পরিবেশ

হাটের বাঁশ! পশুর বর্জ্য এবং…

Looks like you've blocked notifications!

ঈদুল ফিতর উদযাপনের চেয়ে আজহায় ঝক্কি-ঝামেলা তুলনামূলক বেশি। বিশেষ করে যাঁরা হজ পালনে যান, তাঁদের ভিসা জটিলতা, অর্থ জোগান, কারো কারো বিমান ভ্রমণ থেকে শুরু করে আনুষঙ্গিক জটিলতা কম নয়। এদিকে পশু কোরবানি করতে গিয়ে প্রতিবছর নাকাল হন অনেকেই। বিশেষ করে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ সংকুলান, পশু কিনতে গিয়ে হাটের পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া, দালালচক্রকে  উপেক্ষা করে পশু কেনা কিংবা ছিনতাইকারীর কবল থেকে বেঁচে ঘরে ফেরা-সবখানেই অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। অন্যদিকে যাঁরা পশু বিক্রির জন্য হাটে নিয়ে যান, তাঁদেরও পোহাতে হয় নানামুখী ঝামেলা। বিশেষ করে চাঁদাবাজি, পশুর স্বাস্থ্য ধরে রাখা, সুস্থ অবস্থায় ক্রেতার হাতে পৌঁছে দেওয়া, নিরাপদ যাতায়াত ও পরিবহন থেকে শুরু করে অজ্ঞান পার্টির হাত থেকে বেঁচে সুস্থ অবস্থায় ঘরে ফেরা- সমস্যা কোথাও কম নয়। এদিকে কোরবানি হয়ে গেলে পশুর উচ্ছিষ্টাংশ সরিয়ে নেওয়ায় প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, ব্যক্তি-পরিবার পর্যায়ের অনীহা ও পরিবেশ নিয়ে অসচেতনতা জন্ম দেয় এক বিভীষিকাময় পরিবেশ।

ঈদুল আজহায় কর্মযজ্ঞ যেমন বেশি, অব্যবস্থাপনা ও বিশৃঙ্খলা স্বভাবতই বেশি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বোঝা কঠিন হয়ে যায় যে এ অব্যবস্থাপনার দায় কার? অন্তত প্রত্যেকে নিজ অবস্থান থেকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে শেষ পর্যন্ত তার দায় নিতে চায় না। বলতে গেলে জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক পরিসরে এ একই চিত্র। বলা যেতে পারে দুই দফায় দেড় সহস্রাধিক হজযাত্রীর মৃত্যুর কথা। এ ক্ষেত্রে সৌদি সরকারের অনীহা ও অব্যবস্থাপনাতেই ক্রেন ছিঁড়েছে, অকালে মরেছেন হাজিরা। অন্যদিকে শোনা যাচ্ছে, মিনা উপত্যকায় জনৈক রাজপুত্তুরের রাজকীয় প্রটোকলের কারণে একপথে অনেক মানুষ ঢুকতে গিয়ে পায়ের নিচে পিষ্ট হয়ে মরেছেন কয়েকশ মানুষ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেছে কেউই এর দায় নিতে প্রস্তুত নন।

এবার বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দৃষ্টি দেওয়া যাক। এখানে বিশৃঙ্খলা ও অব্যবস্থাপনার চিত্র দেখে শিউরে উঠতে হয়।

ঈদ সামনে রেখে রাজধানীসহ দেশের অনেক স্থানে বসেছিল পশুর হাট। ঈদ চলে গেছে। এসব হাট থেকে কেনা পশু কোরবানি ও বণ্টন শেষে সিংহভাগ মানুষ উদরস্থ পর্যন্ত করেছে, কিন্তু সেখানকার পশু বাঁধার জন্য আনা বাঁশের খুঁটিগুলো থেকে গেছে যথাস্থানে। ওপরে ছাউনি তৈরি কিংবা বেড়া দেওয়ার জন্য আনা বাঁশগুলো রয়ে গেছে ঠিক আগের অবস্থানে। বিভিন্নভাবে হাটে আনতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ে নিহত গরুগুলোর শবদেহ বিশ্রিভাবে পড়ে আছে চলাচলের রাস্তাতেই কিংবা রাস্তার পাশে। পশু জবাইয়ের পর বর্জ্যগুলো স্থানে স্থানে সিটি করপোরেশনের গাড়ি এসে সরিয়ে নিলেও সব জায়গা পরিষ্কার হয়নি। দুর্গন্ধে এখনো ভারী হয়ে আছে পরিবেশ। এদিকে গ্রামাঞ্চলে বেশির ভাগ পশু কোরবানি হয়েছে খোলা আকাশের নিচে। তারপর নাড়ি-ভুঁড়ি থেকে শুরু করে উচ্ছিষ্টাংশ যাচ্ছেতাইভাবে ফেলা হয়েছে যত্রযত্র। সেখান থেকে সৃষ্ট দুর্গন্ধে এখন গা গুলোচ্ছে সবার। প্রতিবছর এমন সমস্যা দেখা দিলেও তা থেকে উত্তরণের সদিচ্ছা দেখা যায়নি কারো মধ্যে।

এদিকে ঈদ সামনে রেখে বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন তৈরি করেছে সুদৃশ্য তোরণ। তিন-চারদিন ব্যবধানে সেই সুশ্রী তোরণ হয়ে গেছে ভারী বিশ্রী। সেগুলো সরিয়ে নেওয়া দূরে থাক, সেখানে করা উৎসব আয়োজনের উচ্ছিষ্টাংশে ভরে আছে চারদিক। খোদ রাজধানীতে জাতীয় সংসদের সামনে দিয়ে আসার সময় দেখলাম সেখানে পার্লামেন্ট মেম্বার্স ক্লাবের সৌজন্যে গড়া একটি তোরণ আর দেদার উচ্ছিষ্টাংশ যত্রতত্র ছড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু কোরবানির বর্জ্য সরিয়ে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার সামনে পড়ে থাকা অনুষ্ঠানের বর্জ্যগুলো সরিয়ে নেওয়াটাও ছিল সময়ের দাবি। অন্যদিকে একটা নিম্নমানের তোরণ তৈরি করে দিনের পর দিন সেটাকে লটকে রেখে সংসদ ভবনের সৌন্দর্যহানিটাও কাঙ্ক্ষিত নয়।

প্রতিবছর কোরবানির পশু কিনতে গেলে একই সুর এবারের বাজার চড়া, আর সেই পশুর চামড়টা যখন বিক্রি করতে যাওয়া হয় ঠিক তখনই শোনা যায় এবারে চামড়ার বাজার খারাপ। আর সরকারের তরফ থেকে যখন চামড়ার দাম ঘোষণা দিয়ে কমিয়ে দেওয়া হয়, তখন পরিস্থিতি হয়ে ওঠে আরো ভয়াবহ। আর বলতে গেলে সেখানেও দেখা যায় অব্যবস্থাপনা। আমরা জানি হাজারীবাগের চামড়াশিল্প সংশ্লিষ্ট কারখানাগুলো দীর্ঘদিন থেকে পরিবেশ দূষণ করে আসছে। পরিবেশবাদীদের তরফ থেকে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দেখা গেলেও পরিস্থিতি বদলায়নি। বিশেষ করে উচ্চ মুনাফা থেকে শুরু করে এখানকার বাজার, পরিবেশ ও পূর্বতন অবকাঠামোগত সুবিধা ছেড়ে কিছুতেই নড়তে রাজি নন ব্যবসায়ীরা। এর ফলে সেখানে পরিবেশদূষণ চলছেই আর তার খেসারত দিচ্ছে বাংলাদেশ।

এবারের কোরবানির ঈদ নতুন করে হাজারীবাগের দুর্ভোগ আলোচনায় এনেছে। ঈদের অতিরিক্ত চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। অতিরিক্ত চামড়াকে ব্যবহার উপযোগী করে তুলতে গিয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে প্রচুর পানি, রাসায়নিক দ্রব্য ও বিবিধ উপকরণ। এর পাশাপাশি অতিরিক্ত চামড়ার বর্জ্যগুলোও গিয়ে জমছে এই হাজারীবাগেই। সব বিলিয়ে বেশি চামড়ার ধকল সামাল দিতে গিয়ে আরেক দফা দূষণের কবলে পরিবেশ। ঈদ আসে, ঈদ যায় বদলায় না কিছুই। শুরু থেকে শেষ ওই একই আবেদন, হাজারীবাগের চামড়াশিল্প সরিয়ে নিতে হবে ঢাকার বাইরে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাজি করানো যায়নি ব্যবসায়ীদের। তারা কিছুতেই চাননি হাজারীবাগের চামড়াশিল্প সেখান থেকে সরিয়ে নিতে। 

সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক থেকে শুরু করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্মকর্তারা সরাসরি চামড়াশিল্পের মাধ্যমে পরিবেশদূষণ না করার জন্য হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন কড়াভাবে। এদিকে ইউরোপের নানা দেশ সতর্ক করে দিয়েছে হাজারীবাগ থেকে চামড়াশিল্প সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো সরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে। এ ক্ষেত্রে তাদের দাবি হাজারীবাগের চামড়াশিল্প পরিবেশদূষণের সঙ্গে জড়িত, এখানে প্রক্রিয়াজাত চামড়া স্বাস্থ্যসম্মত নয় বলে তা ইউরোপের কোনো দেশে নেওয়া যাবে না। ফলে এ বছর বাংলাদেশের চামড়াশিল্পের আকাশে দেখা যাচ্ছে অশনিসংকেত।

প্রতি ক্ষেত্রে এই যে অব্যবস্থাপনা তার দায় কেউ নিতে চান না; পরিণামে এক ক্রান্তিকালের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ, বাংলাদেশের পরিবেশ ও প্রতিবেশ। এর থেকে উত্তরণে কিছু নয়, অন্তত নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজগুলো করতে হবে। অন্যের দোষ ধরার থেকে ঢের গুরুত্ব দিতে হবে নিজের দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন হচ্ছে কি না সেদিকে। অন্তত আমরা যদি নিজ অবস্থান থেকে কাজ করি; পরিবেশদূষণ না করি, কোরবানির পর দায়িত্ব নিয়ে বর্জ্য সরিয়ে ফেলি কিংবা নিজ এলাকার সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসি তবে সামষ্টিকভাবে সমস্যা কমে আসবে। একটি বৃহত্তর প্রেক্ষিত পর্যালোচনা করলে এমনি ব্যষ্টিক উদ্যোগের মিলিত ফলাফলেই বাঁচবে দেশ, প্রকৃতি, পরিবেশ ও মানুষ।

লেখক :  পিএইচডি গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।