অভিমত

অরিত্রী ও শিক্ষার অপরাধচক্র

Looks like you've blocked notifications!

নিজ নিজ অবস্থান থেকে সবাই নিজেদের রাজন্য ভাবি। বাকিরা সকলে দাস। আড়াইশ বছর প্রজা থাকার স্মৃতি আমাদের মস্তিষ্ক থেকে সরাতে পারিনি। রাজা-প্রজার ব্যাপারটি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার গোড়াতেই আসন বিছিয়ে বসে পড়েছিল। আমরা সেই আসনে কুর্ণিশ করে গেছি। সমাজের এমন এক ধারণা তৈরি হয়েছে—গুরুর কথাই শেষ। তিনি যা বলবেন তাই শিরোধার্য। অতীতের কথা শুনেছি, নিজেদের কালেও দেখেছি –অভিভাবক গিয়ে শিক্ষককে বলছেন, হাড্ডিগুলো ফেরত দেবেন। আর কিছু চাই না।

এ কথায় শিক্ষকের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ পায় বটে, তবে শিক্ষকরা এই আনুগত্যকে রাজন্য-দাস সম্পর্কে রূপান্তর ঘটিয়ে ফেলেছেন। এই সময়ে এসেও চিত্র বদলে যায়নি। শিক্ষকদের মনোজগতে এ ধারণা গেঁথে গেছে—তিনি শিক্ষার্থীকে যেমন করে শাসন করতে পারেন, তেমন করে অভিভাবককে শাসনের অধিকারও তাঁর আছে। অভিভাবক শিক্ষার জন্য সন্তানকে শিক্ষকের কাছে বা বিদ্যায়তনে পাঠিয়ে দিয়ে যেন শেকলে আটকা পড়ে গেলেন। শিক্ষক এবং বিদ্যালয় অভিভাবকের সঙ্গে আচরণ করতে পারেন যেমন খুশি। অভিভাবকদের সঙ্গে ব্যবহারের কথাতে পরেই আসি। আগে আলাপ হোক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আচরণ বা শাসনের ধরন নিয়ে। মনে পড়ে নিজের স্কুলবেলার কথা। প্রভাতি শাখার শিক্ষার্থীরা ক্লাস থেকে বের হওয়ার সময় দিবা শাখার একজন শিক্ষার্থী একটু আগেই ঢুকে পড়ে। পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র সে। ব্যস শিক্ষক এসে বেধড়ক পেটাতে থাকলেন। শরীর ফুলে গেল ছেলেটির। অভিভাবকরা প্রধান শিক্ষকের কাছে বিষয়টি জানাতে গিয়ে অপদস্ত হলেন। নবম শ্রেণির ক্লাস চলছে। একজন অভিভাবক সানগ্লাস পরে এসেছেন। ব্যস তাকে শিক্ষক অপমান করে তাড়িয়ে দিলেন এবং ছাত্রকে তুলে এনে অমানবিক ভাবে পেটালেন। কোনো প্রতিবাদ করার সাহস দেখাতে পারল না কেউ। সপ্তম শ্রেণিতে একজন ছাত্র গণিতে কম নম্বর পেয়েছে। তাই তাকে টিফিন খেতে দিলেন না শিক্ষক। উল্টো টিফিনের খালি গামলা দেখিয়ে বললেন –তুই গামলা চাট। সপ্তম শ্রেণিরর ছাত্রের জন্য এটা কতবড় মানসিক যন্ত্রণা ভেবে দেখুন।

এখনকার সময়ে ফেরা যাক। বনশ্রী ন্যাশনাল আইডিয়ালের একজন ছাত্র গ্রামের ছবি এঁকেছিল। সেই ছবি ছাপা হয় পত্রিকায়। বন্ধুদের দেখাতে পত্রিকা নিয়ে যায় স্কুলে। শিক্ষকের নজরে পড়ে। তিনি পত্রিকা কেড়ে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলেন। ছবি আঁকার জন্য ওই ছাত্রকে ধমক দেন। ধানমণ্ডির অরণী স্কুলে এক শিক্ষক ছাত্রীকে শাসন করতে গিয়ে এত জোরে কাঁধে চাপ দিয়ে ধরেন যে, মেয়েটির কাঁধের হাড় নড়ে যায়। এমন অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে ইংরেজি-বাংলা মাধ্যমের সব স্কুলের বেলাতেই। শিক্ষার্থীদের দিকে ডাস্টার ছুড়ে দেওয়াসহ অনেক মানসিক নির্যাতনের কথাও আমরা জানি।

স্কুলের শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষক নিজেদের রাজন্য মনে করেন বলেই তারা অভিভাবকদের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক রক্ষা করেন না। উদয়ন বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর মা বা বাবাকে তলব করেন শ্রেণি শিক্ষক। কিন্তু সেদিন ঐ শিক্ষার্থীর বাবা-মা দুজনই শহরে ছিলেন না। বদলে শিক্ষার্থীর খালা গেলেন। তিনিও স্থানীয় অভিভাবকের তালিকায় আছেন। তাকে দেখেই উত্তেজিত হয়ে ওঠেন শ্রেণি শিক্ষক। যাচ্ছেতাই ব্যবহার করতে থাকেন। অধ্যক্ষের কাছে এ নিয়ে কথা বলতে গেলে তিনি নিজেও খারাপ ব্যবহার করতে থাকেন। আরেকদিন অন্য এক অভিভাবক উদয়নের অধ্যক্ষকে ফোন করলেন একটি সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে। তিনি ফোন কেটে দেন উষ্মা প্রকাশ করে। সারাদেশের এমন অনেক বিদ্যায়তনের শিক্ষকদের কথা এভাবে তুলে ধরা যাবে। স্কুল ভিত্তিক সংগঠনের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি আমাদের শিক্ষকরা কেমন করে সংস্কৃতি চর্চা থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। বইপড়া, খেলাধূলা ও সাংস্কৃতিক চর্চার বিষয়ে তাদের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। শিক্ষকদের যে রাজন্য আচরণের কথা বললাম এতক্ষণ, এর মাঝেও কিন্তু ছাত্রবান্ধব শিক্ষকের ঘাটতি ছিল না। এখন সেখানে টান পড়তে শুরু করেছে।

ভিকারুননিসা নূন স্কুলে অরিত্রী অধিকারি এবং তার অভিভাবকদের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে, এই আচরণ এমন তারকা খচিত স্কুল-কলেজগুলোতে নিয়মিতই হচ্ছে। কোনো প্রতিবাদ নেই, প্রতিকার নেই। কারণ আমরা অভিভাবকরা এসব স্কুলে সন্তানদের ভর্তি করানোর জন্য কাঙাল হয়ে থাকি। নিজ এলাকায় যথাযথ লেখাপড়া হয় এমন স্কুলকে পাত্তা না দিয়ে আমরা দৌড়াচ্ছি এসব তারকা খচিত স্কুলের দিকে। এখানে ভর্তির জন্য, কোচিং, ডোনেশন, তদবির কোনোটিই বাদ রাখি না। এই কাঙালিপনাকে পুঁজি করেই তারা আমাদের দাস বানিয়ে রাখছে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এলাকাভিত্তিক মানসম্মত স্কুল তৈরির পেছনে বিনিয়োগ কম রয়েছে। বিনিয়োগ নেই মানসম্পন্ন শিক্ষক তৈরিতেও। মেধাবীরা আসছে না শিক্ষকতায়। শুধু মেধাবীরাই নয়, সুন্দর মানসিক চিন্তা ও রুচির মানুষরাও এখন বিদ্যায়তন থেকে দূরে। যারা আছে, তারা গাইড, কোচিংসহ নানা বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত। ব্যবসায় যুক্ত মানুষদের কাছে অরিত্রীর বাবা-মা শিক্ষকের উদারতা খুঁজেছিলেন। পাননি। অরিত্রী ভুল করতে পারে। সেলুলার ফোন নিয়ে পরীক্ষার হলে যাওয়াকে সমর্থন করছি না। কিন্তু ওর এই ভুলকে ক্ষমা করার মহৎ গুণ আমাদের শিক্ষকদের আছে, সেই বিশ্বাস রাখতে চাই বরাবর। কিন্তু ভিকারুননিসার শিক্ষকরা তা রাখতে দিলেন না। এখন নানা কমিটি হয়েছে। দোষ যাচাই ও খোঁজার জন্য। এই উদ্যোগ সাময়িক। অল্পদিনের মধ্যে আমরা অরিত্রীকে ভুলে গিয়ে আবারও উন্মাদ হবো ভিকারুননিসা নূন স্কুলে সন্তানকে ভর্তি করানোর জন্য। অভিভাবক হিসেবে আমরাও অপরাধের তালিকার বাইরে থাকছি না। অরিত্রী যখন মন খারাপ করে বাড়ি ফিরল, তখন তার পাশে থেকে মানসিক সাহচার্য দেওয়ার দায়িত্বটিও কিন্তু অভিভাবকেরই ছিল। সব মিলিয়ে শিক্ষার যে অপরাধ চক্র তৈরি করে রেখেছি আমরা, সেই ঘূর্ণিতে পড়ে অরিত্রীরা কেবল হারিয়ে যায়।

লেখক : বার্তা প্রধান, সময় টেলিভিশন