বিপন্ন প্রকৃতি

সুন্দরবন ডায়েরি থেকে বিষণ্ণগাথা

Looks like you've blocked notifications!

মুন্সীগঞ্জে পৌঁছালাম ৭ আগস্ট। ঘুরছিলাম এক ইউনিয়ন থেকে আরেক ইউনিয়নে। এরই মধ্যে খবর এলো, কয়রা উপজেলায় উদ্ধার হয়েছে বাঘের তিনটি চামড়া। আফসোস হলো খুব! বিশ্ব বাঘ দিবসের আমেজ কাটতে না কাটতেই, বাঘ গণনার খতিয়ান মীমাংসা না হতেই এমন খবরে সুন্দরবন ও বাঘের স্বাভাবিক ভবিষ্যৎ পরিণতির জন্য অপেক্ষা ছাড়া আর বোধ হয় কিছু অবশিষ্ট থাকে না। একবার ভাবলাম, সরেজমিনে দেখে আসি মৃত বাঘের চামড়া। কিন্তু মুন্সীগঞ্জ বাজারে বসে চোখ পড়ল স্থানীয় পত্রিকার একটি রিপোর্টে, ‘...বিভিন্ন সূত্রে খবর পেয়ে সরেজমিনে জানা গেছে, এই গ্রামের কতিপয় ব্যক্তি সুন্দরবনে বাঘ শিকার করে। কেননা, একটি বাঘের চামড়া গ্রামে আনলেই চার-পাঁচ লাখ টাকায় বিক্রি হয়। আর এ চামড়া বেচাকেনার জন্য ক্ষমতাসীন দলের নেতাসহ কয়েকজন ব্যবসায়ী জড়িত। এলাকাবাসী জানান, আটক ব্যক্তিরা সুন্দরবনে কখনো বন্দুক, আবার কখনো ফাঁদ পেতে বাঘ শিকার করে। এ বিষয়ে আরো জানা গেছে, আটক শিকারিরা বাঘের চামড়া, হাড় ও গোঁফের লোম বিক্রি করে প্রায় পাঁচ/ছয় লাখ টাকায়। ওই চামড়া সাতক্ষীরা হয়ে ভারতে পাচার হয় বলেও শোনা গেছে। সূত্র জানায়, ঘড়িলাল বাজারে চাল ব্যবসায়ী খোকন গাজীর চাল আনার ট্রলারে বাঘ-হরিণের চামড়াসহ অন্যান্য মালামাল সাতক্ষীরায় পাচার হয়ে সেখানের কতিপয় ব্যক্তির মাধ্যমে ভারতে পাচার হয়ে থাকে...।’

পত্রিকায় স্থানীয় ক্ষমতাসীন নেতা, ব্যবসায়ী অনেকের নামই উল্লেখ করা হয়েছে। পত্রিকা পড়তে পড়তেই সিদ্ধান্ত নিলাম, সরেজমিনে বাঘের চামড়া না দেখে বরং এ ধরনের ঘটনা খুঁচিয়ে দেখলে বেরোতে পারে আরো বেশ কিছু তথ্য। যে কথা সেই কাজ। পরদিনই, অর্থাৎ ১০ আগস্ট গেলাম সুন্দরবনের মালঞ্চ নদী ঘেঁষা পূর্ব কালীনগর গ্রামে। সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম, পরিমল নামের এক গ্রামবাসী গেল মাসেই বনদস্যুদের হাত থেকে ৩০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিয়ে পরিবারের কাছে ফেরত এসেছেন। এমন আর্থিক ক্ষতিতে এখন তাঁর পরিবারের বেশ করুণ অবস্থা। আরো কয়েক বাড়ি এগিয়ে গ্রামের কিছু মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, বর্তমানে যদি কাউকে বনদস্যু ধরে নিয়ে যায়, তবে জনপ্রতি মুক্তিপণ দিতে হয় ১৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। এখন দস্যুদের আর কষ্ট করে গিয়ে মুক্তিপণ দিতে হয় না; বিকাশের মাধ্যমে টাকা পাঠিয়ে চলে এই লেনদেন। এর পর যদি ইচ্ছে হয় তবেই ছাড়া হয় বন্দিকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একজন বলেন, ‘মুক্তিপণ এখন ব্যবসায়ে পরিণত হয়েছে, এটি না দিয়ে কোনো উপায় নেই।’ বনের কিছুটা গভীরে মাছ ধরতে গেলে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা চাঁদা দিতে দস্যুদের। মধু আহরণের সময়ে যদি মধু থেকে লাখখানেক টাকা লাভ হয়, তবে ৩০ হাজার টাকাই দিয়ে দিতে হয় বনদস্যুদের। স্থানীয় নানাজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বনে আগের তুলনায় ডাকাত বহুগুণে বেড়ে গেছে, সে সঙ্গে বেড়েছে বনজীবীদের অপহরণের ঘটনাও। অপহরণের ভুক্তভোগীরা বললেন, তারা ডাকাতদের ভালোভাবেই চেনেন, কিন্তু নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তার খাতিরে কাউকে কিছু বলার সাহস পান না। কেননা, ডাকাত ধরা পড়লেও থানায় নিয়ে আসতে আসতে ক্ষমতাসীন নেতা-মন্ত্রীর ফোন আসে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। এই রাজনৈতিক ক্ষমতার মুখোমুখি হয়ে তা মাথা পেতে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই সাধারণ গ্রামবাসীর। আর ক্ষমতার এমন সক্রিয় সংঘবদ্ধ চক্রে লাভজনক বাঘ নিধন চলছে গোপনে গোপনে।

গত ১২ আগস্ট গেলাম বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের দাতিনাখালীর মুণ্ডাপাড়ায়। ওই গ্রামেরই একজন মাসুদ, তাঁর কাছেই করে বসলাম সহজ একটি প্রশ্ন, ‘গ্রামে বাঘ-টাঘ আসে নাকি এখন?’ মাসুদ এই সহজ প্রশ্নের জবাবে নির্দেশ দিয়েছিল বিপন্ন সুন্দরবনের নিত্য ভয়াবহতার, ‘মুণ্ডাগ্রামে সাত বছর আগেও প্রতিদিন নদী সাঁতরে এই পাড়ে বাঘ আসত, এখন বছরের পর বছর কোনো বাঘের দেখা নেই।’ মুন্সীগঞ্জ ইউনিয়নের পূর্ব কালীনগর গ্রামের শ্যামাপদ বললেন ঠিক একই ধরনের কথা, ‘আগে তো নদীর তীরেই বাঘ এসে হুঙ্কার দিত, নদীতে চার-পাঁচটা বাঘ সাঁতরাতে দেখতাম। ঝাঁকে ঝাঁকে হরিণ দেখতাম নদীর ওপারেই পানি খাচ্ছে। এখন কিচ্ছু নাই আর!’ একটু থেমে আফসোস নিয়ে বলেন, ‘এ বন তো আর থাকবে না, যদি এই বাঘ-হরিণই না থাকে।’

বাঘ-হরিণের এই প্রবল সংকট তো সুন্দরবনের নিয়তি হয়ে গেছে, কিন্তু এ বনের গাছপালা কিংবা অন্যান্য প্রাণিসম্পদের অবস্থাটা কী আসলে? এ প্রশ্নের জবাব মিলল আরো কয়েকটি অনুসন্ধানে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মুন্সীগঞ্জের একজন বললেন, ‘বন বিভাগ কাঠ কেটে সাফ করতেছে।’ সেই সূত্র ধরে আরো স্পষ্ট হলো যে, বন বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী মজুরি দেওয়ার ভিত্তিতে বনজীবীদের দ্বারা বনের ভেতরে কাঠ কাটতে পাঠান, যদিও এখন বনের ভেতর কাঠ কাটা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এর পরও যদি কাঠ কাটা অবস্থায় অথবা কাঠ কেটে আনার সময় কেউ ধরা পড়ে, তবে পাঁচশ অথবা হাজার টাকার বিনিময়ে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। সুন্দরবনের কাঠ পাচারে হরিনগর বাজার, নীলডুমুর ও দাতিনাখালীতে রয়েছে সক্রিয় কয়েকটি কাঠ পাচার চক্র। রাত ১০টার পর এখানে প্রশাসন ও স্থানীয় সাংবাদিকদের নাকের ডগায় চলে রমরমা ব্যবসা। স্থানীয় সাংবাদিকরা সামান্য স্বার্থের বিনিময়ে এ ধরনের খবর প্রকাশ করেন না। কিছু খবর যা প্রকাশ হয়, তা নিছক ইচ্ছাকৃত। এ ছাড়া বনের পাখি নিধন তো চলছেই। খোঁজ মিলল বনের পাখির সুস্বাদু মাংস রাজধানীর মন্ত্রী-আমলাদের মনোরঞ্জন-ভোজনের জন্য বিশেষভাবে প্রেরণ করা হয়।

সুন্দরবন আসলে ফেঁসে গেছে এক ধরনের আন্তর্জাতিক চক্রান্তের বেড়াজালে। অসাধু ব্যবসায়িক স্বার্থে সুন্দরবন এখন বিপন্ন, এতে বনের জিওফিজিক্যাল অবস্থা পাল্টে যাচ্ছে প্রতিনিয়তই। গভীর বনের বেশ অনেক জায়গা ন্যাড়াবন হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছে এরই মধ্যে। বছরখানেক আগে ২০১৪ সালের আগস্টে মুন্সীগঞ্জের এক স্থানীয় তরুণ বলেছিল, বনের ভেতরেই নাকি আট-দশজন মিলে ফুটবল খেলতে যায়! বিস্ময়ে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তাহলে বাঘ আসে না?’ উত্তরে তরুণটি বলেছিল, ‘এখন আর এসব জায়গায় বাঘ আসে না।’ কথাটি সেদিন মনে ধরেনি, অনেকটা কষ্ট হচ্ছিল বিশ্বাস করতে ওই তরুণকে। এবার ঠিক একই গ্রামে গিয়ে জানতে পারলাম, সপ্তাহখানেক আগে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না দুটি শিশুকে। অনেক খোঁজাখুঁজি করে তাদের সন্ধান পাওয়া গেল গ্রামের দেড়-দুই কিলোমিটার গভীরে এবং জানা গেল, আসলে তারা কাঁকড়া খুঁজতে খুঁজতে বনের গভীরে চলে গিয়েছিল।

সুন্দরবন নিয়ে আমি তাত্ত্বিক কথাবার্তা বুঝতে চাই না বা জানাতেও চা ইনা। শুধু বুঝি, এই বনের মূল্য বোঝেন শুধু এ অঞ্চলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। যাঁরা অন্তর থেকেই চান যে এই বন বাঘ-হরিণে ভরপুর থাকুক, গাছ থাকুক, পাখি থাকুক। সর্বোপরি বেঁচে থাকুক সুন্দরবন। তাই অনেক বনজীবী কিংবা জেলে বনবিমুখী হচ্ছে সুন্দরবনের মূল্য বুঝতে পেরে। তাঁরা বিকল্প আয়ের পথে খুশি এ জন্য যে, বনের সম্পদ তাঁরা বনেই রাখতে দিচ্ছেন।

সুন্দরবনের মূল্য আরো বোঝে এই রাষ্ট্রযন্ত্র, তবে একটু ভিন্নভাবে। ভিন্ন অর্থটি আসলে বনের বিপরীতে, এর মূল্যবান অর্থ মূল্য, যা গ্রাস করলে বিশেষ বিশেষ শ্রেশি অশেষ সমৃদ্ধিভোগী হচ্ছে ও হবে। তবে যতদিন এ বন অবশিষ্ট থাকে, ঠিক ততদিন।

লেখক : ভিজ্যুয়াল জার্নালিস্ট, বিবিসি।