওটি দেখেছেন। ভিডিওটি যে অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট করা হয়, সেই পোস্টে কিছু কথাও ছিল। কথাগুলো ছিল এ রকম : ‘এই ভদ্র মহিলা মিরপুর ১৩ নাম্বার স্কলাস্টিকা স্কুলের সামনে তার প্রাইভেট কার (ঢাকা মেট্রো-গ ২৬-৯৩৪৭) ডাবল লেনে পার্কিং করে রেখেছেন। তার গাড়ির জন্য পেছনের গাড়িগুলো আসতে পারছে না। প্রচণ্ড জ্যাম লেগে আছে। তাকে অনেকবার সবিনয় অনুরোধ করলাম, আপু আপনার গাড়ির ড্রাইভারকে ডেকে দ্রুত গাড়িটি সরিয়ে পেছনের গাড়িগুলো আসার সুযোগ দিন এবং জ্যাম মুক্ত করেন। কিন্তু না, তিনি আমার কোনো কথা তো শুনলেনই না; বরং আমাকে খারাপ ভাষায় গালাগালি করেন এবং সাথে বলেন, তুমি সরকারের দুই টাকার চাকর, আমাকে চেন তুমি? কার গাড়ি জানো এটা? আরো অনেক খারাপ কথা। নিচের ভিডিওটি দেখুন!’

ডিএমপিতে কর্মরত পুলিশ সার্জেন্ট ঝোটন সিকদারের আপাতত নিরীহগোছের এমন একটি ফেসবুক পোস্টের নিচে যে ভিডিও সেঁটে দেওয়া হয়েছে, তা দেখলে যে কারোরই আক্কেলগুড়ুম হতে বাধ্য। উদ্ধত এক নারী ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করেছেন, পুলিশ চার্জ করলে উল্টো তাকেই দেখে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন। সরাসরি বলছেন, তিনি প্রধানমন্ত্রীর লোক, এমপি-মিনিস্টার তথা সরকারি দলের লোক, সার্জেন্ট তুমি কয় টাকা বেতনের চাকরি করো? এখনকার বাস্তবতায় এটা গর্হিত অপরাধ। আপনি শৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যকরণের বিষয়ে কোনো প্রশ্ন তুলতে পারবেন না, বাদানুবাদ দূরে থাকুক। আর হুমকি-ধমকি দেওয়া মানে সোজা চৌদ্দ শিক।

মজার ব্যাপার হলো, পুলিশ এই নারীর বিরুদ্ধে ট্রাফিক আইন ভাঙ্গায় আইনি পদক্ষেপ নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু এত খারাপ ভাষায় দেখে নেওয়ার হুমকি দিলেও এ ব্যাপারে পুলিশম্যান কোনো আইনের পথে হাঁটেননি। মামলা দিয়ে বিচারালয়ে প্রতিকার প্রার্থনা করেননি; বরং তিনি এখনকার দিনে দুর্মর সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেছেন। ওই নারীর সঙ্গে পুলিশ সার্জেন্টের ব্যক্তিগত বাগবিতণ্ডার আলাপচারিতা স্মার্টফোনে ধারণ করে পাবলিক পোস্ট করে দিয়েছেন। যে ভিডিওটি এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল। লাইক-কমেন্টসে পুলিশম্যানের প্রতি সাধুবাদ ও নারীর প্রতি নিন্দাবাদে ভরে উঠছে টাইমলাইন। ঝোটন সিকদারের সতীর্থরাও এতে বেশ উৎফুল্ল এ জন্য যে সমাজের একমাত্র ‘দুষ্টু’ নারীকে পাবলিকের কদাকার বিচারালয়ে ছেড়ে দেওয়া গেছে। পাবলিক ওই নারীকে গালাগাল করছে, শাপশাপান্ত করছে।   

নারীর ধমক দেওয়ার ভিডিওটি যেখানেই দেখা যাচ্ছে, সেখানেই সাধু বাঙালি কমেন্ট বক্সে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। যা নয় তা বলে এই নারীর সম্মানহানি করে চলেছে। বিশেষ করে ঝোটনের কমেন্টস বক্সে মানবাধিকার ও সামাজিক সাম্যতায় বিশ্বাসী আদর্শবান কোনো মানুষ চোখ রাখতে পারবেন না। পাবলিক মন্তব্যে প্রমাণিত হচ্ছে এটাই যে, এই নারী সমাজের জন্য এতটাই ক্ষতিকারক ও বোঝা যে তাকে যাচ্ছেতাইভাবে ‘ধর্ষণ’ করা যায়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, আমি ধর্ষণের কথাই বলছি। ট্রাফিক সার্জেন্ট ঝোটন সিকদারের টাইমলাইনে সেঁটে দেওয়া একজন নারীটিকে ধর্ষণ করার ইচ্ছা জানাচ্ছে! ওই নারীকে হাতের কাছে পেলে এই কাপুরুষের দল কী করত, তা সহজেই অনুমেয়। কী বিস্ময়কর সমাজ এটা? তাহলে এসবের মানে দাঁড়াচ্ছে এটাই, কোনো নারী যদি পুলিশের বিরুদ্ধে অপরাধ করে, তবে তাকে প্রকাশ্যে শ্লীলতাহানি করা যায়! ধসিয়ে দেওয়া যায় তার সামাজিক মানমর্যাদা? আইনশৃঙ্খলার রক্ষক পুলিশের দেওয়া পোস্টে নারীর সম্ভ্রম ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলা জায়েজ! এ এক আদিম বর্বরতম পুরুষতান্ত্রিকতা। নারী ও পুরুষের সাম্যের কথা যখন স্লোগানে পরিণত, তখন এই ধরনের আচরণ অভাবনীয়।

আমাদের সমাজে এই নারীটি ব্যতীত অন্য সবাই কি তাহলে ধোয়া তুলসী পাতা? সবাই কি আইন মেনে চলা সাধুসন্তু? এরই মধ্যে অন্য পুলিশ সদস্যরাও ঝোটনের পক্ষ নিয়ে ওই নারীর ফেসবুক আইডি, গাড়ির কাগজপত্রে থাকা বাপদাদার নাম ও ঠিকানা সবই পাবলিক করে দিয়েছে। এখন এই নারী কোনো রকম হামলা বা ক্ষতির শিকার হলে সেই দায় কে নেবে? পুলিশ সদস্যরা কি সেটা ভেবে দেখেছেন? কিন্তু দেশের প্রচলিত আইন কী বলে? কারো ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সুরক্ষা দেওয়ার বিধিবিধান কি তাহলে নেই?

বাংলাদেশ সংবিধানের ৪৩ নম্বর ধারা অনুযায়ী ব্যক্তির গোপনীয়তার অধিকার মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে বিবেচিত। যদিও বাংলাদেশে ব্যক্তির গোপনীয়তার বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ কোনো আইন নেই। বর্তমানে যেসব আইন রয়েছে, এর মধ্যেই গোপনীয়তা সম্পর্কিত বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত আছে। তবে বাংলাদেশে ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অ্যাক্ট’ ২০০৬-এর অধীনে যে সাইবার আইন রয়েছে, সেখানে উল্লেখ রয়েছে যে কোনো ব্যক্তির অনুমতি ছাড়া ইলেকট্রনিক রেকর্ড, যোগাযোগ সম্পর্কিত তথ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্য প্রকাশ করলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এ ছাড়া তথ্য অধিকার আইনেও ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা বিষয়ে কয়েকটি অনুচ্ছেদ রয়েছে।

বহুল আলোচিত ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬’ (আইসিটি আইন)-এর ৫৭ ধারা বিলুপ্ত করে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের খসড়া এরই মধ্যে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। খসড়া এই আইনের ৩১ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটায়, তাহলে তা অপরাধ হবে। এ অপরাধের জন্য সাত বছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। দ্বিতীয়বার বা বারবার এ অপরাধ করলে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। খসড়া আইনে এ ধারাটিকে অজামিনযোগ্য করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

এখন আমার প্রশ্ন, হুমকিদাতা নারীটির ব্যক্তিগত ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল করে দিয়ে ওই নারীর বিরুদ্ধে পুরুষের শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করা, এমনকি নারী-পুরুষের সাম্যতা ও সম্প্রীতি বিনষ্ট করবার দায়ে কি পুলিশ সার্জেন্ট ঝোটন সিকদার ও তার সতীর্থরা দুষ্ট নন? 

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের ১২ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, একজন ব্যক্তি কখনই অন্য এক ব্যক্তির গোপনীয়তা, পারিবারিক বিষয়, বাসস্থান বা যোগাযোগে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। এমনকি আত্মসম্মান নষ্ট হয় এমন কোনো পদক্ষেপও নিতে পারবে না। এ রকম হস্তক্ষেপ বা আক্রমণের বিরুদ্ধে আইন সুরক্ষিত করতে প্রত্যেকের অধিকার রয়েছে। অন্যদিকে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদের (International Covenant on Civil and Political Rights) ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদ, জাতিসংঘের কনভেনশন অন মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার্সের ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদ এবং জাতিসংঘের শিশু সুরক্ষা সনদের ১৬ নম্বর অনুচ্ছেদে ব্যক্তিগত গোপনীয়তাকে অধিকার হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।

তাহলে দেখাই যাচ্ছে, দেশীয় আইন এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কনভেনশন অনুযায়ী একজন নারীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার বিনষ্ট করে খোদ পুলিশ কর্মকর্তারাই আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে নীতি ও নৈতিকতাবিরোধী কাজ করে যাচ্ছেন। তাহলে সাধারণ মানুষ আপনাদের কাছ থেকে আইনি সুরক্ষা কিংবা প্রাপ্য অধিকার সমুন্নত রাখার নিশ্চয়তা আর কীভাবে আশা করবে?

এই নারীর অপরাধকে খাটো করে দেখবার কোনো প্রয়াস আমাদের নেই। তিনি আইন ভেঙেছেন, উপরন্তু পুলিশকে ধমক দিয়েছেন। বাংলাদেশের দণ্ডবিধি অনুযায়ী নিশ্চয় এর বিচার বা সাজার ব্যবস্থা আছে। পুলিশ আইনের পথে না হেঁটে মানমর্যাদা ধুলায় মিশিয়ে দিয়ে একজন নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার হরণ করবেন, আইনের শাসন বলবৎ আছে এমন কোনো রাষ্ট্রে তা হতে পারে না। আমরা চাই, ঝোটন সিকদার যা করেছেন, তার আইনি ব্যাখ্যা কিংবা প্রতিবিধান তার কর্তৃপক্ষ দেবে। সেইসঙ্গে নিবন্ধে বর্ণিত নারীটির মতো সমাজের অপরাপর দাম্ভিক ও ক্ষমতা জাহির করা মানুষকে কী করে আইন মানতে বাধ্য করা যায়, তাও আমাদের ভাবতে হবে।

লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।