কোরবানির ঈদ

পশু জবাই ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠু হোক

Looks like you've blocked notifications!

রাজধানীসহ সারা দেশে ঈদুল আজহায় গরুর চাহিদা ৪০ লাখ, খাসির চাহিদা ৮০ লাখের মতো। এ ছাড়া মহিষ-ভেড়াও আছে কিছু। সারা বিশ্বে বসবাসরত মুসলিমরাই এ অনুশীলন করে আসছেন। এটি মূলত ইবাদত। পাপ-পুণ্যের হিসাব জড়িত। নির্দিষ্ট পরিমাণ ধনের অধিকারী ব্যক্তির জন্য এটি প্রযোজ্য। অর্থাৎ কারো সাধারণ ব্যয়ভার বহনের পরও অতিরিক্ত সাড়ে তিন লাখ টাকার মতো অর্থ-সম্পদ থাকলে তার ওপর কোরবানি প্রযোজ্য (৪২ হাজার টাকা করে সাড়ে সাত তোলা সোনার বর্তমান বাজারমূল্য)। সে হিসেবে বাংলাদেশে এত লোকের কোরবানি দেওয়ার কথা নয়। কারণ, এখানে যে ৪০ লাখ গরুর চাহিদা রয়েছে, তার পেছনে কিন্তু ৪০ লাখ লোক সংশ্লিষ্ট নয়। কারণ, একটি গরুতে সাতজন পর্যন্ত লোক জড়িত থাকতে পারে।

সে হিসাবে গড়ে পাঁচজন করে ধরলেও ৪০ লাখ গরুতে সংশ্লিষ্ট রয়েছে দুই কোটি লোক। খাসিসহ অন্যান্য প্রাণীর চাহিদা ধরা যাক এক কোটি। সব মিলিয়ে কমবেশি তিন কোটি লোকের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা। আর তাঁদের পরিবারের কথা তো বাদই দিলাম।

এ ছাড়া কৃষক পরিবারগুলো নিজেদের চাহিদা নিজেদের গোয়াল থেকেই দিয়ে থাকে। সে হিসেবে এই পশুশুমারি হতে তাদের সংখ্যা বাদ থাকাই স্বাভাবিক। এসব হিসাব আলোচনার বিষয় নয়। আলোচনার বিষয় হলো, এই সংখ্যক পশুকে নিয়ে কত কী ঘটে আমাদের দেশে। মোটাদাগে বলতে গেলে যে বিষয়গুলো সামনে এসে যায় তা হলো :

  • হাট ইজারা সমস্যা
  • গরুর দালালি
  • রাজনৈতিক চাঁদাবাজি
  • সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজি
  • ট্রাফিক জ্যাম
  • বর্জ্য ব্যবস্থাপনা
  • পশুর স্বাস্থ্য
  • জাল নোট
  • চোরাকারবারি
  • কৃষকদের সঠিক দাম না পাওয়া
  • পশু বহনকারী বাহন ছিনতাই
  • অজ্ঞান পার্টির তৎপরতা
  • ইজারাদারদের মোটা অঙ্কের কমিশন, ইত্যাদি।
     

শুধু ঢাকা শহরেই ২০টির অধিক পশুর হাট বসছে। এর মধ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যমের অনুসন্ধানী তথ্যমতে ১১টি হাটই ঝুঁকিপূর্ণ। এর সবকটিতেই রয়েছে রাজনৈতিক অন্তর্দলীয় সমস্যা। এসব হাট ইজারা পেতে বড় বড় রাজনৈতিক নেতার পেছনে গুনতে হয় লাখ লাখ টাকা। যার প্রভাব আমাদের ভোক্তাশ্রেণির ওপর।

প্রতিবছরই পশুর হাটকে কেন্দ্র করে ঘটে বড় ধরনের সংঘর্ষ। নিহতের মতো ঘটনাও ঘটে। আর ধাওয়া-পাল্টাধাওয়াসহ স্নায়ু উত্তেজনা তো স্বাভাবিক অবস্থা। কারণ, মোটামুটি ঈদকে কেন্দ্র করে এক সপ্তাহে যে পরিমাণ টাকা ইজারা কর্তৃপক্ষ কামাই করে, তা বেশ মোটা অঙ্কের। আসল টাকার সঙ্গে জাল টাকা মিশিয়ে দিতে এই পশুর হাট এক উৎকৃষ্ট জায়গা।

বিষাক্ত ডেক্সামেথাসন, হাইড্রোকর্টিসনের মতো স্টেরয়েড প্রয়োগ করে মোটাতাজা করা গরুও হাটে রাখা হয়। এবং এসব ব্যাপারে ইজারাদার কর্তৃপক্ষের কোনো নজরদারি তো নেইই, মাথাব্যথাও নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাকধারী বা সাদা পোশাকের বাহিনীর পাশাপাশি যদি ইজারাদার কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা থাকে, তাহলে এ ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি বহন করা পশু হাটে ঢুকতে পারে না।

গরুবোঝাই ট্রাকের ফলে শহরগুলোতে ট্রাফিক জ্যাম তো নতুন কষ্টের সৃষ্টি করে। এসব গাড়ি কখন মার্কেটে ঢুকবে আর কখন বের হবে, তার একটা ট্রাফিক নীতি আছে। কিন্তু কে মানে কার কথা?

গরুর ট্রাক ছিনতাইয়ের ঘটনা তো হরহামেশাই ঘটছে। তবে খোদ সংসদ ভবন এলাকা থেকে ট্রাক ছিনতাইয়ের ঘটনা খুবই উদ্বেগজনক।

সমস্যা এখানেই শেষ নয়। বিশেষ করে গরুর চামড়া নিয়ে কী ধরনের কারসাজি চলে, তা চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আমজনতার করার কিছু থাকে না। এখানেও থাকে মধ্যস্বত্বভোগী। তারা এলাকাভিত্তিক কাঁচা চামড়ার দাম নিয়ন্ত্রণ করে। কোন এলাকায় কারা চামড়া কিনতে যাবে, চামড়ার মূল্য কত টাকার বেশি বলা যাবে না, সবই স্থানীয় প্রভাবশালীরা নিয়ন্ত্রণ করে। এতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তেমনই বঞ্চিত হয় গরিব জনগোষ্ঠী। কারণ, কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রির টাকা ধর্মীয় কারণে বিলিয়ে দিতে হয় গরিবদের মধ্যে।

কোরবানির পর পশুর বর্জ্য অপসারণের ক্ষেত্রেও দেখি সময়ক্ষেপণ। বিশেষ করে রাজধানীর গাবতলীর পশুর হাটটি অনেক বড়। রাজধানীর সবচেয়ে বড় ও স্থায়ী হাটও বটে। কিন্তু ঈদ শেষ হওয়ার পরও দেখা যাবে, মাস পেরিয়ে যায়, কিন্তু গোবর থেকে শুরু করে গরুর খাবারের জন্য আনা খড়কুটো সবই রাস্তার পাশে স্তূপ হয়ে আছে। দুর্বিষহ গন্ধ মানুষকে ঈদ আনন্দ নয়, মনে করিয়ে দেয় যাতনার কথা।

সরকার প্রতিবছরই সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে। এর অর্থ এই যে, সমস্যাগুলো সমাধাযোগ্য। নচেৎ সরকার প্রতিশ্রুতি দিত না। আমরা চাই, এবার সমস্যাগুলো কর্তৃপক্ষ বিদায় করুক। দৃষ্টান্ত স্থাপন করুক।

লেখক : শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।