অভিমত

আ. লীগের মনোনয়পত্র ও হিসেবি রাজনীতি

Looks like you've blocked notifications!

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে সপ্তাহ  ধরেই বেশ ঢাঁক গুড়গুড় করা হচ্ছিল, কী জানি কী হয়। দলের নীতি নির্ধারণী পর্যায় থেকেই রহস্য লুকিয়ে রাখা হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখার পর জানা গেল ২৩০ জনের মতো প্রার্থী দলীয় মনোনয়নের চিঠি পেয়েছেন। কোনো কোনো আসনে দুজনও পেয়েছেন এবং সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা, আমলা, আইনজীবী ও ক্রিকেটারসহ নতুন মুখ এসেছে অন্তত ৪৬টি আসনে। এদের মধ্যে ক্রিকেটের প্রিয়মুখ নড়াইলের মাশরাফি বিন মোর্তজার নমিনেশন পাওয়াটা আওয়ামী লীগের বড় চমক হিসেবে হাজির হয়েছে। এ ছাড়া সাবেক পুলিশ প্রধান কিশোরগঞ্জের নূর মোহাম্মদ বড় প্রার্থী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন।

খ্যাতিমান ডাক্তার প্রাণ গোপাল দত্ত কুমিল্লা-৭ এ মনোনয়ন পাননি। মনোনয়ন পাওয়াদের মধ্যে স্বল্প সংখ্যক নারী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রার্থীরাও রয়েছেন। তাঁরা সবাই আগের চেনামুখ। অবাক কাণ্ড হলো, সবার কাছ থেকেই মনোনয়ন প্রত্যাহারের স্বাক্ষরও রেখে দেওয়া হয়েছে। এসবই জোটের ভোটের উদ্ভট হিসাবের হাস্যকর মেলোড্রামা। যা দোদুল্যমান রাজনীতিরই বিপদ স্মারক।  

আওয়ামী লীগের মনোনয়ন থেকে বাদ পড়ছেন কে কে, এ নিয়ে কয়েক দিন ধরে ব্যাপক গুঞ্জন শোনা গেছে। অন্তত দুজন শীর্ষ নেতা মনোনয়নের তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন। দুজন হলেন কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম। কিন্তু গেল বছরগুলোতে নানা কর্মকাণ্ডে অতি বিতর্কিত ঢাকার কামাল আহমেদ মজুমদার, নারায়ণগঞ্জের শামীম ওসমান, মাদারীপুরের শাজাহান খান, ফেনীর নিজাম উদ্দিন হাজারী, পটুয়াখালীর আ স ম ফিরোজ কিংবা ময়মনসিংহের ছোট গোলন্দাজ ওরফে ফাহমী গোলন্দাজ বাবেলদের ক্ষমতা প্র্যাকটিসের কোনো নড়চড় হলো না। শুধু চোখে পড়ার মতো বিতর্কিত ক্রীড়া উপমন্ত্রী নেত্রকোনার আরিফ খান জয়কে বাদ রাখা হয়েছে। কিন্তু কক্সবাজারের ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত এমন অভিযোগে অভিযুক্ত আব্দুর রহমান বদির পরিবর্তে তাঁর স্ত্রী শাহীনা আক্তার চৌধুরীকে মনোনয়নের চিঠি দেওয়াটা বড় বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। কারণ বদির অবস্থান থেকে বাইরে এসে তাঁর স্ত্রী কক্সবাজারে সুশাসন দেবেন এমনটা কারোরই বোধ হয় না।

দেশের রাজনীতির হালহকিকত কেমন তার অনেকটা আঁচ পাওয়া যায় পার্টির মনোনয়ন কার্যক্রম দেখে। দেশে এখনো কোনো একটি একক দল তাদের ভালো কাজ ও যোগ্যতা দিয়ে নিজেদের প্রমাণ করতে পারেনি যে তারা নিঃসংশয়ে ৩০০ আসনে প্রার্থী দিতে পারে। নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে তাদের বিভিন্ন জোটে, দলে বা উপদলে বিভাজিত হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়।

ঘাড়ে চেপে থাকা একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও ধর্মান্ধ দল জামায়াতের হাত থেকে বাঁচার পথ খুঁজছে বিএনপি, কিন্তু ছাড়তে পারছে না। অন্যদিকে ধর্ম নিরপেক্ষতাকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে আওয়ামী লীগ এখন দেশের মোল্লাতন্ত্রের প্রধান প্রমোটার হয়ে উঠতে চাইছে। নিজেদের কৃতকর্মের ওপর আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি থেকেই এমনটা ঘটছে। দেশের দুই বড় দলের ঘোরপ্যাঁচে পড়া রাজনীতিকে নিবন্ধনবিহীন নামকাওয়াস্তে থাকা সাম্প্রদায়িক ছোট দলগুলোকেও এখন পাত্তা দিতে হচ্ছে। ভোটে দাঁড়ালে যাদের জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার কথা সেই গণফোরাম, নাগরিক ঐক্য বা বিকল্পধারাকেও সমঝে চলছে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি। একদিকে বিএনপির সাথে জোটে থাকায় বিএনপির অনেক প্রার্থীকে ঐক্যজোটের প্রার্থীদের কাছে মনোনয়ন বঞ্চিত হতে হবে। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের বঞ্চনার শিকারদের আশ্রয় হয়ে ওঠেছে ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম বা অন্য ছোট দল। আওয়ামী লীগ তাদের ২৩০ আসনের প্রার্থী দেখাতে পেরেছে। বাকিটা ওই ভাগাভাগির রাজনীতির জন্যই হয়তো তুলে রাখা হয়েছে। বিএনপিতেও এমনটার ব্যতিক্রম হবে না। কিন্তু এতে নিজের দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের যে কতটা বঞ্চনার শিকার হতে হয় এটা কে কাকে বুঝাবে? নিজেদের স্বার্থ ত্যাগ করে দেশ ও দশের মঙ্গল সাধনের ব্রত যদি হতো সবার একমাত্র অভীপ্সা তবে হয়তো এমন রুটি ভাগাভাগির খেলা চালাতে হতো না।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করছে বলে সর্বসুবিধা তারাই পাচ্ছে। এখনো নির্বাহী বিভাগ শাসন বিভাগেরই পূর্ণ অনুবর্তী। তবু ভজঘটে গণতন্ত্রের বিপুলবিস্তারি ঝড়ের আঁচ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে বিরোধীদের নির্বাচনে অংশ নিতে হচ্ছে। যদিও তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচন কমিশন, নির্বাহী বিভাগ বা পুলিশ প্রশাসন তাদের নিরপেক্ষতার প্রমাণ রাখতে সক্ষম হয়নি। প্রায় প্রতিদিনই বিএনপি ও তাদের জোট ঐক্যফ্রন্টের তরফে ইসিতে অভিযোগনামা হাজির করা হচ্ছে। ইসিও তাদের মতো করে অভিযোগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সে হয়তো অধরাই থেকে যাবে। এরমধ্য থেকেই বিরোধীজোটের যা কিছু পাওনা হবে আগেরবার ভোট বর্জনের খেসারতের পরিপ্রেক্ষিতে তাই হয়তো বড় প্রাপ্তি হিসেবে দেখা হবে।

মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়। কিন্তু সামাজিক সাম্য ও মানবিক মূল্যবোধ পরিহার করে যেনতেনভাবে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার কৌশলই এখন বাংলাদেশের রাজনীতির আসল প্রতিচ্ছবি। ধর্মান্ধ ও স্বার্থান্ধ গোষ্ঠীর কাছে আত্মা বিক্রি করে দিয়ে দেশটাকে ক্রমাগত ডানপন্থায় নিয়ে যাওয়ার ফল নিশ্চিতই ভোগাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে। যার নিদান বের করবার তরিকা আওয়ামী লীগ বা বিএনপির কারো হাতেই থাকবে না। স্ব-আরোপিত চন্দ্রগ্রহণের অন্ধকার আচ্ছন্নতা কাটাতে পারবে এমন বোধোদয়ের সূর্যালোক আর কবে কোথায় পাবে বাঙালি?

স্বাজাত্যবোধসম্পন্ন ও উদারনৈতিক বাঙালি মানস ঘটনের চর্চা যেমন এখানে নেই, তেমনি সৎ ও দুর্নীতিমুক্ত প্রার্থী বাছাইয়ের সুযোগও আমজনতার নেই। পার্টি থেকে চাপিয়ে দেওয়া একজন উড়ে এসে জুড়ে বসা অর্বাচীন নেতাকেই ভোট দিয়ে জিতিয়ে দিতে হবে। ভোটারের এমন অসহায়ত্বই বুঝি এই উপমহাদেশের গণতন্ত্রের আসল সারবত্তা?   

আমরা শুধু চাইতেই পারি, দেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে। সবার সমান অংশগ্রহণ থাকবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, ধর্মনিরপেক্ষ, জনবান্ধব, বিবেকবান ও সৎ মানুষেরা দেশসেবার দায়িত্ব গ্রহণ করবে। যেখানে গলাবাজি, হিংসা, হানাহানি বা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার ভাষা রূপান্তর হয়ে যাবে পরমতসহিষ্ণুতা ও প্রাণান্ত ভালোবাসায়। নামকাওয়াস্তে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি নয়, প্রকৃত মানুষের হাত ধরে দেশে ফিরবে সুশাসন। অব্যাহত থাকবে উন্নয়নের গতিধারা এবং সমুন্নত থাকবে মানুষের অধিকার। কিন্তু মানুষের রন্ধ্রে ঢুকে যাওয়া অনাচারের বিষ কি একদিনে দূর হবে? তবু সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ভোট হোক ভালোর পথে পরিবর্তনের অবলম্বন।

লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন