মিশুক মুনীরের জন্মদিন
তাঁহার অলাতচক্র দেখিতে পাই, সর্বত্র
এবং তিনি সকলের বন্ধু হইয়া গেলেন। প্রকৃত শিক্ষক তিনি। বলিতে পারেন বন্ধুরূপী শিক্ষক। তাঁহার শিক্ষকতা প্রচলিত ধারণার ঊর্ধ্বে।
মোতাবেক ২০১০ সালীন নভেম্বরের মাঝামাঝি যখন মুন্নীদি, মুন্নী সাহা, এটিএন নিউজে যোগদানের প্রস্তাব করিলেন, তখন ইহা বলিতে ভুলিলেন না যে প্রতিষ্ঠানটির কাপ্তান হইয়াছেন স্বনামখ্যাত মিশুক মুনীর। তাঁর পিতা মুনীর চৌধুরীর নাটক আমি পাঠ করিয়াছি। পুত্রের গুণের কথা দুয়েকবার আমিও শুনিয়াছি লোকমুখে। এবার তাঁহার সঙ্গে কাজ করিবার যে সুযোগ পাওয়া যাইতেছে, তাহাতে আমি বিশেষ আপ্লুত হইলাম।
চাকুরিতে যোগ দিয়া আমি বিস্মিত বৈ আর কিছু হই নাই, নিঃসন্দেহে মিশুক মুনীর একজন শিক্ষক, চাক্ষুষ করিয়া ইহা বুঝিলাম এই লোক ক্ষ্যাপাটেও বটে। সংবাদ দোকানের প্রধান নির্বাহী হইয়া যিনি চণ্ডীপাঠ হইতে শুরু করিয়া জুতাও সেলাই করিয়া থাকেন, তিনি তো ক্ষ্যাপাই। কতদিনই তো দেখিয়াছি তিনি রোদে পুড়িয়া, বৃষ্টিতে ভিজিয়া সরাসরি সম্প্রচারের জন্য কাওরান বাজারের সম্মুখের রাস্তায় চেষ্টার ত্রুটি রাখিতেছেন না। ক্ষ্যাপা মানুষের মতোই তো তিনি লিবিয়া গিয়াছিলেন, মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে উৎখাত করার আয়োজন প্রত্যক্ষ ও সন্দেশ পাঠাইবার জন্য। সঙ্গে আরেক ক্ষ্যাপাও ছিলেন, মুন্নী সাহা। শিক্ষকের যোগ্য শিষ্য বটে। আফসোস হইয়াছিলো, ঐ রকম ক্ষ্যাপা শিষ্য হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয় নাই, যদ্যপি আন্তর্জাতিক খোপে থাকিয়া লিবিয়ার সংবাদ বিস্তর পরিবেশন করিয়াছি। মনে পড়িতেছে, আফগানিস্তান বিষয়ক এক সত্যি গল্প ফাদিয়াছিলাম চৌকো বাক্সের জন্য, সেইখানে মার্কিনিদের রাজনৈতিক ভূমিকা লইয়া নিচু স্বরে অনুযোগ করিয়াছিলাম। মিশুক মুনীর তাহা দেখিয়া বলিলেন, “ভয় পাচ্ছো কেন? সরাসরি বলো, যুক্তরাষ্ট্র কি শয়তানি করছে ওখানে।” সেদিন বিস্তর সময় নষ্ট করিয়া তিনি প্রমাণাদি কাগজে ছাপাইয়া পেশ করিলেন আমার সামনে। আমি কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ হইলাম। এই না হলে ক্ষ্যাপা!
ক্ষ্যাপামির আরো দেখিয়াছি যখন তিনি বন্ধু তারেক মাসুদের লগে কাগজের ফুল রোপণ করিবার তরে গ্রাম হইতে গ্রামান্তরে ছুটিয়া বেড়াইতেছিলেন। এর কিছুদিন আগেই তাঁহার চমৎকার তোলা ছবিতে প্রকাশ হয় তারেক মাসুদের সর্বশেষ কর্ম রানওয়ে। উহা লইয়া আমার খুতখুতে মনে বুদবুদ উঠিতেছিলো। এসলামি আদমবোমাকে আমরা পশ্চিমাদের সংজ্ঞায় দেখিবো কিনা তাহা লইয়া। বাহাস করিবার গোপন ও প্রবল ইচ্ছাও হইতেছিলো। পরিচালক তারেক মাসুদকে নাগালে পাওয়া মুশকিল, তবে তাঁহারই অন্তরঙ্গ বন্ধু মিশুক মুনীর তো ছিলেন। বাহাস হইবে তাঁহারই সঙ্গে। এমনকি এই বাহাস মুদ্রিত করিবার বাসনাও পুষিয়াছিলাম মনে মনে।
দুর্ভাগ্য তাঁহার শিষ্যদের, দুর্ভাগ্য আমাদের, জাতির। ২০১১সালের ১৩ আগস্ট যখন ঘটনা ঘটিতেছে, তখন আমি কর্মক্ষেত্রে প্রতিদিনকার মতোই কাজ করিতেছি। খবর প্রথমে পাইয়া বিশ্বাস হয় নাই, অবিশ্বাস দূর করিবার জন্য মিশুক মুনীরেরই আরেক বন্ধু সাজেদুল আউয়ালকে দূরভাষে ধরি, তিনি হকচকাইয়া গেলেন। আমি বলিলাম, খবর জানিলে ত্বরিত জানাইবেন। পরে যখন সংবাদের দোকানে একের পর এক নিশ্চিত খবর আসিয়া ভিড় জমাইতেছিল, তখন সকলের স্নায়ু বিকল হইয়া যায়। মচকাইয়া ছিলাম আমিও। তবে ভাঙিয়া পড়ি নাই। সংবাদ পরিচালনার দায়িত্বে থাকা রঞ্জন সেন বলিলেন, “বিধান আমাদের শক্ত থাকতে হবে।” তাঁহার কথা শুনিয়া, মনে কোথা হইতে বেদনামিশ্রিত কর্তব্যবোধ উদয় হইলো, দিনের শেষ বেলা পর্যন্ত রঞ্জনদা’র সহযোগিতায় মিশুক মুনীরের ছবি, জীবনের উল্লেখযোগ্য অর্জনের খোঁজ লইয়া খবরে পরিণত করিলাম। তখন আমার সহকর্মীরা নিজেদের আর ধরিয়া রাখিতে পারিতেছিলেন না। অশ্রু বাঁধ ভাঙিয়া আসিতেছিল সকলের চোখে। কিছু সময় পর সবকিছু যখন কিছুটা ধরিয়া আসিল, ধাতস্থ হইলো সংবাদের দোকান, তখন আমার স্নায়ু বিকলের পালা। এতক্ষণ কি করিয়া সংবাদ তৈরি করিলাম, সে আমার পক্ষে বলা কষ্টকর। তবে ইহা বলিতে পারি, তিনি হারাইয়া যান নাই। এখনো তাঁহার অলাতচক্র দেখিতে পাই—চিত্রগ্রহণের উপযোগী কক্ষে, যে কক্ষে আমরা কাজ করি, যে কক্ষে তিনি কদাচ বসিতেন, সবখানে, সর্বত্র।
(লেখাটি এটিএন নিউজ কর্তৃক প্রকাশিত, মুন্নী সাহা সম্পাদিত মিশুক মুনীর স্মারকগ্রন্থ ‘কানেকটিং মিশুক’ হইতে পুনর্মুদ্রিত। এর রচনাকাল ২০১২।)