অভিমত

উভয় সংকটে বিএনপি

Looks like you've blocked notifications!

নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দিয়ে বিএনপি এখন উভয় সংকটে পড়েছে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে বিএনপি একটি নির্বাচনমুখী দল। ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে দৃশ্যত পিছিয়ে পড়েছে। ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে বিএনপিকে ওই নির্বাচনকে বৈধতা দিতে হতো—এমন ধারণা অনেক বিশেষজ্ঞের। অবশ্য এর বিপরীতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তালুকদার মজিরুজ্জামান অভিমত দিয়েছিলেন যে, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে আওয়ামী লীগ জোয়ারে ভেসে যাবে। দলের অভ্যন্তরেও একটি মহল এই ধারণা পোষণ করত। শেষ সময় নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও কুশলী আওয়ামী লীগ নির্বাচনী তফসিল পুনর্বিন্যস্ত করতে অস্বীকার করে। সেই নির্বাচনে আরেকটি দিক হলো শাসক দলের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ। দেশে ও বিদেশে আওয়ামী লীগ এই বলে সকলকে আশ্বস্ত করেছিল যে এটি নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। শিগগিরই একটি অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বিএনপি ওই প্রতিশ্রুতি এবং কূটনীতিকদের দেওয়া আশ্বাস বিশ্বাস করেছিল। কথায় আছে, যে যে রকম মানুষ, সে সে রকম চিন্তা করে।

খালেদা জিয়া একই রকম একটি নির্বাচন করেছিলেন ১৯৯৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তিনি দিন ১৫ পরে সংসদ ভেঙে দিয়েছিলেন। অনেকে মনে করেন, ১৯৯৬ সালের পরবর্তী নির্বাচনে বিএনপির হেরে যাওয়ার এটি একটি বড় কারণ ছিল। আওয়ামী লীগের দূরদর্শী নেতৃত্ব হয়তো ১৯৯৬ সালের নির্বাচন থেকে শিক্ষা নিয়েছিলেন। তাঁরা বুঝেছিলেন, আরেকটি নির্বাচনের অর্থ নির্ঘাত পরাজয়। তাঁরা আর ঝুঁকি নেননি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর রাজনৈতিক কুশলতা দ্বারা বহির্বিশ্বকে আশ্বস্ত করতে সক্ষম হন। সে সময় ভাগ্য তাঁকে সহায়তা করে। জঙ্গিবাদের ওপর তিনি শক্তি প্রয়োগ করে যখন সন্ত্রাস দমনের নামে বিরোধীদের দমন করেন, তখন বৈশ্বিক সমীকরণ তার পক্ষে চলে যায়। অপরদিকে, বিএনপি ২০১৫ সালে যে আন্দোলন পরিচালনা করে, তা সহিংস প্রমাণে সরকার সক্ষম হয়। যদিও বিরোধীরা বারবার দাবি করে আসছিল, ওই সব জ্বালাও-পোড়াওর পেছনে তারা ছিল না। তারপরও শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে শাসনকে নিরঙ্কুশ করার যে ধারাবহিকতা শুরু হয়, তা বিরোধী জামায়াত-বিএনপিকে কোণঠাসা করে ফেলে।

এখন যখন বিএনপি তথা বিরোধীগোষ্ঠীর সামনে আর একটি নির্বাচনের সুযোগ উপস্থিত হয়, তখন বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় অবশেষে। প্রবীণ নেতা ড. কামাল হোসেনসহ অন্যান্য জাতীয় নেতা বিএনপির এ সিদ্ধান্ত গ্রহণের পটভূমি তৈরি করে। গঠিত হয় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এই ফ্রন্ট নিয়মতান্ত্রিকভাবে গণতন্ত্রিক আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের প্রাথমিক সফলতা হলো সরকারের সঙ্গে সংলাপে অংশগ্রহণ।

দীর্ঘদিন ধরে বিএনপি সংলাপের আবেদন-নিবেদন করেও সাড়া পাচ্ছিল না। আওয়ামী লীগের কুশলী নেতৃত্ব সম্ভাব্য আন্দোলনে পানি ঢেলে দেওয়ার বুদ্ধিতে সংলাপে অংশগ্রহণ করে। এতে বিএনপি জোট উৎসাহিত হয়। সংলাপে প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদের সঙ্গে চমৎকার ব্যবহার করেন এবং দায়িত্বশীল নেতার মতো ভালো ভালো কথা বলেন। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আশ্বাস প্রদান করেন তিনি। তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ বুদ্ধিমত্তা দ্বারা বিরোধী জোটকে সংলাপে সংকুচিত করে ফেলেন। উদাহরণ হিসেবে সংলাপের আমন্ত্রণপত্রে ‘সংবিধানসম্মত বিষয়াদি’ সম্পর্কে আলোচনার কথা বলা হয়। ড. কামাল হোসেন যখন সাত দফা দাবি উত্থাপন করেন, তখন প্রধানমন্ত্রী এককথায় সেগুলো সংবিধানসম্মত নয় বলে এড়িয়ে যান। কিন্তু বিরোধী জোট যাতে হতাশ না হয়, সে জন্য আলোচনার দরজা খোলা রাখার ঘোষণা দেন।

ড. কামালরা সংবিধানসম্মত সমাধান খুঁজতে গিয়ে গলদঘর্ম হন। দ্বিতীয়বার যখন তাঁরা সংলাপে বসেন, তখন তাঁরা আরো আরো আশ্বাস ছাড়া কিছুই অর্জন করতে পারেননি। কুশলী প্রধানমন্ত্রী এবার যদিও আনুষ্ঠানিক আলোচনা শেষ করেন, তবুও তিনি ব্যক্তিগত বা অনানুষ্ঠানিক আলোচনার দ্বার খোলা রাখেন। সংলাপে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সন্তুষ্ট না হলেও অতি ভদ্রলোক ড. কামাল হোসেন প্রাথমিকভাবে সন্তোষ প্রকাশ করেন। নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রশ্নে উভয় সংকটে নিপতিত হয় বিএনপি।

প্রথমত, নির্বাচনে অংশগ্রহণ ব্যতীত ক্ষমতা আরোহণের আর কোনো উপায় বিশ্বাস করে না বিএনপি। দ্বিতীয়ত, জনগণের দল হিসেবে বিএনপি জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণে তৃণমূল পর্যায় থেকে শীর্ষ পর্যায় পর্যন্ত নেতাকর্মীদের চাপ রয়েছে। তৃতীয়ত, প্রান্তিক পর্যায়ে বিএনপি যে  জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে একীভূত হয়েছে, সেখানে শীর্ষ পর্যায় থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রবল তাগিদ ছিল। চতুর্থত, বিদেশে বিএনপির সহায়ক শক্তি ও কূটনীতিকরা নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে বারবার গুরুত্বারোপ করছিল। তাদের বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচনী অভিজ্ঞতা ব্যাখ্যা করলেও তারা আশ্বস্ত হয়নি। কূটনীতিকরা তাদের সহজ-সরল বিশ্বাস অনুযায়ী সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের প্রতিশ্রুতিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছে। সে কারণে সম্ভবত নির্বাচনকে এড়িয়ে যাওয়া বিএনপির জন্য সম্ভব ছিল না। পঞ্চমত, বিএনপির সাংগঠনিক কার্যক্রম দীর্ঘ এক দশকে স্থবির হয়ে পড়েছিল। নিপীড়ন-নির্যাতনে তারা জেলজুলুম ভোগ করছিল। হামলা-মামলায় তৃণমূল পর্যায়ে তারা বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। বিএনপি নেতৃত্ব নির্বাচনের সুযোগকে সাংগাঠনিক তৎপরতা ও নেতাকর্মীদের উজ্জীবনে একটি উপলক্ষ হিসেবে গ্রহণ করেছে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, গত এক দশকে গণতন্ত্রের রুদ্ধদ্বার অবস্থার পরিবর্তনের জন্য নির্বাচনকে আন্দোলনের অংশ হিসেবে ব্যবহার করা। যে অবস্থায় বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে, তা কোনো স্বাভাবিক বিষয় নয়। বিএনপির নেত্রী জেলে আছেন। বিএনপির ভার্চুয়াল চেয়ারপারসন দূরে আছেন। লক্ষ লক্ষ মামলা ঝুলছে। হাজার নেতাকর্মী জেল-জুলুম ভোগ করছে। শীর্ষ নেতৃবৃন্দ তোপের মুখে আছেন। কথিত লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড এখনো তৈরি হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও গায়েবি মামলা বন্ধ হয়নি। এ অবস্থায় অসম্ভব ঝুঁকিপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত বিএনপি নেতৃত্বকে নিতে হয়েছে। এত কিছুর পর বিএনপি অবশেষে নির্বাচনে টিকে থাকতে পারবে কি না, এ সন্দেহ অনেকের। কিন্তু মাঝপথ থেকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়নও বীরত্বের কথা নয়। তা ছাড়া জনগণ চাচ্ছে যে যেকোনো অবস্থায় বিএনপি যুদ্ধের ময়দানে থাকুক। সে অবস্থায় বিএনপি নেতৃত্বকে নিশ্চিত করতে হয়েছে যে তারা নির্বাচনের শেষ দেখে নেবে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতা আরো শক্তভাবে জাতিকে নিশ্চিত করেছেন যে তাঁরা নির্বাচনে থাকবেন। এতে নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি আস্থার ভিত তৈরি হয়েছে। এমতাবস্থায় নির্বাচন থেকে বিএনপির পলায়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, নির্বাচনের জন্য অপরিহার্য পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি।

জনগণ আশাহত হতে চায় না। তাদের সম্মিলিত শক্তি বাংলাদেশে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত করবে বলে সকলের দৃঢ় আশাবাদ।

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।