বিশ্ব পর্যটন দিবস

বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প

Looks like you've blocked notifications!

ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল আয়তনের ক্ষুদ্র একটি দেশ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। আকার-আকৃতিতে ক্ষুদ্র হলে কী হবে, বাংলাদেশের আছে এক সমৃদ্ধ ইতিহাস-ঐতিহ্য। আর আছে এ দেশের অপার সৌন্দর্য। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য, বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি, দৃষ্টিনন্দন জীবনাচার বাংলাদেশকে গড়ে তুলেছে একটি বহুমাত্রিক আকর্ষণসমৃদ্ধ পর্যটন গন্তব্য হিসেবে। এ দেশের সৌন্দর্যে তাই যুগে যুগে ভ্রমণকারীরা মুগ্ধ হয়েছেন। চতুর্দশ শতাব্দীতে মরক্কোর জগদ্বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা নৌকাযোগে সোনারগাঁ থেকে সিলেট যাওয়ার পথে নদীর দুই কূলের অপার সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়েছিলেন। তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশ স্বল্প আয়তনের হলেও বিদ্যমান পর্যটন আকর্ষণে যে বিচিত্রতা, সহজেই পর্যটকদের আকর্ষণ করতে পারে। এ দেশে রয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম নিরবচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার, পৃথিবীর একক বৃহত্তম জীববৈচিত্র্যে ভরপুর ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন, একই সৈকত থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত অবলোকনের স্থান সমুদ্রকন্যা-কুয়াকাটা, দুটি পাতা একটি কুঁড়ির সবুজ রঙের নয়নাভিরাম চারণভূমি সিলেট, আদিবাসীদের বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি ও কৃষ্টি আচার-অনুষ্ঠান সমৃদ্ধ উচ্চ সবুজ বনভূমি ঘেরা চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চল, সমৃদ্ধ অতীতের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা উত্তরাঞ্চলের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো।

ফলে স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প উন্নয়নের সম্ভাবনা অপরিসীম। পর্যটনশিল্পের সবটুকু সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে মডেল হতে পারে। বর্তমান পৃথিবীতে পর্যটন একটি সমৃদ্ধ এবং সফল শিল্প। পৃথিবীতে এমন অনেক দেশ আছে, যাদের আয়ের সবচেয়ে বড় খাত এই পর্যটনশিল্প। শুধু তাই নয়, এই শিল্প এবং শিল্পসংশ্লিষ্ট কার্যক্রমের সঙ্গে হাজার হাজার মানুষ জড়িত থাকে। ফলে একটি দেশের বেকার যুবকদের একটি বড় অংশের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। পৃথিবীর সমগ্র জনগোষ্ঠীর প্রতি ১১ জনের মধ্যে গড়ে একজন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পর্যটনশিল্পের সঙ্গে জড়িত। এ তথ্য থেকেই পর্যটনশিল্পের সম প্রসারণশীলতা অনুমান করা যায়।

ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিল তাদের এক গবেষণায় দেখিয়েছে, ২০১৩ সালে পর্যটন খাতে ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, যা দেশের মোট কর্মসংস্থানের ১ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০১৪ সালে এ খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ আরো ৪ শতাংশ বাড়ার কথা। ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে ২ দশমিক ৭ শতাংশ বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে। সে হিসাবে ২০২৪ সালে মোট কর্মসংস্থানের মধ্যে পর্যটন খাতের অবদান দাঁড়াবে ১ দশমিক ৯ শতাংশ। পর্যটনশিল্পের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন সেক্টর, যেমন : পরিবহন, হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ, রিসোর্ট, এয়ারলাইন্স ও অন্যান্য যোগাযোগের মাধ্যম থেকে পৃথিবীর অনেক দেশ প্রতিবছর প্রচুর রাজস্ব আয় করে, যা অন্য যেকোনো বড় শিল্প থেকে পাওয়া আয়ের চেয়ে বেশি। পর্যটনশিল্পের জিডিপিতে প্রত্যক্ষ অবদানের ভিত্তিতে ১৭৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের অবস্থান ১৪২তম। বর্তমানে বাংলাদেশের জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ আসে পর্যটন খাত থেকে।

এরই মধ্যে পর্যটন বিশ্বের বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর এক-তৃতীয়াংশের রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস পর্যটনশিল্প। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার প্রাক্কলন অনুযায়ী সারা বিশ্বে প্রায় ১০০ মিলিয়নের বেশি মানুষ তাদের জীবন-জীবিকার জন্য এই শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। সমগ্র বিশ্বে ২০২০ সাল নাগাদ পর্যটন থেকে প্রতিবছর দুই ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হবে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি আমাদের বাংলাদেশে পর্যটনশিল্প বিকাশের সমূহ সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও স্বাধীনতার ৪৫ বছর পেরিয়ে গেলেও আমরা খুব একটা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারিনি। এই খাতটি থেকে সরকারের বিপুল অর্থ উপার্জনের সম্ভাবনা থাকলেও বরাবরই উপেক্ষিত থেকেছে। পর্যটনশিল্প বিকাশের পথে আমাদের পর্বতপ্রমাণ সমস্যা নিয়ে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা এ ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা যেমন খুব একটা সুবিধাজনক হয়ে ওঠেনি, তেমনি যাতায়াত খরচও তুলনামূলক বেশি হওয়ায় আমরা পর্যটক আকর্ষণে ব্যর্থ হচ্ছি।

বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মতো মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশেও পর্যটনকে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ দেশে পর্যটনের বহু উপকরণ থাকার পরও বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের পর্যটনকে উন্নত শিল্প রূপে গড়ে তোলা অদৃশ্য কারণে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। অথচ এই দেশে পর্যটনের সব উপাদান প্রতিটি জেলায় বিদ্যমান। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক, ভৌগোলিক অবস্থানগত ও কৌশলগত কারণে পর্যটনশিল্পকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিনোদনমূলক শিল্পে পরিণত করা কঠিন কিছু নয়। প্রধানত অবকাঠামোগত পরিবর্তন সম্পন্ন করা গেলেই সারা বিশ্বের পর্যটকদের পদচারণায় এ স্বাধীন দেশ মুখর হয়ে উঠবে। যা বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের পরিচিতি খুব দ্রুতই ছড়িয়ে পড়বে। যুগ যুগ ধরে বিদেশি পর্যটকদের কাছে বাংলাদেশ চিরসবুজ ঘেরা এক স্বপ্নের দেশ হিসেবে পরিচিত।

সপ্তম শতকে প্রখ্যাত চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং বাংলাদেশে ভ্রমণে এসে এর সৌন্দর্যকে কুয়াশা ও পানি থেকে উন্মোচিত ঘুমন্ত সৌন্দর্য হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। সভ্যতার একটি কেন্দ্র হিসেবে পর্যটকদের আকর্ষণ করার মতো অনেক প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে এই দেশে। এ দেশের পর্যটনশিল্প প্রতিষ্ঠিত ও বিকশিত না হওয়ার অন্যতম কারণগুলো যথাক্রমে পর্যটন স্থান ও স্থাপনাগুলোর যথাযথ সংরক্ষণ না করা, সরকারি-বেসরকারি ও প্রাইভেট উদ্যোগের অপ্রতুলতা। দুর্বল অবকাঠামো, পর্যটন আকর্ষণে ব্যর্থতা, পর্যটকদের সুযোগ-সুবিধার অভাব, পর্যটকদের বিভিন্ন কারণে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থতা, সর্বোপরি পর্যটন করপোরেশনের যুগোপযোগী কর্মপন্থা নির্ধারণের ও কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের অভাব। তারপরও এ দেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে, আঞ্চলিক পর্যায়ে, দেশপ্রেমে বলীয়ান হয়ে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার দ্রুত পরিবর্তনের জন্য, আত্মনির্ভরশীলতায় দেশকে পরিণত করার জন্য এই শিল্পকে বিকশিত করা অত্যাবশ্যক।

বিশ্বের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ অবদান সৃষ্টিকারী অন্যতম খাত পর্যটনশিল্প নানাভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা সম্ভব। পর্যটন হলো বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব সম্পদকে সংস্কার করার মধ্য দিয়ে আকর্ষণীয়, দৃষ্টিনন্দন পর্যটন গড়ে তোলা। এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশ তাদের দেশের পর্যটনশিল্পকে কাজে লাগিয়ে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে। নেপাল, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, ভারত, চীন, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ইত্যাদি দেশ উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশ বিভিন্ন পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে, যা বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে তার চেয়ে অধিক বৈদেশিক মুদ্রা আয় পর্যটনশিল্প বিকাশের মাধ্যমে দ্রত সময়ে করা সম্ভব। এত সমস্যা থাকার পরও আমাদের পর্যটনশিল্প ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

একটি পরিসংখ্যানমতে, ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত পর্যটনশিল্পের মাধ্যমে সরকারের বৈদেশিক আয় হয়েছে চার হাজার ১৭৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা। ২০১৮ সালের মধ্যে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা আনুমানিক ১০ লাখে উন্নীতকরণের লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। এসব তথ্য অবশ্যই মনে আশার সঞ্চার করে এবং পর্যটন খাতকে সমৃদ্ধ করতে পারার স্বপ্ন দেখায়। বাংলাদেশে হয়তো কোনো সোনা, রুপা কিংবা হীরার খনি নেই; কিন্তু আমাদের আছে প্রাকৃতিক সম্পদের এক বিপুল ভাণ্ডার। এ দেশের পর্যটনে প্রচলিত চিন্তা-চেতনার বাইরে বাংলাদেশের ভৌগোলিক পরিবেশকে বিবেচনায় নিয়ে দেশীয় পর্যটনশিল্পের বিকাশ করা সম্ভব। এতে অভ্যন্তরীণ পর্যটকের সংখ্যাও বিপুলভাবে বেড়ে যাবে। এর জন্য প্রয়োজন আন্তরিকতা ও নিজেদের সম্পদের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ। তবেই আমাদের পর্যটনশিল্প বিশ্বমানে উপনীত হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

লেখক : ব্যাংকার।