মিনা ট্র্যাজেডি

হজের বহুজাতিক ব্যবস্থাপনা বিতর্ক

Looks like you've blocked notifications!

অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন (OIC) বা ওআইসিকে অনেকে রসিকতা করে বলেন, Oh I see…। সারা বিশ্বের মুসলমানদের স্বার্থরক্ষা এবং মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ তৈরিতে এই আন্তর্জাতিক সংগঠনের দায়িত্ব পালনের কথা থাকলেও মক্কায় যখন শত শত হাজির পদদলনে মৃত্যু হয়, মধ্যপ্রাচ্যে যখন ইসলামের নামে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস শত শত মানুষের জান নেয়, গুঁড়িয়ে দেয় হাজার বছরের সব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, তখন ওআইসির ভূমিকা অনেকটা Oh I see-এর মতো। জানিয়ে রাখি, ওআইসির বর্তমান মহাসচিব ইয়াদ বিন আমিন মাদানি সৌদি আরবের নাগরিক।

তীর্থযাত্রা
পবিত্র স্থানগুলোতে তীর্থযাত্রা একটি প্রাচীন সেমিটিক প্রথা। ইসলাম-পূর্ব দিনগুলোতে যু-আল হিজ্জাজ নামে উত্তর আরবের বার্ষিক মেলা হতো কাবা ও আরাফায়। এ দুটি স্থানকে কেন্দ্র করে প্রাচীন তীর্থযাত্রা-সংক্রান্ত এই আচার মহানবী (সা.) গ্রহণ করেন হিজরি সপ্তম বর্ষে। তিনি এর ইসলামীকরণ করেন।

প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে তীর্থযাত্রী বা হাজিদের বার্ষিক গড় ছিল এক লাখ ৭২ হাজার। তখন থেকেই হাজির সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকে এবং ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে তা ১০ লাখে পৌঁছায়। এ সময় মিসর ও পাকিস্তান থেকে সবচেয়ে বেশি তীর্থযাত্রী বা হাজি মক্কায় যেতেন। তেল আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত এই তীর্থযাত্রা বা হজই ছিল সৌদি আরব তথা সাবেক হিজাজের আয়ের প্রধান উৎস। সৌদি আরবের প্রভাবশালী গণমাধ্যম আল-আরাবিয়ার হিসাবমতে, এখনো সৌদি আরব প্রতিবছর সাড়ে আট বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা আয় করে শুধু হজ থেকেই।

মৃত্যুর সংখ্যাতত্ত্ব
হজের আনুষ্ঠানিকতা চলাকালে গত ২৪ সেপ্টেম্বর মক্কা নগরীর মিনায় ‘শয়তানের স্তম্ভে’ পাথর ছুড়ে ফেরার পথে পদদলিত হয়ে হাজারেরও বেশি হাজি নিহত হন। এর ১৩ দিন আগে ১১ সেপ্টেম্বর মক্কায় মসজিদ আল-হারামের (গ্র্যান্ড মসজিদ) বর্ধিতাংশের নির্মাণকাজের সময় ছাদ থেকে ক্রেন ভেঙে পড়ে নিহত হন আরো অন্তত ১০৭ জন। আহত হন দুই শতাধিক। একসঙ্গে ২২ লাখ মুসল্লিকে জায়গা দিতে মসজিদ এলাকা চার লাখ বর্গমিটার বাড়ানোর কাজ চলছিল।

এ কারণে মসজিদের বিভিন্ন দিকে ভারী ভারী ক্রেনে কাজ চলছিল। ঝড়ো বাতাসে ওই ক্রেনগুলোর একটি ভেঙে পড়ে এ দুর্ঘটনা ঘটে। তবে হজ পালন করতে গিয়ে হাজিদের মৃত্যু নতুন নয়। ২০০৬ সালেও প্রতীকী শয়তানকে পাথর মারতে গিয়ে জামারাত সেতুতে প্রাণ হারিয়েছিলেন ৩৬৪ জন। ১৯৯৭ সালে মিনায় তাঁবুতে অগ্নিকাণ্ডে মারা যান ৩৪০ জন, ১৯৯৪ সালে কঙ্কর নিক্ষেপ করতে গিয়ে ২৭০ জনের প্রাণ যায়। তবে গত ২৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা হয় ১৯৯০ সালে। ওই বছরও পদদলিত হয়ে মারা যান এক হাজার ৪২৬ জন হাজি। এর তিন বছর আগে ১৯৮৭ সালে প্রাণ যায় আরো ৪০২ জনের। আর সর্বশেষ ২০১৫ সালে মিনায় পদদলিত হয়ে মারা যান ৭৬৯ জন হাজি।

দায় কার
‘বাদশাহর ছেলে প্রিন্স জামারায় ঢিল মারতে গেছিল। ঢিল মারতে যাওয়ার দরুন তাঁর অনারে সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে দিছে। বন্ধ করার কারণে মানুষ যেখানে গিয়া আটকায়, সেখানে আর কোনো জায়গা থাকে না। পিছন থেইকা চাপ লাগলে, ইটা যেমন দাঁড় করায়া রাখলে ধাক্কা দিলে একটার পর একটা পড়তে থাকে; অমন ধাক্কায় মানুষগুলার অবস্থা এ রকম হইছে।’ হজ শেষে দেশে ফিরে বিমানবন্দরে পদদলিত হওয়ার ঘটনার ব্যাপারে এভাবে প্রতিক্রিয়া জানান হাজিরা। গণমাধ্যমে এ খবর এসেছে। মিনার দুর্ঘটনাকে হাজিরা কেবল দুর্ঘটনা বলে মানতে নারাজ; বরং তাঁরা এর জন্য অব্যবস্থাপনাকেই দায়ী করেছেন। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যম, বিশেষ করে ইরানের গণমাধ্যমগুলো মিনায় মৃত্যুর কারণ হিসেবে বলছে, সৌদি প্রিন্সের গাড়িবহর ও নিরাপত্তা প্রহরার বাড়াবাড়ির কথা। বৃহত্তম মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়াও মিনা ট্র্যাজেডির জন্য সৌদি সরকারকে দায়ী করেছে।

যদিও মিনায় পদদলিত হয়ে হাজিদের মৃত্যুর ঘটনাকে অনেকটা ‘ভাগ্যদোষ’ বলে ইঙ্গিত করেছিলেন সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা গ্র্যান্ড মুফতি শেখ আবদুল আজিজ বিন আবদুল্লাহ আল-শেখ। আবার দেশটির সরকারের তরফে এমন দাবিও করা হয়েছিল যে, ইরানের কিছু হাজি নিয়ম না মানায় বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়, যার ফলে ওই দুর্ঘটনা। কিন্তু এ অভিযোগ নাকচ করে দেয় ইরান।

বস্তুত আরাফার মূল হজ শেষে মুজদালিফায় রাত্রিযাপনের পর মিনায় যাত্রা এবং জামারায় পাথর মারার আনুষ্ঠানিকতায় সবচেয়ে বেশি ভিড় হয়। এই ভিড় এড়ানোর জন্য সৌদি কর্তৃপক্ষ পাথর নিক্ষেপের জন্য সুপরিসর তিনটি ফ্লোর তৈরি করেছে। একই সঙ্গে পাথর নিক্ষেপের জন্য প্রবেশ ও বের হওয়ার রাস্তা আলাদা করা হয়েছে, যাতে বিপরীতমুখী স্রোত মুখোমুখি হয়ে পদদলিত হওয়ার মতো দুর্ঘটনা না ঘটে।

কিন্তু এবার জামারায় প্রবেশের আগে ২০৪ নম্বর সড়কে পাথর নিক্ষেপে প্রবেশ ও বের হওয়া জনস্রোত মুখোমুখি হয়। বলা হচ্ছে, সৌদি যুবরাজ নিজে ওই সময়ে জামারায় গিয়েছিলেন পাথর ছুড়তে এবং তাঁর নিরাপত্তার জন্য কয়েকশ প্রহরী ও গাড়ির বহরের কারণে বের হওয়ার মূল পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে সরু পথে একসঙ্গে বহু মানুষের গাদাগাদিতে পদদলনের ঘটনা ঘটে।

দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ জানতে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন সৌদি বাদশা। কিন্তু যদি সত্যিই ওই ঘটনায় যুবরাজের দায় থাকে, তাহলে সেটি তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসবে কি না বা ওই প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে। তবে প্রতিবছর হজের সময়ই কোনো না কোনো দুর্ঘটনা ঘটেই থাকে। এর জন্য অনেকে সৌদি পুলিশ সদস্যদের অনভিজ্ঞতা এবং ভাষা সমস্যাকেও দায়ী করেন। হাজিদের অনেক বলেছেন, পুলিশ সদস্যদের অনেকেই হাজিদের সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারেননি। এমনকি তাঁরা হাজিদের সঠিক রাস্তাও দেখিয়ে দিতে পারেননি। তা ছাড়া ভাষাগত সীমাবদ্ধতার কারণে তাঁরা বিদেশিদের সঙ্গে ভালোভাবে যোগাযোগও করতে পারেন না। তাঁদের সঠিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না বলেও অভিযোগ করেছেন অনেকে।

এ কথা সত্যি, ২০ লাখ লোকের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ সহজ ব্যাপার নয়। কিন্তু অধিকাংশ হজযাত্রীই সুশৃঙ্খলভাবে আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন। ফলে সঠিক ট্রাফিক নির্দেশনা কার্যকর করা খুব কঠিন হয় না। কিন্তু কোনো কারণে আগমন-নির্গমনের ট্রাফিক নির্দেশনা ভুল হলে সেটির খেসারত দিতে হয় মারাত্মকভাবে। তবে মিনায় মাটির নিচ দিয়ে অথবা ফ্লাইওভারের মাধ্যমে সড়ক ক্রসিংয়ের ব্যবস্থা করা গেলে এ ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা অনেকখানি কমে যাবে বলে অনেকে মনে করেন।

কাবার মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা
কাবার মালিকানা কার—সৌদি আরবের, নাকি পুরো মুসলিম বিশ্বের? সমগ্র পৃথিবীর মুসলমান যে ঘরের দিকে মুখ করে নামাজ পড়েন, সেই ঘরের ব্যবস্থাপনায় কি এমন একটি পদ্ধতি থাকবে না, যেখানে সমস্ত পৃথিবীর মুসলমানদের অংশগ্রহণ, দায়িত্ব ও অংশীদারিত্ব থাকবে? দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, মুসলমানদের নিরপেক্ষ প্ল্যাটফর্ম বলে আদৌ কিছু কি আছে? ওআইসি নামে যে নখদন্তহীন আন্তর্জাতিক সংগঠনটি রয়েছে, তারাই বা কাবা তথা পুরো হজ ব্যবস্থাপনায় কী দায়িত্ব পালন করতে পারে?

মিনা দুর্ঘটনার পর অনেকেই এই দাবি তুলছেন যে, এককভাবে সৌদি আরবের ব্যবস্থাপনায় নয়, বরং বহুজাতিক ব্যবস্থাপনায় হজ হওয়া দরকার। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই বহুজাতিক বা যৌথ ব্যবস্থাপনা বলতে আসলে কী বোঝায়?

আবার বহুজাতিক ব্যবস্থাপনা হলেই যে দুর্ঘটনা এড়ানো যাবে, তারই বা নিশ্চয়তা কী? মনে রাখতে হবে, বহুজাতিক ব্যবস্থাপনার দাবি তুলেছে সৌদি আরবের প্রধান প্রতিপক্ষ ইরান। সৌদি আরবকে বাগে পেয়ে তারা এখন এমন একটি দাবি তুলছে কি না, যাতে করে পুরো মুসলিম বিশ্বের সমর্থন পাওয়া যায়, সে প্রশ্নও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

তবে হজের ব্যবস্থাপনা এককভাবে সৌদি আরবের থাকবে নাকি পুরো বিশ্বের মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সমন্বয়ে আসলেই একটি বহুজাতিক ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা উচিত, সে বিষয় নিয়ে ওআইসি একটি সংলাপের আয়োজন করতে পারে। আর এ উদ্যোগের মধ্য দিয়ে নখদন্তহীন এই প্রতিষ্ঠানও নিজেদের একটা ক্রেডিবিলিটি তৈরির সুযোগ পেতে পারে। এমনকি হজের ব্যবস্থাপনা নিয়ে জাতিসংঘও একটা আলোচনার সূত্রপাত করতে পারে।

হজ ব্যবসা নয়
সৌদি আরবকে মনে রাখতে হবে, হজ শুধু পয়সা আয়ের একটি উৎস নয়। তা ছাড়া সৌদি আরবের যে সম্পদ, তাতে প্রতিবছর হজ থেকে ৬৫ হাজার কোটি টাকা আয় না হলে তাদের অর্থনীতিতে বড় কোনো প্রভাব পড়বে বলে মনে হয় না; বরং তারা হজের সামগ্রিক খরচ কমিয়ে আনলে আরো বেশি মুসলমানের পক্ষে তাদের কেবলা দর্শনের মনোবাঞ্ছা পূরণ হতে পারে। তা ছাড়া হজের সময়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয়ের বিনিময়ে সৌদি সরকার হাজিদের নিরাপত্তা ও অন্যান্য ইস্যুতে কতটা আন্তরিক, সেটি নিয়েও যেহেতু প্রশ্ন উঠেছে, তাই তাদের নিজেদের ভাবমূর্তি রক্ষার স্বার্থেই পুরো হজ ব্যবস্থাপনা নিয়ে ভাবা দরকার। মুক্ত আলোচনাটা শুরু করতে পারে তারাই।

হজ ও শ্রেণিবৈষম্য
সৌদি কর্তৃপক্ষ উন্নয়নের নামে মক্কার আশপাশের পাহাড়গুলোতে বিলাসবহুল হোটেল তৈরি করেছে। এসব হোটেল-মোটেলের কক্ষ অনেক অর্থে ভাড়া নিয়ে সম্পদশালী মুসলমানরা সরাসরি কাবা শরিফ দেখার সুযোগ পান। কিন্তু আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক গরিব হজযাত্রীর রাত কাটে পবিত্র স্থান থেকে দূরে এবং তপ্ত আবহাওয়ার মধ্যে।

অথচ হজের সময় কোনো শ্রেণিবৈষম্য চোখে পড়ার কথা নয়। হজ মানুষে মানুষে, জাতিতে-শ্রেণিতে, দেশে ও সংস্কৃতিতে যে বিভেদ, তা ভুলিয়ে দেওয়ার মন্ত্র শেখায়। যে কারণে ইসলামের এই একটি মাত্র ইবাদত, যেখানে সবাইকে একই পোশাক পরতে হয়। যে পোশাক পরে মানুষকে কবরে যেতে হয়, সেলাইবিহীন সাদা কাপড়। এর অর্থই হলো, মানুষ নিজেকে নিঃস্ব, নিরহংকার, বিনয়ী এবং সৃষ্টিকর্তার কাছে পুরোপুরি সমর্পিত বলে ঘোষণা দিয়ে বলবে, ‘লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’, অর্থাৎ হে আমাদের প্রতিপালক, আমি হাজির, আমাকে গ্রহণ করুন।

সুতরাং যখন হজ ব্যবস্থাপনার কথা আসে, তখন হজ যাতে সম্পদশালী আর কম সম্পদের মালিকের মধ্যে কোনো বৈষম্য বা বিভেদ তৈরি না করে, সে বিষয়টিও হজের আয়োজনে থাকা দরকার।

লেখক : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর