আদালতের রায়

আরো একটি চেতনার বিজয়

Looks like you've blocked notifications!

ন্যক্কারজনক ষড়যন্ত্রের সবচেয়ে বড় উদাহরণ ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা। এই হামলা কেবল কোনো একটি রাজনৈতিক দল কিংবা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধেই ছিল না, এটা ছিল একটি চেতনার বিরুদ্ধে। যে চেতনা আমাদের দেশকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছে, সেই চেতনাকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র ছিল ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায়। মূলত মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যেই ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের সেই বিকেলে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল।

দেশের সব শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব বিনষ্ট করার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার নির্মমতা কতটা ভয়াবহ, তা ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়। সেদিন বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোর সঙ্গে কথা বললে ওই ভয়াবহতা কিছুটা আঁচ করা যায়। এই ভয়াবহ ও নির্মম ঘটনার দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এ মামলার রায় হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে সংঘটিত অসমাপ্ত কিলিং টার্গেট সমাপ্ত করার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাওয়া ২১ আগস্ট সংঘটিত আরো একটি ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায় বাঙালি জাতির কলঙ্ক মোচনের সুযোগ তৈরি করল। দল-মত নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিক এই রায়টির প্রত্যাশায় ছিল।

একটি নিকৃষ্ট বর্বরতম হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত হবে—এমন প্রত্যাশা আপামর জনসাধারণের। ২১ আগস্ট ভয়াবহ, বর্বরোচিত ও নৃশংস গ্রেনেড হামলার ঘটনায় আনা মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এই মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, সাবেক সাংসদ কায়কোবাদসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন দেওয়া হয়েছে। ১৪টি বছর জাতির ইতিহাসে এক ভয়াবহ কলঙ্কের ভার বহন করে চলেছে বাংলাদেশ। শেখ হাসিনাসহ অন্য কেন্দ্রীয় নেতৃবর্গকে একসঙ্গে শেষ করে আওয়ামী লীগ তথা তৎকালীন বিরোধী দল তথা জাতিকে নেতৃত্বশূন্য করে দেওয়ার কী ভয়াবহ উদ্যোগ, তা চিন্তায় আনতেই প্রতিটি মানুষকে ব্যথিত হতে হয়। সেদিনের ঘটনার নীলনকশা, ষড়যন্ত্র, গ্রেনেড জোগাড়, হামলা, অপরাধীদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করা এবং অবশেষে ঘটনার দায় খোদ আওয়ামী লীগ আর ভারতের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা ছিল জঘন্যতম।

সে সময়ে অভিযোগ করা হয়েছিল, শেখ হাসিনা নিজেই নাকি তাঁর ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড বহন করে এনেছিলেন। এ ধরনের বিভ্রান্তকর বক্তব্য এবং জজ মিয়া নাটক যে নিঃসেন্দেহে ভণ্ডামি ও মিথ্যার রাজনীতির নমুনা বহন করে, সে বিষয়টি এই রায়ের মাধ্যমে পরিষ্কার হয়েছে। যে হামলার মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল, আর সেই হামলার জন্যই আওয়ামী লীগকেই দায়ী করা হয়েছিল। কতটা অন্যায্য এবং বিদ্বেষপূর্ণ রাজনীতির উদ্ভব হয়েছিল ওই ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে, তা আমরা এখন অনেকটা আঁচ করতে পারি। একজন মানুষ কখনো সুস্থ মস্তিষ্কে এতটা ন্যক্কার, ভয়াবহ ও বর্বরতম হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত হতে পারে, তা কখনো ভাবনার মধ্যেই আনা যায় না।

এ রায়ের মাধ্যমে পরিষ্কার হয়েছে যে, ওই বর্বর ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ছিল তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও ব্যক্তি। তাঁরা ষড়যন্ত্র করেছেন, ঘটনার নীলনকশা প্রণয়ন করেছে, হামলাকারীদের নিযুক্ত করেছেন, গ্রেনেড সরবরাহ করেছেন, হামলাকারীদের নিরাপদে সরে পড়ার ব্যবস্থা করেছেন, বিচারকে বিভ্রান্ত করেছেন, প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের আড়াল করার চেষ্টা করেছেন। নিজের ওপরে নিজেই বোমা মেরেছে আওয়ামী লীগ, এ বিভ্রান্তি ছড়ানোর অপচেষ্টা করেছেন।

বর্তমান সরকারকে ধন্যবাদ ও সাধুবাদ জানানোর ভাষা আমার নেই। স্বয়ং শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য সংঘটিত হামলার বিচারও আদালতের মাধ্যমে হয়েছে। এর জন্যও অপেক্ষা করতে হয়েছে এক যুগের বেশি সময়। বর্তমান সরকারের এই ধৈর্য ও অপেক্ষা আইনের প্রতি শ্রদ্ধা এবং আনুগত্যশীলতার প্রকাশ ঘটায়। আইনানুগ বিচারের মাধ্যমে বছরের পর বছর বিচারকার্য পরিচালনা করে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় হয়েছিল, রায় কার্যকর করা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও প্রকাশ্য আদালতে হয়েছে এবং হচ্ছে। কোনো শর্টকার্ট বিচারপদ্ধতি বেছে না নিয়ে সরকার যে যথাযথ আইনানুগ বিচারিক পদ্ধতিকেই বেছে নিয়েছে এবং কার্যকর করেছে, সে জন্য সরকার অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। এই রায়ের মাধ্যমে একটি চেতনার পুনরুজীবন হয়েছে, বলিষ্ঠ প্রতিবাদ হয়েছে অন্যায় আনাচারের বিরুদ্ধে। যে চেতনাকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল, মূলত সেই চেতনার আরো একটি বিজয় নিশ্চিত হয়েছে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।