বীর প্রতীক তারামন বিবি

স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর অগ্নিকন্যা

Looks like you've blocked notifications!

১৯৭১ সালে চারিদিকে যুদ্ধের দামামা বাজছে। দেশজুড়ে অস্থিরতা। এক কিশোরী মেয়ে, তখনো যার চিন্তার পরিপক্বতা আসেনি। তাকে ডেকে এক বয়স্ক মুক্তিযোদ্ধা বলেলেন মা, ‘তুমি আমাদের মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে কাজ করবে ?  কাউকেই খুঁজে পাচ্ছি না, তুমি যাবে মা আমাদের সাথে ?  আমাদের  জন্য কাজ করবা ,  ভাত রাঁইধা দিবা, কী পারবা না মা ?’ মেয়েটি ভাবল সাত ভাইবোনের সংসার। বাবা মারা গেছেন অনেক আগেই। মাথার উপর রক্ষা করার মতো কেউ তো নাই। যার ভরসায় বেঁচে থাকব। মরতে তো হবেই। তাই যুদ্ধ করে বাঁচার চেষ্টা করলে দোষের কী ?  সেখান থেকেই গল্পের শুরু। সাতপাঁচ না ভেবে কিশোরী মেয়েটি তাদের সাথে যেতে রাজি হলো। মুক্তিযোদ্ধা তাকে ক্যাম্পে নিয়ে গেলেন। এই মেয়েটিই একসময় সাহস সঞ্চার করে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কাঁধেকাধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছেন।  তিনি তারামন বিবি। বাংলার সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা।

তারামন বিবি ১৯৫৭ সালে কুড়িগ্রাম জেলার রাজীবপুর উপজেলার কোদালকাটি ইউনিয়নের শংকর মাধবপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম বাবা আবদুস সোবাহান,  মায়ের নাম ছিল  কুলসুম বেওয়া। সাত ভাই বোনের সংসারে তিনি ছিলেন তৃতীয়।

তারামন বিবি আনুষ্ঠানিক শিক্ষা লাভের সুযোগ পাননি। দরিদ্র বাবার সংসারের ভার বহনের জন্য তাকে বাড়ি বাড়ি কাজ করতে হয়েছে। একসময় বাবা মারা গেলেন। কোনো রকমে চলছিল তাদের সংসার। এর মধ্যেই শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ।

তারামন বিবি ১১ নং সেক্টরে কুড়িগ্রাম জেলার শংকর মাধবপুরে ছিলেন। তখন ১১ নং সেক্টরের নেতৃত্বে ছিলেন সেক্টর কমান্ডার আবু তাহের (বীর উত্তম)। মুহিব হাবিলদার নামে এক মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবিকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করেন। তিনি তারামনকে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে রান্নাবান্নার জন্য নিয়ে যান। তখন তাঁরামনের বয়স ছিল  মাত্র ১৩-১৪ বছর। এভাবে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। রান্নার কাজ সামলিয়ে তিনি গুপ্তচর হিসেবে কাজ করতে থাকেন। তিনি ছদ্মবেশে বাইরে গিয়ে পাকিস্তাতিদের গতিবিধি লক্ষ করতেন।

ছদ্মবেশ ধরে খুব সহজেই তারামন বিবি পাকিস্তানিদের গতিবিধি লক্ষ রাখতেন। খবর সংগ্রহ করতে কখনো প্রতিবন্ধী কখনো পঙ্গুর মতো চলাফেরা করতেও দ্বিধাবোধ করেননি। কখনো সারা শরীরে কাদা মাটি চক, কালি এমনকি মানুষের বিষ্ঠা লাগিয়ে পাগল সেজেছেন তিনি। একদিন মুক্তিযোদ্ধা আজিজ মাস্টার তাঁকে নদ পার করে পাকিস্তানি ক্যাম্পের খবর আনতে বললেন। বুকের নিচে একটা কলাগাছ দিয়ে পরনের কাপড় যতটুকু কমানো যায় কমিয়ে রাতের অন্ধকারে তিনি নেমে পড়লেন ব্রহ্মপুত্রে। রাতের অন্ধকারে নদ সাঁতরিয়ে তিনি চললেন ব্রহ্মপুত্রের আরেক ঘাট খাড়বাজের উদ্দেশে। সারারাত সাঁতরে ভোরে তিনি জঙ্গলে লুকিয়ে থাকতেন। তারপর তিনি পাগলির বেশভূষায় নোংরা ময়লা ছেঁড়া কাপড় পরে চলে যেতেন শত্রু ক্যাম্পে। পাকিস্তানিরা তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখত। তিনি চুপচাপ পাগলামির অংশটা আরেকটু বাড়িয়ে দিতেন। এভাবে তিনি পাকিস্তানি হানাদারদের  এলএমজি, রাইফেল, ক্যাম্পের সৈন্য সংখ্যা , সব জেনে আবার নদ সাঁতরে ফিরে আসতেন।

তারামন বিবি শুধু মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে রান্নার কাজ কিংবা গুপ্তচরাবৃত্তিই করেননি। তিনি বারবার সম্মুখ সমরে অংশ নিয়েছেন। একদিন মাঝদুপুরে সহযোদ্ধারা খেতে ব্যস্ত। কিন্তু পাকিস্তানিরা যেকোনো সময় আক্রমণ করতে পারে। তাই সাবধান থাকতে হবে। তাঁর কাঁধে পড়ল আশপাশে লক্ষ রাখার জন্য। হাতে একটা দূরবীন নিয়ে তিনি উঠে পড়েন যোদ্ধা শিবিরের পাশের একটি সুপারি গাছে। হঠাৎ দূরবীনে ধরা পড়ে পাক-বাহিনীর গানবোট। সঙ্গে সঙ্গে কমান্ডারকে খবরটি পৌঁছে দিলেন তিনি। সবাই খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে প্রস্তুতি নেন আক্রমণের। তিনি সেদিন আর বসে থাকতে পারলেন না। তাকে অস্ত্র বিদ্যা শিখিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা মুহিব হাবিলদার। তিনি সেই বিদ্যার জোরে সেদিন হাতে তুলে নিলেন রাইফেল। সহযোদ্ধাদের সাথে নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকলেন সমান তালে। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলল যুদ্ধ। অবশেষে পাকিস্তানিরা পরাজিত হয়ে পিছু হটলো। এরপর তিনি অনেক যুদ্ধে পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে অংশ নেন। অনেক বার তাদের ক্যাম্প পাকবাহিনী আক্রমণ করেছে, তবে ভাগ্যের জোরে প্রতিবারই তিনি বেঁচে যান।

অবশেষে যুদ্ধ শেষ হয়। স্বাধীন হয় বাঙালির বাংলাদেশ। ১৯৭৩ সালে তৎকালীন সরকার মুক্তিযুদ্ধে তারামন বিবিকে তাঁর সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ‘বীরপ্রতীক’ উপাধিতে ভূষিত করে।

তারামন বিবির বিয়ে হয় আবদুল মজিদের সাথে। তিনি এক মেয়ে ও এক ছেলের জননী। খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলতে থাকে তাদের সংসার। এরপর দেশে নেমে আসে স্বৈরাচারী সামরিক শাসন। আর দশজন মুক্তিযোদ্ধার মতো তারামন বিবিও চলে যান আড়ালে। ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তাঁকে খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি। ১৯৯৫ সালে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক বিমল কান্তি দে প্রথম তাঁকে খুঁজে বের করেন। এরপর নারী সংগঠনগুলো তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসে। অবশেষে ১৯৯৫ সালের ১৯ ডিসেম্বর তৎকালীন সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে তারামন বিবির বীরত্বের পুরস্কার দেন। তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয় ‘বীরপ্রতীক’ সম্মাননা ।

বিজয় মাসের প্রথম দিনে একাত্তরের রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা বীরপ্রতীক তারামন বিবি

চিরবিদায় নিলেন। শনিবার কুড়িগ্রামের রাজিবপুর উপজেলার শংকর মাধবপুর গ্রামে নিজের বাড়িতে এই মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যু হয়।

মৃত্যুর আগে তারামন বিবি তরূণ প্রজন্ম আর সাধারণ দেশবাসীর কাছে দাবি জানিয়েছিলেন, ‘সোনার বাংলাদেশ পাওয়ার জন্যই আমরা যুদ্ধ করেছি। এই দেশকে যেন সবাই ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে। এই দেশে যেন আর খুন-খারাবি না হয়। ভবিষ্যতে আর কখনো যেন যুদ্ধ না হয়।’

সহায়ক তথ্য বিবরণী :

১. হাবিবুর রহমান খান (সম্পাদিত), গেরিলা নারী (নারী মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিকথা), ঢাকা, ২০১৫

২. কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ সফিকউল্লাহ (বীরপ্রতীক), মুক্তিযুদ্ধে বাংলার নারী, ঢাকা, ২০১১

৩. মুস্তাফিজ শফি ও তৌহিদুর রহমান (সম্পাদিত), একাত্তরের বিজয়িনী, ঢাকা, ২০১১

লেখক : কলাম লেখক