বিজয়ের মাস

ভালোবাসার অঞ্জলিতে ভরে উঠুক বাংলাদেশ

Looks like you've blocked notifications!

মহান একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে গৌরবদীপ্ত বিজয়ের পর ৪৭ বছর পেরিয়ে এসে অনেক সম্ভাবনার কথা বলতে পারছি আমরা। অনেক অর্জনে বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছি। হতে পারে সামগ্রিক অর্থে মানুষের মুক্তি মেলেনি। সামাজিক বৈষম্য দূরীভূত হয়নি। তবু যে অগ্রযাত্রার সোপানে পা রেখেছি তা একদিন আমাদের পৌঁছে দেবে আকাঙ্ক্ষার সুবর্ণ শিখরে। অনেক তো অশান্তি ও ঘৃণাচর্চা হলো। বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে এবার অন্তত আমরা শান্তি ও ভালোবাসার কথা বলি। আত্মোৎসর্গের কথা বলি। বাঙালি জীবনে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতিবিজড়িত অর্জন মুক্তিযুদ্ধের বিজয়। আর সেই বিজয়ের স্মরণটা সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণে মহত্তম আনন্দোৎসব হয়ে উঠুক।

এবারের বিজয় দিবস অন্যরকম তাৎপর্য নিয়ে আসছে। এ সময় একাদশ জাতীয় নির্বাচনের উত্যুঙ্গ প্রচারণা চলবে। পাস করার পরের নির্বাচিত নেতা পাঁচ বছর কী করবেন তা শুনব আর আগের পাঁচ বছরে কী করেছেন তা আমরা সবাই জানি। তারপরও এ সময় একজনও খারাপ মানুষ হয়তো আমরা দেখব না। সবাই লাউড স্পিকারে গলা ফাটিয়ে বলবে, অমুক ভাইয়ের চরিত্র পুষ্পবৎ পুত পবিত্র। সেই পবিত্র ভাইয়েরা দেশটাকে ফুলের বাগান বানিয়ে দেবেন এমনটা কে না চায়? সবার সমান অংশগ্রহণে উৎসবমুখর নির্বাচনে প্রকৃত অর্থেই ভালো মানুষেরা জনপ্রতিনিধি হয়ে উঠুক। নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যারা এই পবিত্র ভূমিতে শান্তি ও ভালোবাসা অধিষ্ঠানের দূত হয়ে উঠবেন।

ডিসেম্বর বাঙালি জীবনে অন্যরকম দ্যোতনা সৃষ্টি করে। যুদ্ধজয়ের আনন্দ ভাগাভাগিটা কার না ভালো লাগে? একাত্তরে যে গোষ্ঠী পাকিস্তানকে  রক্ষার দাবিতে স্বাধীনতার চরম বিরোধিতা করেছে, মুক্তিযোদ্ধার প্রাণহরণ আর লাখো নারীর সম্ভ্রমহানিতে ভূমিকা রেখেছে, তারাও বিজয় দিবসে বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকা হাতে নিয়ে বিজয় মিছিল করবে। তারা এখন অবহেলায় ছুড়ে ফেলা সেই বাংলাদেশের আলো বাতাসেই আয়েসী দিনগুজরান করতে পারছে। ভাগ্যের পরিহাস হলেও এ যে অভাবনীয় ও বিস্ময়কর দৃশ্য তা না বললেও অনুভব করা যায়। যদিও তারা ক্ষমার অযোগ্য পাপকে তাদের বিধিলিপি করে তুলেছিল, তাদের উত্তরাধিকারকে সেই অমার্জনীয় গুণাহর বোঝা বয়ে বেড়াতে হচ্ছে, তবু পরাজিত শক্তি সেই তাদের মুখে যদি ভুল স্বীকারের অনুশোচনা বা ক্ষমা প্রার্থনার অনুতাপ শোনা যেত মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মন নিজেকে খানিকটা হলেও প্রবোধ দিতে পারত। আমাদের অহংকার এটাই, জুলুমবাজ যে পাকিস্তানের জন্য কিছু অমানুষ বিপথে পা রেখেছিল, এখনো সেই পাকিস্তানের জন্য যাদের অদ্ভুত মায়াকান্না, তাদের সেই পেয়ারা পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ নিজেদের প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি তুলছে, আমরা ইউরোপের মতো উন্নত দেশ চাই না, আমাদের একটা বাংলাদেশ বানিয়ে দাও। শহীদের আত্মার শান্তি এটাই, তাদের রেখে যাওয়া বাংলাদেশকেই এখন মডেল মানছে হানাদার পাকিস্তান। 

স্বাধীনতা অর্জনের জন্য চরম মূল্য দিতে হয়েছে বাঙালিকে। ৩০ লাখ শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে এই বাংলাভূমি। বেদনার অশ্রুজলে বন্যা হয়ে গেছে পদ্মা মেঘনা যমুনায়। সম্ভ্রম হারিয়েছেন তিন লাখ মা-বোন। লাখো মানুষ নির্যাতিত হয়েছেন, সহ্য করেছেন দুর্বিষহ যন্ত্রণা। শরণার্থীর জীবন বেছে নিয়েছিলেন কোটি মানুষ। দুঃখিনী বাংলা যাতে আর কারো পদাবনত না হয় সেজন্য যুগে যুগে লক্ষ তরুণ হাসিমুখে আগ্রাসী দানবের গুলি খেয়েছেন, জীবন দান করেছেন। গীতিকবি আব্দুল লতিফ যথার্থ বলেছেন :

দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা কারো দানে পাওয়া নয়

দাম দিছি প্রাণ লক্ষকোটি জানা আছে জগৎময়।

এমন একটি দেশের জন্য আমরা কী করে দেখাতে পারছি তা ভেবে দেখবার সময় এসেছে। চাইতে গেলে না পাওয়ার বেদনায় পুড়তে হয়। দেবার চেয়ে সুখ আর কোথাও কিছুতেই নাই। যে দেশটা আমার স্বতন্ত্র পরিচয় নিশ্চিত করছে, তার জন্যই তো অপার মায়া থাকতে হবে। কবির ভাষায় ধন ধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরার সবচে সেরা দেশ আমাদের বাংলাদেশ। এমন দেশ তো আমরা একটাও খুঁজে পাবো না। বুকটায় প্রশান্তিতে ভরায় যে ভূ-প্রকৃতি, যার দিকে তাকালে নয়ন জুড়ায়, যেই দেশে জন্মেছি বলে জীবনের সার্থকতা খুঁজি, আমাদের সকল প্রশস্তি হোক সেই বাংলা মায়ের জন্য। একদিন এই ভূমিতে মিলিয়ে গিয়ে আবার ফুল পাতা ঘাস হয়ে জেগে উঠব। সেই পুষ্পের মাধুর্যে মুখ লুকাবে অনাগত উত্তরাধিকার। এমন দেশপ্রেমের কথাই সুন্দর করে বলেন কবি ডি এল রায় :    

ভাইয়ের মায়ের এতো স্নেহ, কোথায় গেলে পাবে কেহ,

ও মা তোমার চরণ দুটি বুকে আমার ধরি,

আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি।

যদি আমরা শান্তির পায়রা উড়াতে চাই আকাশে বাতাসে, যদি সৌহার্দ্যের গান শুনাই মিলনের একতারায়, তবে সর্বান্তকরণে ভালোবাসার গল্পই বুনে যেতে হবে। যে মাটিতে বিশ্বময়ী ও বিশ্ব মায়ের আচঁল পাতা, যে মাতৃময়ী আমাদের দেহ ও প্রাণের সাথে মিশে আছে, যার শ্যামলবরণ কোমল মূর্তি আমাদের মর্মে গাঁথা, যে মা সকল দুঃখ সয়ে আমাদের মুখে অন্ন তুলে দেয়, শীতল জলে প্রাণ জুড়ায় সেই মাতার মাতা দেশের প্রতি আমাদের আত্মনিবেদন হোক সর্বস্ব ত্যাগে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দারুণভাবে দেশের প্রতি কর্তব্যবোধের সেই আত্মোপলব্ধিটা শিখিয়েছেন :

ও মা, অনেক তোমার খেয়েছি গো, অনেক নিয়েছি মা–

তবু জানি নে-যে কী বা তোমায় দিয়েছি মা!

দেশের বীর সন্তানেরা একাত্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে হানাদার পাকিস্তান ও তাদের এদেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ সংগ্রামে আত্মনিবেদন করেন। দীর্ঘ নয় মাস সংগ্রামের পর বহু মুক্তিযোদ্ধার প্রাণ ও মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। আমরা ভালো থাকলে দেশটাও স্বস্তিতে থাকে। আমরা একবার চেষ্টা করেই দেখি না, এই ভূমিতে অহিংসার আবাদ করে মানুষের প্রতি মানুষের মায়া-মমতা ফেরানো যায় কিনা। অসাম্প্রদায়িকতা, মানবিকতা ও সাধুতার চর্চা করে সকল শুভবোধের প্রতি আকর্ষন তৈরি করা যায় কিনা। আত্মস্বার্থ ত্যাগের মতো আনন্দকর আর কিছু নাই। ভালোর জয়, সুন্দরের বন্দনা আর সত্যের সাধন হলেই মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী দেশটার সার্থকতার আখ্যান রচিত হয়। বিজয়ের মন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে মহাপ্রভুর কাছে এই হোক প্রণতি ভালোবাসার অঞ্জলিতে সুশান্তির পল্লব মঞ্জুরিত উদ্যান হয়ে উঠুক আমাদের প্রাণের বাংলাদেশ। সেই বাংলাদেশের জন্য বিজয় নৈবেদ্য হোক রাবীন্দ্রিক এই অমৃত সুর :

ও মা, তোর চরণেতে দিলেম এই মাথা পেতে-

দে গো তোর পায়ের ধুলা, সে যে আমার মাথার মানিক হবে।

ও মা, গরিবের ধন যা আছে তাই দিব চরণতলে,

মরি হায়, হায় রে-

আমি পরের ঘরে কিনব না আর, মা, তোর ভূষণ ব'লে গলার ফাঁসি।

লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন