আত্মহত্যা

অপার সম্ভাবনার অপমৃত্যু!

Looks like you've blocked notifications!

শিক্ষা পণ্য হয়ে উঠবার এই সন্ধিক্ষণে আমাদের শিক্ষক ও স্কুল পরিচালনা পর্ষদের পুঁজিবাদি লুটেরা মনোবৃত্তি কতটা মাত্রা ছাড়িয়েছে তার সবিশেষ উদাহরণ হয়ে উঠল ভিকারুননিসা নূন বিদ্যাপীঠ। আর সেই বাজে দৃষ্টান্তটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে নিজের প্রাণ বিসর্জন করতে হলো অপার সম্ভাবনাময় মেধাবী ছাত্রী অরিত্রী অধিকারীকে। দেশের শিক্ষা এখন বড়ই ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। সেই কণ্টকাকীর্ণ বিপথ থেকে আমার আপনার সন্তানদের কারোরই রেহাই নেই। শিক্ষক নামের যেসব মানুষকে আমরা পিতামাতারও অধিক সম্মানতুল্যে দেবতা জ্ঞানে ভজন করি তারাই আজকের দিনে হয়ে উঠেছেন স্বেচ্ছাচারী কপট ও অমানুষ। তারা শিশুকে বিপদ দুর্বিপাক থেকে আগলে রাখতে জানেন না, মায়া মমতা করতে জানেন না, ভালোবাসতে জানেন না; তারা শুধুই শিখেছেন ভয় দেখাতে আর ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করতে। এই সব শিক্ষকের জন্য সবার আগে নৈতিকতার স্কুল খুলে মানবিক বিদ্যার পাঠ দেওয়া হোক। তারপর না হয় তারা জ্ঞান বিলাতে আসবেন।

যারা শিশু অরিত্রীকে পরীক্ষার হলে মোবাইল রাখার অভিযোগে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিলেন তারা কি এখন ভালো আছেন? নিজেদের আত্মাকে প্রবোধ দিতে পারছেন? একটি শিশুর বুকে কতটা অসম্মানের অভিমান জমলে নিজের সুন্দর প্রাণের প্রতি মায়া ত্যাগ করতে পারে তা কি স্কুল শাখার প্রধান জিন্নাত আরা, প্রিন্সিপাল নাজনীন ফেরদৌস বা পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা অনুভব করতে পারেন? নাকি টাকার গন্ধে বিভোর হয়ে অনেক আগেই তারা আসলে মানবতা খুঁইয়েছেন? ভিকারুননিসা সবার পছন্দের জায়গা। অভিভাবকরা নিজেদের সন্তানদের সেখানে স্থান করে দিতে পারলে স্বর্গ হাতে পাওয়ার মতো সুখ অনুভব করেন। এই সুযোগে স্কুল কর্তৃপক্ষও তাদের দামটা করে নিয়েছেন আকাশচুম্বী। যেই আকাশে তারা হওয়ার অধিকার শুধুই বিত্তবান প্রতিভাধরদের। ভুল করে যারা পরীক্ষার হলে মোবাইল বহন করবে বা সামান্য শৃঙ্খলা ভঙ্গ করবে তাদের স্থান ওই স্বর্গপুরী নয়! বোধের কী বিস্ময়কর অবনমন! কী একপক্ষীয় ও বৈষম্যপূর্ণ উপলব্ধি!

শিশুদের ভুলের নিকাশ করা এই সব শিক্ষকদের কাজ? নাকি শিশুর অন্তরের আলোকে আলোকবর্তিকায় রূপান্তর করবার সদিচ্ছা হওয়া উচিত সবার প্রতিজ্ঞা। শিশুদের অমিত সম্ভাবনার পালে যারা প্রজ্ঞার বাতিঘরসদৃশ হাওয়া দিতে জানেন না, সেসব অচলায়তন ও অচল শিক্ষাসভ্যদের আমাদের দরকার নেই। হিটলারের একগুঁয়ে স্বৈরশাসনের মতো চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় শিক্ষা না, শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের সর্বান্তকরণেই হতে হবে উদারনৈতিক ও বিনয়াবনত। শিশুদের কাছ থেকে শিক্ষা নেওয়ার মানসিকতা যাদের না থাকবে তাদের শিক্ষকতা পেশায় না এলেও চলবে। শিশুদের কাছে সেই সব ভীতিকর অনাদর্শরা বরং দমন-পীড়ননির্ভর অন্যবিধ পেশা বেছে নিতে পারেন। শিক্ষালয় টাকা কামানোর ধান্ধা বা নিপীড়ক স্বৈরতান্ত্রিক অপরাজনীতির জায়গা নয়।

অরিত্রীর বাবা মায়ের কাছে আমাদের তরফ থেকে কোনো ধরনের সান্ত্বনার বাণী শোনানো রীতিমতো পাপ। মমতায় গড়া নিজেদের হৃদয়ের অংশবিশেষ অকালে হারিয়ে ফেলবার কোনো সান্ত্বনা হয় না। অরিত্রীর বাবা মা হেড মিস্ট্রেসের কাছে গেছেন, প্রিন্সিপালের কাছে গেছেন। সবার কাছে করজোড়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করেছেন। তারপরও অকারণ ক্রুদ্ধ কর্তারা টিসি দিয়ে শিশুটিকে নিজেদের প্রতিষ্ঠান থেকে বের করে দিতে চেয়েছেন। মেয়েটি নিজের সামনে পিতামাতার এমন অপমান কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। অতঃপর ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর রাষ্ট্রের তরফে শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত হয়ে ঘটনাটিকে হৃদয়বিদারক বলে তদন্তের আশ্বাস দিয়েছেন। যে তদন্ত কোনোদিনই অরিত্রীর মতো নিষ্পাপ শিশুকে পৃথিবীতে আর ফিরিয়ে দিতে পারবে না। পারবে না দিলীপ অধিকারী বা আমাদের মতো সংবেদনশীল মানুষদের বুকের বেদনার উপশম করতে।

জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা অনুযায়ী প্রতিটি শিশুর প্রাপ্য হচ্ছে বিশেষ যত্ন ও সহায়তা। অপরদিকে জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের অনুচ্ছেদ-১৪ তে শিশুর চিন্তা, বিবেক ও ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকারের প্রতি সম্মান দেখানোর কথা বলা হয়েছে। জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত প্রতিটি রাষ্ট্রই মানবাধিকার ঘোষণা বা শিশু অধিকার সনদের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। আমাদের বেশিরভাগ শিক্ষকরা কি সর্বজনস্বীকৃত এসব আন্তর্জাতিক বিধিবিধানের ধার ধারেন? তাদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ প্রতিবন্ধিতার কোনো জবাবদিহিতাই নাই। অর্থ ও বাণিজ্যনির্ভর পঙ্গু শিক্ষাব্যবস্থায় জবাবদিহিতার হয়তো কোনো জরুরতও থাকে না। যেনতেনভাবে পকেটে টাকা এলেই হলো। এখানে গুটিকয়েক ভালো মনের সাদাসিধে শিক্ষক বেজায় মূল্যহীন। তারাও জিন্নাত আরা বা নাজনীন ফেরদৌসের মতো হেডমদের কাছে নিরুপায় ও কোণঠাসা। কাজেই অরিত্রীদের বিধিলিপি যেমন চলছে তেমনই থাকবে। আমাদের শঙ্কা ও হাহুতাশের আদৌ কোনো নিদান নাই।

আমেরিকার ষোড়শ রাষ্ট্রনায়ক আব্রাহাম লিংকন তাঁর পুত্রকে স্কুলে পাঠিয়ে প্রধান শিক্ষকের নিকট চিঠি লিখেছিলেন। সেখানে তিনি সন্তানের জন্য শিক্ষকের প্রতি আকুতি জানিয়েছিলেন। লিংকন অনেক কথার মাঝে বলেছিলেন, আমার পুত্রকে শেখাবেন, বিদ্যালয়ে নকল করার চেয়ে অকৃতকার্য হওয়া অনেক বেশি সম্মানজনক। নিজের ওপর তার যেন সুমহান আস্থা থাকে। সে যেন শেখে দুঃখের মাঝে কীভাবে হাসতে হয়। আমাদের অতি মহান শিক্ষকরা ‘শিশুর নিজের প্রতি আস্থাবান থাকবার’ এই বিদ্যাটার সামান্যও যদি অরিত্রীকে শেখাতেন তবে হয়তো এভাবে সে তার জীবনের প্রতি প্রেমহীন বা মায়াহীন হয়ে পড়ত না। সত্যি জানা নাই, আমাদের শিক্ষকরা কবে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠবেন।

কোনো ভুলের জন্য শিশুকে ভর্ৎসনা বা তিরষ্কার করে তাঁকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করে দেওয়ার অধিকার কারোরই থাকতে নেই। ভালোবাসার মন্ত্রণা শেখাবার মতো সক্ষমতা যদি না থাকে তবে তাকে আমরা শিক্ষক বলি কোন মুখে? শিশুরা কাদামাটি। সেই অমৃত মৃত্তিকাকে গড়াপেটা করে মানবীয় আদল যদি না তৈরি করতে পারেন, তবে আপনি শিক্ষক নামের মহৎ শিল্পী হতেই পারেন না। আমরা শিশুদের অন্তরেই ঘুমিয়ে থাকি। প্লিজ আমাদের এভাবে মারবেন না, বাঁচতে দিন।

লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন